প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২২, ০০:০০
আজ একান্নতম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। সবাইকে অফুরান শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, বুকের তপ্ত শোণিত প্রবাহের অকাতর বিসর্জনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার অরুণোদয় ঘটেছে বাঙালি জাতির ভাগ্যের আকাশে। পঁচিশে মার্চের কালরাতের নির্মমতায় অপারেশন সার্চলাইটের জান্তব আক্রমণে সেদিন এক রাতেই সারাদেশে লক্ষাধিক নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল। যাদের হারিয়েছে, তারা জানেন এ হারানোর বেদনা কতো গভীর, কতো অপূরণীয়! পঁচিশে মার্চের গণহত্যার ভয়াবহতায় ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি হয়ে পড়ে হতবিহ্বল। সেই হতবিহ্বল জাতিকে আবারো জাগিয়ে তোলে একটি বজ্রকণ্ঠ। রাত বারোটা এক মিনিটে ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের নবযাত্রা। তিরিশ লক্ষ শহিদ আর দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন করে লাল-সবুজের মর্যাদার পতাকা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হয়ে জাতি একান্নতম স্বাধীনতা দিবসে পদার্পণ করলেও আজও এদেশে জাতির পিতা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। বিভিন্ন উছিলায়, বিভিন্ন সুযোগে যে কেউ সহজেই স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে আক্রমণ করে বসে। দেশের আনাচে-কানাচে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনতার মহান স্থপতি কতিপয় মানুষের বিকৃত মানসিকতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
সর্বশেষ দেখা গেল, গত সতেরো মার্চে, স্বাধীনতার মহান স্থপতির একশ দুইতম জন্মবার্ষিকীতে সারাদেশ যখন আনন্দময় এ দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবসের মর্যাদায় উদ্যাপন করছে, তখন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় মোঃ রেজাউল ইসলাম নামে এক লোক মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে স্থাপিত জাতির জনকের ম্যুরালের মুখে ইচ্ছাকৃতভাবেই ওয়াজ মাহফিলের পোস্টার সাঁটিয়ে তাকে বিকৃত করে এবং অবমাননা করে। যদিও পুলিশ পরে তাকে আটক করেছে, কিন্তু বিষয় হলো এই, জাতির পিতার ম্যুরালের মতো সংবেদনশীল স্থাপনাগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হবে কেন? এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি যে বা যারা এরকম অপরাধ করছেন, তাদেরকেও কেবল আইনের আওতায় আনলেই চলবে না, তাদের ভেতরে এই বোধোদয় জাগাতে হবে যে, জাতির পিতার ম্যুরাল অত্যন্ত সম্মান ও গুরুত্বের বিষয়।
এর আগে দুহাজার কুড়ি সালের পাঁচ ডিসেম্বর, শুক্রবার রাতের আঁধারে কুষ্টিয়ায় পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হানা দিয়ে দুষ্কৃতকারীরা ব্যাপক ভাংচুর করে। এ যেন একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ পরায়ণতার উন্মত্ত বহিঃপ্রকাশ। শুধু যে ম্যুরাল বা ভাস্কর্যের ওপর আঘাত আসে তা নয়, রাষ্ট্রের প্রচলিত টাকার নোটে ছাপানো স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার ছবিকেও তারা রেহাই দেয়নি। বিভিন্নভাবে সেই ছবিকে বিকৃত করে তারা বিকৃত উল্লাসে মেতে উঠেছে। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার ছবি, ম্যুরাল বা ভাস্কর্য যদি নিরাপদ রাখা না যায়, তবে এতো ঘটা করে এই দিবস উদ্যাপনের আয়োজন বৃথা হয়ে যায়।
এইসব অজ্ঞ এবং প্রতিহিংসা লালনকারী মানুষগুলোকে কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই শোধরানো যাবে না। এদের শোধরাতে হলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিপ্লব আনা জরুরি। কেবল দোষারোপের সংস্কৃতি পরিহার করে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করা আমাদের জন্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতির পিতার সম্মান রক্ষার প্রশ্নে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। জাতির পিতা কোনো রাজনীতির বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্র ও জাতির জন্যে সম্মিলিত সম্মানের প্রতীক। রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু তার কদর্য প্রতিহিংসা জাতির পিতা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতির ওপর পড়তে পারে না। স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন তেমনি তা রক্ষা করাও কঠিন। কেবল অনুষ্ঠান-সর্বস্বতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার তাৎপর্য সকলকে বোঝানো যাবে না। এর জন্যে চাই স্বাধীনতাকে হৃদয়ে লালন করা। সকলের মনের জমিতে স্বাধীনতার চেতনার বীজ উপ্ত না হলে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্থপতিও অরক্ষিত হয়ে যায় এবং বিকৃত প্রতিহিংসার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। জাতির এই আনন্দের দিনে আমরা সবাইকে উদাত্ত আহ্বান জানাই, প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করুন এবং বাঙালি জাতিকে গৌরবের অংশীদার করে তুলুন। জয় বাংলা।