প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০
আমাদের দেশে যে কোনো ক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সে ক্ষেত্রে সতর্কতা সৃষ্টির জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। যেমন, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ৯টায় ঢাকা জেলার সাভার বাস স্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে এবং ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন গার্মেন্টস্ শ্রমিক নিহত এবং দু সহ¯্রাধিক মানুষ আহত হয়, যা বিশে^র ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে এটি না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও সেটি উপেক্ষা করেছিলেন ভবন মালিক। এর মাত্র পাঁচ মাস আগে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় বড় ধরনের অগ্নিকা-ের পর রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি ঘটে, যেটি বাংলাদেশে সংঘটিত সবচে’ বড় শিল্প দুর্ঘটনা।
রানা প্লাজা ধসের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের টনক নড়ে। তারা প্রত্যেক জেলা প্রশাসক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরকে পত্র প্রেরণ করে, যাতে স্থানীয়ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করাসহ অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেমতে ২০১৩ সালের মে মাস থেকে পরবর্তী ক’মাস এ সংক্রান্ত তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। অবস্থা তারপর যথা পূর্বং তথা পরংই রয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মানুষের বসবাস ইত্যাদি। আবার কোথাও (আল্লাহ না করুক) বড় ধরনের ভবন ধসের ঘটনা ঘটলেই হয়তো সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের টনক নড়বে, অন্যথায় নয়।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমান বন্দরে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান। এতে ৫১ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে। তারপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটগুলোর ফিটনেস ও পাইলটদের দক্ষতা নিয়ে দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের কঠোরতাসহ নানা বিষয়ে সতর্কতা জারি করে। কিন্তু তার কতোটুকু পালিত হচ্ছে, সেটা নিয়ে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো জরিপ বা গবেষণা আছে?
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা তো নিত্যদিনের ট্রাজেডি। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠন নিয়ে সারাদেশে নায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চনের লাগাতার আন্দোলন তো থেমে নেই। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওই বছরেরই ১ ডিসেম্বর থেকে তিনি এ আন্দোলন করে আসছেন। তার ফলস্বরূপ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পায় ২০১৭ সালের ৫ জুন। কিন্তু সড়কে কাক্সিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে আন্দোলন এখনো চলমান।
আমাদের দেশে ট্রেন দুর্ঘটনা পূর্বের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু লঞ্চ দুর্ঘটনা পূর্বের চেয়ে বেড়ে গেছে অনেক। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও অদক্ষ চালকের কারণে যে লঞ্চ দুর্ঘটনা একের পর এক ঘটে চলছে সেটা কে না জানে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানলেও না জানার ভান করে। তাদের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালনে অবহেলা, ওদাসীন্য ও অর্থপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তার কারণে ফিটনেসবিহীন লঞ্চও ফিটনেস ও রুট পারমিট পেয়ে যায়। গত ২০ মার্চ রোববার নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় রূপসী-৯ নামের কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিন ডুবে যায়। টনক নড়ে বিআইডব্লিউটিএ’র। তারা নারায়ণগঞ্জের সাথে ৫টি রূটের লঞ্চগুলোর চলাচল বন্ধ করে দেয়। লঞ্চগুলোর নানা ত্রুটি পরীক্ষার পর পুনরায় এসব রূটে লঞ্চ চলাচল করতে পারে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনায় টনক নড়ার পূর্বে যদি বিআইডব্লিউটিএ লঞ্চগুলোর ত্রুটি পর্যায়ক্রমে পরীক্ষার উদ্যোগ নিতো, তাহলে যাত্রীদের এমন ভোগান্তি এড়াতে পারতো। কিন্তু দেশে বিভিন্ন সংস্থার টনক নড়ার যে সংস্কৃতি, সেটা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারলো না-এটাই হলো লক্ষ্যণীয় বিষয়। এ খারাপ সংস্কৃতি পরিহারের বিষয়ে শুধু বিআইডব্লিউটিএ নয়, সরকারের সকল কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হওয়াটা সময়ের দাবি বলে আমরা মনে করি।