প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তিটি হলেন শঙ্কর চন্দ্র দে। সাংবাদিকতার নীতিমালা অক্ষরে অক্ষরে মেনে সাংবাদিকতায় যিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী পার করেছেন নির্বিঘেœ, তিনিই হলেন চাঁদপুরের সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক শঙ্কর চন্দ্র দে। তাঁকে সবাই ‘শঙ্কর দা’ হিসেবে ডাকতেন। এ ডাকার মধ্যে পরিলক্ষিত হতো শ্রদ্ধাজনিত সমীহ। সেই ভালো মানুষটি গত বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২) দুপুর ২টা ১০মিনিটে পরিবারের সদস্যদের খুব বেশি কষ্ট না দিয়ে হাড়ভাঙ্গার অসহ্য কষ্ট নিয়েই চোখ বুঁজেছেন। কোনো হাসপাতালে নয়, চাঁদপুর শহরের মেথা রোডস্থ ভাড়া বাসায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন একেবারে নীরবে।
আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ ছিলেন শঙ্কর চন্দ্র দে। মিতাহারী, মিতাচারী, মিতভাষী, নিভৃতচারী ও অজাতশত্রু ছিলেন তিনি। দূরবর্তী স্থান ছাড়া নিকটবর্তী স্থানসমূহে যাতায়াতে তাঁকে পায়ে হাঁটা ছাড়া রিকশা কিংবা অন্য কোনো যানবাহনে চড়তে দেখা যেতো না বলা চলে। তাহলে কি তিনি দারিদ্র্যে ভুগছিলেন?-মোটেও নয়। তিনি ছিলেন মনোযোগী মিতব্যয়ী। তিনি সাংবাদিকতাকে নেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁর পেশা ছিলো সম্মানজনক। তিনি চাঁদপুরের সর্ববৃহৎ ডব্লিউ রহমান জুট মিলে লেবার অফিসার হিসেবে নৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। এখান থেকে অবসর গ্রহণ করে পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে বেশ ক’বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর স্ত্রী মাধুরী রাণী দেও ছিলেন কর্মজীবী। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করেন। তিনি সর্বশেষ গুয়াখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। শঙ্কর চন্দ্র দের দুটি পুত্র সন্তানও কর্মজীবী। বড়জন ভারতের কলকাতায় থাকেন, আর ছোটজন (পার্থ প্রতিম দে) চাঁদপুর শহরের লেডী প্রতিমা মিত্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
শঙ্কর চন্দ্র দে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষায় ছিলেন সর্বোচ্চ সচেতন ব্যক্তি। এক্ষেত্রে কঠোর নিয়মনীতি মানার জন্যে তিনি চাঁদপুরের সাংবাদিক ও সুধী মহলে ছিলেন এক কিংবদন্তী। তিনি অনুজপ্রতিম সাংবাদিকদের সুযোগ পেলেই বলতেন, কোনো নিউজ পরিবেশন করে পস্তানোর চেয়ে পরিবেশন না করাই উত্তম। তিনি পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন দৈনিকে কাজ করলেও স্বাধীনতোত্তর ছিলেন দৈনিক বাংলার মহকুমা/জেলা প্রতিনিধি। তাঁর মূল সাংবাদিকতা জীবন হচ্ছে ১৯৬২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তারপর ২০১২ সাল কিংবা ততোধিক সময় সংবাদ সংস্থা ‘বিএনএসে’ সৌখিনভাবে জড়িত ছিলেন। সাপ্তাহিক রূপসী চাঁদপুরে লিখেছেন সম্পাদকীয়, যাতে সহজ সরল ভাষায় তিনি দিতেন নানা দিকনির্দেশনা।
শঙ্কর চন্দ্র দের মৃত্যু সংবাদ খুব বেশি প্রচারিত হয়নি। শব মিছিল হয়নি দীর্ঘ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো সংগঠনের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিলো না বলেই হয়তো এসব সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ভিড় দেখা যায়নি। মৃত্যুর ৫ ঘন্টার মধ্যেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইচলী মহাশ্মশানে। তার পূর্বে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে তাঁকে নেয়া হয় তাঁর প্রিয় কর্মস্থল চাঁদপুর প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। এখানে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং অকপট স্মৃতিচারণ করেন। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়। ব্যক্তিজীবনে আড়ম্বর পছন্দ করতেন না বলে হয়তো বা ‘শঙ্কর দা’র শেষ বিদায়টাও ছিলো আড়ম্বরহীন। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই আড়ম্বরহীনতা তাঁর জীবদ্দশার কর্মকীর্তিকে ম্লান করতে পারবে না। কারণ, চাঁদপুরের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান অনেক উঁচুতে, যে অবস্থান থেকে তাঁকে কোনোভাবেই সরানো যাবে না। তিনি কিংবদন্তী ও শ্রদ্ধেয় হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা চাঁদপুর জেলাবাসীর পক্ষে তাঁর ৭৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনাবসানে গভীর শোক প্রকাশ করছি, শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।