প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
সত্তর-আশির দশকের কথা। দেশের অন্যতম সেরা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন অনেক ডিগ্রিধারী এক শিক্ষাবিদ। তাঁর নামের শেষে বিএ (অনার্স), এমএ, বিটির পরেও আনকমন কিছু ডিগ্রি লেখা থাকতো নেমপ্লেটে। কোনো পরীক্ষায় স্কুল সম্পর্কে রচনা লিখতে দিলে বেশি মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো তার ডিগ্রিগুলো লিখলেও কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেটা সেভাবে লিখতে পারতো না। তারা উল্টাপাল্টা ডিগ্রি লিখে ফেলতো। এতে তাদের নম্বর কাটা যেতো।
আমাদের চিকিৎসকদের মধ্যে যারা রোগীকে সেবার চিন্তার চেয়ে বাণিজ্যিক চিন্তায় বিভোর থাকেন, তারা এমবিবিএস ডিগ্রির পরে এক/দুদিন/সাতদিন কোনো বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ নিলেও সেটির সংক্ষিপ্ত রূপ তৈরি করে কিংবা ভুয়া ডিগ্রি নেমপ্লেটে লাগিয়ে দেন। এমন চিকিৎসকরা সাধারণত দালাল নির্ভর। দালালরা এসব চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে সরলমনা রোগীদের প্রলুব্ধ করে ও কমিশন খায়। কিন্তু সচেতন রোগীরা এমন চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ড দেখে তাতে উল্টাপাল্টা ডিগ্রি লেখা পেয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এবং দালালদের ভর্ৎসনা করেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া ডিগ্রি, স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের ডিগ্রি নামের শেষে লাগিয়ে রোগীদের প্রতারিত করে অপচিকিৎসা প্রদানের প্রবণতা এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের মধ্যে প্রায়শই লক্ষ করা যায়। চাঁদপুর জেলাও তার বাইরে নয়। এ জেলার হাজীগঞ্জে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভুয়া ডিগ্রিধারী, ভুয়া চিকিৎসকের চিকিৎসায় রোগীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং সে থেকে অপচিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসক চিহ্নিত ও গ্রেফতার হবার খবর গণমাধ্যমে আসছে। গতকাল মঙ্গলবার চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে এমন একটি খবর। এ খবরটির শিরোনাম হয়েছে ‘হাজীগঞ্জে অপচিকিৎসায় বাক্ প্রতিবন্ধী শিশুর হাতে পচন’।
এ খবরটিতে লেখা হয়েছে, ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৫নং পূর্ব গুপ্টি ইউনিয়নের মানুরী নোয়া বাড়ির মোঃ হাছান মিয়ার প্রতিবন্ধী ছোট ছেলে, স্থানীয় একটি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন গত ৩ ডিসেম্বর ২০২১ খেলতে গিয়ে তার হাত ভেঙ্গে ফেলে। এমতাবস্থায় তার বাবা তাকে হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ রোডে জান্নাত ফার্মেসীতে নিয়ে যান। সেখানে আলাউদ্দিন নামে এক চিকিৎসকের মাধ্যমে আরাফাতের হাতে প্লাস্টার করান। প্রেসক্রিপশনে এ চিকিৎসকের যেসব ডিগ্রি উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ডি.এম.এফ. (ঢাকা), বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, এক্স.এফ.টি. (জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা), জেনারেল ফিজিশিয়ান, বিএমএন্ডডিসি রেজিস্ট্রেশন নং ডি-২০৭৩৯।
হাছান মিয়া ইটভাটার শ্রমিক বলে তিনি সম্ভবত দালালের খপ্পরে পড়েন এবং আনকমন ডিগ্রিধারী চিকিৎসক আলাউদ্দিনের কাছে নিজ পুত্র আরাফাতকে নিয়ে যান, যে কিনা অপচিকিৎসার শিকার হয়ে বর্তমানে হাতের ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগা দূরে থাক, হাত কেটে ফেলার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। সর্বশেষ তার ঠাঁই হয়েছে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতালে)। হাছান মিয়া তার পুত্র আরাফাতকে অপচিকিৎসা করার বিষয়ে আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে হাজীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাঁরা উভয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের আশ^াস দিয়েছেন।
আমরা আশা করি, দরিদ্র হাছান মিয়ার প্রতিবন্ধী শিশু আরাফাত অপচিকিৎসার শিকার হয়ে ইতোমধ্যে শারীরিক যে প্রতিবন্ধিত্বের মুখোমুখি হয়েছে, তার জন্যে দায়ী চিকিৎসক আলাউদ্দিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবেন এবং তার প্রেসক্রিপশনে ব্যবহৃত ডিগ্রি সমূহের যথাযথ ব্যাখ্যা দেবেন। আমাদের বিশ^াস, তিনি অপব্যাখ্যা দিতে পারবেন, তবে যথাযথ ব্যাখ্যা নয়। আমাদের দাবি, আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক এবং তার নিকট থেকে শিশু আরাফাতের ক্ষতিপূরণ আদায় করা হোক। সাথে সাথে আরো দাবি, হাজীগঞ্জে ভুয়া চিকিৎসক ও অপচিকিৎসা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজরদারি বৃদ্ধি করুক ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।