প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩২
৭ নভেম্বর : জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
সৈনিক ও বেসামরিক ঐক্যের অমর দৃষ্টান্ত

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু দিন আছে যা জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের পথনির্দেশ করেছে, যা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়, নৈতিক অবস্থান ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তেমনি একটি দিন হলো ৭ নভেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’। এদিনটি শুধু একটি সেনা বা রাজনৈতিক বিদ্রোহের স্মারক নয়, বরং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার চূড়ান্ত সংকল্পের প্রতিফলন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সৈনিক, বেসামরিক জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে জীবন বাজি রেখে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেটিই আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সংহতির প্রতীক। ৭ নভেম্বর কেবল একটি অতীত ঘটনা নয়, এটি একটি চলমান প্রেরণা, যে প্রেরণায় স্বৈরাচার, পরিবারতন্ত্র ও বিদেশি নির্ভরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পায় নতুন প্রজন্ম।
৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট : বিভক্ত বাংলাদেশ ও একতার আহ্বান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশ এক অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে পতিত হয়। সেনা ও প্রশাসনের মধ্যে বিভাজন, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং জাতীয় নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড জাতিকে আরও বিভক্ত করে তোলে।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে দেশজুড়ে অস্থিরতা, বিদ্রোহ, বিভাজন এবং নেতৃত্বহীনতার এক অন্ধকার নেমে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক ও জনগণ এক অভূতপূর্ব ঐক্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করা। সেই দিন তারা রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখেছিল, আর সেই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেনানায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)।মেজর জিয়াউর রহমান : নেতৃত্ব, আদর্শ ও জাতীয় পুনর্জাগরণ ৭ নভেম্বরের মূল প্রেরণার কেন্দ্র ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে সৈনিক ও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার’ শপথ নেয়। সেনা সদস্যরা তাঁকে মুক্ত করে আনেন, জনগণ রাস্তায় নেমে আসে, আর পুরো জাতি যেন এক নতুন আশার সূর্যোদয় দেখে।
জিয়াউর রহমানই প্রথম বলেনÑ“বাংলাদেশ হবে জনগণের রাষ্ট্র, যেখানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চেতনা অক্ষুণ্ন থাকবে।” এই আহ্বানেই শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক যাত্রা, যেখানে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ’ ও ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ ছিলো মূল ভিত্তি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের এই বিপ্লব শুধু সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন নয়, বরং বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তায় এক বৈপ্লবিক রূপান্তর আনে। তিনি একদিকে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনেন, অন্যদিকে বেসামরিক প্রশাসনে স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শÑ’বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’Ñআজও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। ৭ নভেম্বরকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক নতুন নয়। এক পক্ষ একে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করে, অন্য পক্ষ একে ‘প্রতিক্রিয়া’ বলে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়Ñ ৭ নভেম্বর ছিলো জনগণের আত্মরক্ষামূলক বিপ্লব। এটি ছিলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ, যেখানে জনগণ ও সৈনিক এক কাতারে দাঁড়িয়েছিলো। ৭ নভেম্বরকে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে। তিনি বলেনÑ“এই দিনে বাংলাদেশে জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ঐতিহাসিক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। এদিন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার দিন।” কিন্তু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার এ দিবসের সরকারি স্বীকৃতি বাতিল করে। তবুও জনগণের হৃদয়ে ৭ নভেম্বর আজও জীবন্ত, কারণ এটি ক্ষমতা নয়, আদর্শ ও আত্মত্যাগের স্মারক।
সৈনিক-জনতার ঐক্য : জাতীয় শক্তির ভিত্তি ৭ নভেম্বরের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হলো, “দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সৈনিক ও জনগণ একসাথে থাকলে কোনো শক্তিই বাংলাদেশকে পরাজিত করতে পারে না।” সেই ঐক্যের মন্ত্রই বিএনপি’র রাজনৈতিক দর্শনের প্রাণ। জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেনÑকোনো জাতি তখনই শক্তিশালী হয়, যখন জনগণ ও সেনাবাহিনী একই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত রাখার পাশাপাশি তাদের পেশাদারিত্বে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন, যা আজও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিক কাঠামোর ভিত্তি।
জাতীয় সংহতির বার্তা : গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা
৭ নভেম্বরের চেতনা কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনেরও সূচনা। জিয়াউর রহমান গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প ও কর্মসংস্থানে যে নতুন নীতি গ্রহণ করেন, তা দেশের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের দিকনির্দেশ করে। তাঁর ঘোষিত ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ নীতি আজও প্রাসঙ্গিকÑযেখানে জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি এবং জাতীয় ঐক্যই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। আজকের বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্র বিপন্ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণে নিমজ্জিত, যখন মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখেÑতখন ৭ নভেম্বরের আহ্বান নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে।
বর্তমান প্রজন্মের জন্যে এই দিনটি এক সতর্ক সংকেতÑযদি জনগণ ঐক্যবদ্ধ না থাকে, যদি সৈনিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে আস্থা না থাকে, তাহলে স্বাধীনতা টিকে থাকতে পারে না।
আজ বিএনপি এবং গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের দায়িত্ব হলো সেই ৭ নভেম্বরের সংহতির চেতনা পুনর্জাগরিত করা, যেখানে দল নয়, দেশ ও জনগণই প্রধান।জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার ও বিএনপির ঐতিহাসিক দায়িত্ব :
৭ নভেম্বরের চেতনার ধারক ও বাহক বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দলটি জিয়াউর রহমানের আদর্শ Ñ’গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি ও জাতীয় সংহতি’ কে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। আজ দেশ আবার এক নতুন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বিএনপি সেই ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছে, যে ঐক্য প্রথম গড়ে উঠেছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের রক্তাক্ত প্রভাতে।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবের প্রকৃত শিক্ষা হলোÑদেশপ্রেম মানে কেবল স্লোগান নয়, এটি আত্মত্যাগের প্রতিজ্ঞা। সেই দিন হাজারো সৈনিক ও সাধারণ মানুষ প্রমাণ করেছিলেনÑবাংলাদেশ কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি নয়, এটি ৭ কোটি মানুষের ত্যাগের ফসল। আজও যখন রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, দমন-পীড়ন, গুম-খুন, অন্যায় মামলা চলছে, তখন ৭ নভেম্বরের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। ৭ নভেম্বর আমাদের শেখায়Ñদলমত নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য গঠনই মুক্তির একমাত্র পথ। যে জাতি বিভাজনে দুর্বল হয়, সে জাতি পরাধীনতার ফাঁদে পড়ে। আজ আবারো আমাদের সেই ঐক্যের চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে, যেখানে সৈনিক ও নাগরিক, কৃষক ও ছাত্র, শ্রমিক ও শিক্ষক সবাই এক পতাকাতলে দাঁড়িয়ে বলবে : “বাংলাদেশ স্বাধীন, বাংলাদেশ সার্বভৌমÑএকে রক্ষা করবো প্রাণ দিয়ে।”
৭ নভেম্বর কোনো রাজনৈতিক দলের একার সম্পত্তি নয়, এটি বাংলাদেশের জনগণের দিন। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেসব মুক্তিকামী সৈনিক ও নাগরিকদের, যাদের ত্যাগে রক্ষা পেয়েছিলো আমাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা। আজও সেই চেতনা প্রাসঙ্গিকÑযতদিন গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা অবরুদ্ধ থাকবে, ততদিন ৭ নভেম্বরের বিপ্লব আমাদের হৃদয়ে অনন্ত প্রেরণা হয়ে থাকবে।
৭ নভেম্বর বেঁচে আছে আমাদের জাতীয় চেতনায়, আর তার আত্মা প্রতিনিয়ত ডাক দিচ্ছেÑ“সংহতি গড়ো, ঐক্য ফেরাও, বাংলাদেশকে রক্ষা করো।”
“৭ নভেম্বর কেবল ইতিহাস নয়Ñএটি বাংলাদেশের আত্মার পুনর্জাগরণ।”
লেখক : মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।




