রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩২

জাদুঘর ও প্রাসাদের আড়ালে লুকানো নাজরানের জীবন্ত ইতিহাস

মোহাম্মদ সানাউল হক
জাদুঘর ও প্রাসাদের আড়ালে লুকানো নাজরানের জীবন্ত ইতিহাস

সৌদি আরবের নাজরান আঞ্চলিক জাদুঘর ভ্রমণকারীদের ইতিহাসের পথে হাঁটার এক অনন্য সুযোগ করে দেয়। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন, প্রাচীন কাফেলা পথের দলিলচিত্র এবং শিলালিপি, যা নাজরান অঞ্চলের ইতিহাস গঠনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে জীবন্ত করে তোলে। দর্শনার্থীরা মানচিত্রের মাধ্যমে অঞ্চলের অতীত রূপ ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। জাদুঘরের বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত প্রত্নবস্তু প্রাচীন মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

প্রাচীন বাণিজ্যপথের কারণে নাজরান অঞ্চল একসময় শতাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের জন্যে সুপরিচিত ছিল। এসব স্থান থেকে গ্রিক, সিরিয়াক, থামুদীয়, নবাতীয় ও প্রাথমিক আরবি লিপির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আজ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। দর্শনার্থীরা এখান থেকে স্থানীয় ঐতিহ্য আবিষ্কারের সুযোগ পান এবং নাজরান সমাজের জীবনধারা, নির্মাণশৈলী, কৃষিকাজ ও হস্তশিল্প সম্পর্কে গভীর ধারণা লাভ করেন।

নাজরান শহর বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রাসাদগুলোর জন্যেও সুপরিচিত। এর মধ্যে অন্যতম হলো আল-আন প্যালেস, যা আল-আন পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এবং সাদান প্রাসাদ নামেও পরিচিত। ১১০০ হিজরি (১৬৮৮/১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে) নির্মিত এ প্রাসাদটি একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে, যার সর্বশেষ সংস্কার সম্পন্ন হয় ১৪৪০ হিজরিতে (২০১৮/২০১৯ খ্রিস্টাব্দে)।

ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে প্রাসাদটির বাহ্যিক নকশা ও সাদা প্রলেপযুক্ত অলংকরণ বিশেষভাবে চোখে পড়ে। পাথরের ভিত্তি ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি উঁচু কাঠামো, খেজুরগাছের কাণ্ড ও পাতায় নির্মিত ছাদ এবং সিদর ও আথেল কাঠের ব্যবহার সেই সময়কার নান্দনিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে।

২৬ কক্ষবিশিষ্ট চারতলা এই প্রাসাদটি নির্মাণশৈলীতে ছিল অনন্য। প্রতিটি তলা আলাদা পরিবারের জন্য নির্ধারিত থাকায় এটি এক ধরনের সমবেত পারিবারিক জীবনের প্রতিফলন ঘটাতো। পুরো প্রাসাদকে ঘিরে নির্মিত হয়েছিল প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর ও সুউচ্চ টাওয়ার, যা বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতো। এর স্থাপত্যে স্থানীয় সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে, যা সেই সময়কার সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করে।

প্রাসাদের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে একটি সংগ্রহশালা, যেখানে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার নিদর্শনসমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন পোশাক, অলঙ্কার, পাত্র-পাত্রী এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী। এসব প্রদর্শনী দর্শনার্থীদের অতীতের সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে, যা ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

নাজরানের আল-মানজাম গ্রামে অবস্থিত আল-মানজাম প্যালেসের ইতিহাস প্রায় ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত ফিরে যায়। ২০১৬ সালে এই ঐতিহাসিক প্রাসাদটি যত্নসহকারে পুনঃসংস্কার করা হয়, যাতে এর অনন্য স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখা যায়। চারতলা বিশিষ্ট এই প্রাসাদটি কাদামাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা, যা প্রাচীন সময়ের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাসাদের জানালাগুলো সমান আকারের সাদা ফ্রেম দ্বারা সাজানো, যা এর সৌন্দর্য ও নান্দনিকতাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।

প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ গঠন অত্যন্ত মনোগ্রাহী; এতে বড়ো বড়ো উঠান রয়েছে এবং বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা কাজে ব্যবহৃত হতো। এখানে মসজিদ, পুরুষদের মজলিস (আলোচনার স্থান), দাস ও প্রহরীদের জন্যে নির্দিষ্ট কক্ষ, শস্য ও খেজুর সংরক্ষণের ঘর এবং পশুদের জন্যে ভূগর্ভস্থ একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিলো। এই সকল বিভাগ অতীতের জীবনযাত্রার একটি স্পষ্ট ও জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে, যা ঐ সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের দিকগুলোকে বোঝাতে সাহায্য করে।

নাজরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আল-উখদুদ শহরের ইতিহাস প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রাচীন শহরে বিভিন্ন যুগের সভ্যতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, যা ইতিহাসপ্রেমীদের জন্যে এক অনন্য সন্ধান। আল-উখদুদ কেবলমাত্র একটি পুরনো বসতি নয়, এটি কুরআনে বর্ণিত আশহাবুল উখদুদ বা গর্তবাসী মানুষদের ঘটনাস্থল হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই ঘটনাটি প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের, যা প্রাচীন ধর্মীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শহরের মধ্যে অবস্থিত প্রাচীন দুর্গ ‘আল-কাসাবা’, মসজিদ এবং অসংখ্য শিলালিপি আজও সুস্মৃতিতে রয়ে গেছে, যা ওই সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে।

আল-উখদুদ শহরে বিভিন্ন ধরণের প্রত্নসম্পদও পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। গম পিষার কাজে ব্যবহৃত রহহা নামক পাথর এবং অন্যান্য প্রাচীন পাত্র-পাত্রী এখানে এখনো অক্ষুণ্ন অবস্থায় রয়েছে। শহর থেকে উদ্ধার হওয়া বিরল প্রত্নবস্তুসমূহ বর্তমানে নাজরান প্রত্নতত্ত্ব ও লোক ঐতিহ্য জাদুঘরে সংরক্ষিত, যেখানে তারা ঐতিহ্যরক্ষা ও গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এসব নিদর্শন আল-উখদুদের অতীত জীবন ও সভ্যতার গভীরতা সম্পর্কে সমৃদ্ধ ধারণা প্রদান করে।

নাজরানের আবা আল-সাউদ (আল-বালাদ) পাড়ায় অবস্থিত ঐতিহাসিক আমিরাত প্রাসাদটি ১৯৪৪ সালে তৎকালীন গভর্নর প্রিন্স তুর্কি বিন মাধির উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়। প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে নির্মিত এই তিনতলা প্রাসাদটি ৬,২৫২ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এতে ৬০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। একসময় এটি আমিরাতের সরকারি কার্যালয় ও প্রশাসনিক সদর দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হত। প্রাসাদের চার কোণায় উঁচু বৃত্তাকার নজরদারি টাওয়ার নির্মিত ছিলো, যার একটি অংশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ কার্যালয়ও পরিচালিত হতো।

এই প্রাসাদ ও এর আশপাশের পুরাতন বাজারগুলো যেমন আল-জনাবি বাজার, যেখানে চামড়াজাত দ্রব্য ও মাটির পাত্র তৈরির দোকান, ঐতিহ্যবাহী পোশাক বিক্রেতারা আজও রয়েছেন পর্যটকদের জন্যে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে আমিরাত প্রাসাদটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১২টা এবং বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে, যেখানে দক্ষ গাইডরা ঐতিহাসিক তথ্যাদি ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা দর্শনার্থীদের জন্য স্থানটির গুরুত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়।

নাজরানের সাকাম অরণ্যে অবস্থিত কিং ফাহাদ পার্ক শহরের অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক বিনোদনকেন্দ্র। প্রায় ৬.৫ লক্ষ বর্গমিটার বিস্তীর্ণ এই পার্কটি মনোরম সবুজায়ন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা। পার্কের মধ্যে রয়েছে ২.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেল ট্র্যাক, যা সাইকেলপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও, ৭৬০ মিটার এবং ৩৯৫ মিটার দীর্ঘ দুটি হাঁটার পথ দর্শনার্থীদের শুদ্ধ বাতাসে হাঁটাহাঁটির সুযোগ দেয়। পার্ক জুড়ে জুনিপার, তামারিস্ক, সামের ও আথেল প্রজাতির গাছপালা এবং হাজারো রঙিন মৌসুমি ফুলের অপরূপ সমাহার মনকে প্রশান্তি দেয়।

শিশুদের জন্য আলাদা খেলার জায়গা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তারা নিরাপদে খেলাধুলা করতে পারে। পার্কে ফোয়ারা ও হালকা খাবারের কিওস্ক থাকায় দর্শনার্থীরা বিশ্রামের পাশাপাশি স্বল্পাহার গ্রহণ করতে পারেন। রঙিন আলোয় সজ্জিত বাগান এবং ছায়াযুক্ত বসার স্থানগুলো পার্কের সৌন্দর্য ও আরামদায়কতা বাড়িয়ে তোলে, যা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। এই সব মিলিয়ে কিং ফাহাদ পার্কটি শহরের একটি প্রাণবন্ত ও জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।

মোহাম্মদ সানাউল হক : +৯৬৬০৫৭৬৩২৮৫৫০

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়