বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫০

দাম্পত্য যেমন সন্তান কি তেমন?

হাসান আলী
দাম্পত্য যেমন সন্তান কি তেমন?

দাম্পত্য মানে নারী পুরুষের বৈবাহিক জীবন। দাম্পত্য সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগতভাবে বৈধ।আমাদের দেশে দাম্পত্য শুরুর আগে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া হয় না।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা দাম্পত্য বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন দেয়। বিশেষ করে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা দাম্পত্যের চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রেম- ভালোবাসা দিয়ে মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেন। দাম্পত্য জীবনের নানান চ্যালেঞ্জগুলোকে কেউ কেউ তেমন একটা পাত্তা দিতে চায় না। দাম্পত্য জীবনকে বেশির ভাগ মানুষই সহজ করে নিতে পছন্দ করে। এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক ভাবনা।

দাম্পত্য জীবন নানাভাবে পরিবেশ, পরিস্থিতি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। সবাই কম-বেশি পরামর্শ দিয়ে দাম্পত্যকে কঠিন করে তুলতে পছন্দ করেন। আমরা দাম্পত্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বামী-স্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে পছন্দ করি না, বরং এক পা বাড়িয়ে দিয়ে উপদেশ বিতরণে আকুল হয়ে উঠি।

আমরা যদি কোনো দম্পতিকে জিজ্ঞেস করি কেন সন্তান নিয়েছেন, তাহলে নিচের কয়েকটি উত্তর শুনতে পাবেন। যথা--বাবা-মা, শ্বশুর- শাশুড়ি, আত্মীয় স্বজনের চাপে, সবার ছেলেমেয়ে আছে সেজন্যে সন্তান নেয়া, সক্ষম দম্পতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া, নিজের স্বপ্ন সন্তানকে দিয়ে পূরণ করানো ও দাম্পত্য জীবনের ঝগড়াঝাটি থামাতে সন্তান নেয়া ।

আমাদের দম্পতিরা সাধারণত চার ধরনের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করে। যথা-- ১. ঝগড়া বিবাদ ও মিলমিশের দাম্পত্য ২. সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসার দাম্পত্য ৩. সময় কাটানোর দাম্পত্য ৪. উপায়হীন দাম্পত্য।

ঝগড়া-বিবাদ ও মিলমিশের দাম্পত্য আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে। মতের অমিল কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ-কর্মকে কেন্দ্র করে মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। ঝগড়া শুরু হলে কে কাকে কতোখানি ছোট করতে পারবে সে বিষয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে। পরিস্থিতি খারাপ হলে একে অপরকে শারীরিকভাবে আঘাত করে। শিশুরা বাবা-মার এমন কর্মকাণ্ডে আতংকিত হয়ে পড়ে। শিশুরা বাবা-মার প্রতি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড়ো হতে থাকে।

সম্মান মর্যাদা ও ভালোবাসার দাম্পত্য আমাদের সবারই কাম্য। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পরস্পরের প্রতি সম্মান- মর্যাদা, দায়িত্ব-কর্তব্য, সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা নিয়ে দাম্পত্যে থাকলে সন্তানরা বাবা-মার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বড়ো হয়।

সময় কাটানোর দাম্পত্য হলো স্বামীর সাথে স্ত্রী ঝগড়া-বিবাদে কিংবা যোগ্যতায় কুলিয়ে উঠতে না পারলে চুপ করে থাকার নীতি অনুসরণ করা। অন্যদিকে স্ত্রীর যোগ্যতা, ধনসম্পদ বেশি হলে স্বামী চুপ থাকার চেষ্টা করে। ঝগড়া- বিবাদে ক্লান্ত, ত্যক্ত- বিরক্ত হয়ে উভয়ই নীরবে সংসার করে যান অথবা মানসিকভাবে একে অপরের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন।

উপায়হীন দাম্পত্য হলো স্বামী স্ত্রী একে অপরকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, মতের ভিন্নতা থাকে, আলাদা বিছানায় শোয়, ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে একই বাসায় থাকে, আর্থিক, সামাজিক বিষয় এমনভাবে থাকে যে, কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারছে না।

দাম্পত্যের সংকটগুলো ছেলেমেয়েরা শিশু বয়সেই বুঝতে পারে। বাবা-মার আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা, নিষ্ঠুরতা, গালাগালি, মারামারি, পরকীয়া শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। বাবা মা অনেক সময়ই সন্তানকে নিজের পক্ষে আনতে, সহানুভূতি পেতে একে অপরের চরিত্র হনন, সম্মানহানি করতে সচেষ্ট হয়।

নিজেদের ঝগড়া-বিবাদ, নিষ্ঠুরতা শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে সাময়িক সুখ হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শিশুরা বাড়িতে সহিংসতার বড় সাক্ষী হয়ে যায় এবং সহিংসতা কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে।

বাচ্চারা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভোগে, বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়, অকারণে পেট ব্যথা হয়, স্কুলে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠে, সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহ পায় না, নিজ ঘরে একাকী থাকতে পছন্দ করে, কোনো কাজে উৎসাহ বোধ করে না, হতাশায় ভুগতে থাকে।

উপরের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শিশুরা যৌবনে উপনীত হয় এবং নিজেরা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে। অল্প কিছু সংখ্যক যুবক-যুবতীকে দাম্পত্য জীবনে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়।

বাবা-মার কাছ থেকে প্রাপ্ত জীবনশিক্ষা শিশুরা কার্যত সারা জীবন বয়ে বেড়ায়। বাবা-মার কাছ থেকে প্রাপ্ত গুণাবলি শিশুকে পরিণত বয়সে সাহসী, সৎ, মেধাবী, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কথায় আছে যেমন গাছ তেমনই ফল!

দাম্পত্য জীবনে প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা, অপমান, অসম্মান, মিথ্যা, লুকোচুরি সন্তানকে মানসিকভাবে দুর্বল হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।

একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ -পরিবারে গড়ে ওঠা শিশুরাই ভবিষ্যতে প্রবীণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বড়ো ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুরা পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা প্রবীণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসম্মান, অপমান, নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে দেখে। তবে ভবিষ্যতে তারাও একদিন প্রবীণদের প্রতি আরো বেশি নিষ্ঠুরতা, অপমান, অসম্মান প্রদর্শন করতে শিখবে।

আমরা শিশুকে পরিবারে, স্কুলে শিশু, নারী ও প্রবীণদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে কার্যকর কোনো প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না। ফলে তরুণরা রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে, সেবা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারছে না। আমরা ভুলে যাই যে, সন্তান শেষ পর্যন্ত সমাজের হয়ে যায়। সন্তানকে গড়ে তোলা হয় মূলত সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক সামাজিক জীবন গড়ে তোলার জন্যে।

দাম্পত্য জীবনে যেসব চাহিদা থাকে তা হলো--সুশ্রী সুদর্শন, শিক্ষিত, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান, সহনশীল, মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন সঙ্গী। আমার কাছে মনে হয়েছে, দাম্পত্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সঙ্গীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যারা সঙ্গীকে অপমান-অপদস্থ-নির্যাতন-নিপীড়ন করে বিকৃত সুখ লাভের চেষ্টা করে তারা নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি সন্তানদের বিরাট ক্ষতি করেন।

আমাদের সন্তানরা ঝগড়া-বিবাদের দাম্পত্য দেখে বড়ো হয়ে দাম্পত্য যাপনে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে জন্মহার আশংকাজনক হারে নিম্নগামী হবার সম্ভাবনা থাকবে। দাম্পত্য শুধু জৈবিক চাহিদা পূরণের বিষয় নয়, পৃথিবীর জন্যে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তৈরির পীঠস্থান।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে কথক ও লেখক; প্রবীণ বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণেতা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়