প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৮
খাল পুনরুদ্ধারে স্বেচ্ছাশ্রম!
গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের শীর্ষ সংবাদ ছিলো ‘হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধারে নেমেছে এলাকাবাসী’। সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, বর্ষার সময়ে বাড়িসহ সর্বত্র পানি, আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতার কারণে সেচে সমস্যা। এসব কিছুর মূলে একটি খাল। ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার ৯নং ওয়ার্ডের চরকুমিরা গ্রামের চরকুমিরা খাল নামে খ্যাত খালটির অস্তিত্ব সংকটে থাকায় এই সমস্যার উৎপত্তি।
গেলো বর্ষায় পুরো এলাকার পানি সরতে না পারায় ৮০ ভাগ এলাকা পানির নিচে থাকে। সমস্যার মূলে থাকা চরের দখলদারিত্বের অবসানের পর এলাকাবাসী খাল পুনরুদ্ধারে নেমেছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার লোকজন দল বেঁধে খালের বাঁধ কাটছেন। এরই মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব বয়সী মনু মিয়া, শাহাদাত হোসেন, ষাটোর্ধ্ব মজিবুর রহমান, সাবেক সেনা সদস্য জব্বার মিজি বিশাল চরের মধ্যে ধানের ক্ষেতের একটি অংশ দেখিয়ে বলেন, এখানে এক সময়ে খাল ছিল। এই খাল দিয়ে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের ক'টি গ্রামের পানি বর্ষার সময়ে নদীতে নেমে যেতো। এছাড়া ধানের মৌসুমেও সেচের কাজে পানি ব্যবহার করার জন্যে এই খাল ছিলো গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু গত দুদশক ধরে মাছ চাষ করতে যেয়ে খালের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জমির সাথে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এখন কেউ আসলেও খালের এই অংশের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। এছাড়া পুরো খালটির বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ বর্ষায় পানি সরতে না পারায় এই এলাকার ৮০ ভাগ এলাকা পানির নিচে ছিলো। আমরা এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই, তাই খাল উদ্ধারে নেমেছি।তাদের অভিযোগ, গত দু দশকের বেশি সময় ধরে মাছ চাষের নামে দখলদারিত্ব করে কুমিরার মথুরা চর নামে বিশাল চরটিতে মাছের আবাদ করেছে একটি সিন্ডিকেট। তাদের কাছে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। তাদের কারণে চরের পাশ দিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে যাওয়া চর কুমিরা খালটির অস্তিত্ব এখন নেই। এছাড়া এতো বছরের দখলদাররা খালের বিভিন্ন অংশে পরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করেছেন।
ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার ৯নং ওয়ার্ডের চরকুমিরা গ্রামের কুমিরার মথুরা চরের বিশাল চরটির দক্ষিণাংশে চরকুমিরা খাল নামে খ্যাত খালটির অস্তিত্বই নেই। চরের সাথে একাকার হয়ে গেছে। খালটির শুরুর মুখ থেকে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে ও ভরাট করে নালায় পরিণত করা হয়েছে। এতে পৌর এলাকার চরকুমিরা, ভাটিয়ালপুর এবং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের চরমুথরা গ্রামের আবাদকৃত ভূমিতে পানি দেয়া ও বর্ষায় পানি নিষ্কাশনে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিগত বর্ষার সময় টানা বর্ষণের কারণে পানি সরতে না পেরে তিনটি গ্রামের ৮০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এখনো কিছু কিছু স্থানে পানি জমে রয়েছে। মো. সোহাগ, জসিম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এলাকার একটি পক্ষ খালটিতে বাঁধ দিয়ে এবং মাছ চাষের নামে চর দখলে রেখে তিন গ্রামের দশ সহস্রাধিক জনগণের সর্বনাশ করেছে। আমরা চাই সরকারি কর্তৃপক্ষ খালটি উদ্ধারে এগিয়ে আসুক।
আমরাও এমন চাওয়ার সাথে একাত্মতা পোষণ করছি। কেননা স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা নির্মাণ সহজ, কিন্তু খাল খনন ও খাল পুনরুদ্ধারের কাজ অতোটা সহজ নয়। আমরা হারিয়ে যাওয়া চরকুমিরা খাল পুনরুদ্ধারে এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসাটাকে আশাব্যঞ্জক মনে করছি। এটাকে শতভাগ সাফল্যে পর্যবসিত করতে হলে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা অনিবার্য। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়/ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কিংবা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চরকুমিরা খাল পুনরুদ্ধারে দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে, নয়তো থোক বরাদ্দ দিয়ে খালটি পুনরুদ্ধারে এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগকে প্রণোদনা প্রদানটা সময়োচিত হবে বলে আমরা মনে করি।
এটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি যে, স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে সত্তরের দশকে দেশে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিলো, তখন অসংখ্য রাস্তা তৈরি হয়েছে স্বেচ্ছাশ্রমে। এক্ষেত্রে শাহরাস্তির কৃতী সন্তান ড. এমএ সাত্তার ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য উদ্যোক্তা। তিনি এলাকাবাসীকে মোটিভেট করে আরো কতো কিছুই না করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবার পূর্বাপর তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তো দেশে খাল কাটার কাজটি একটি বিপ্লবে পরিণত হয়েছিলো। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ তাঁর দল বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা খাল কাটায় অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমান বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রে শাহাদাতবরণের পর দেশের কর্তৃত্ব চলে যায় সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে। তিনি তাঁর পূর্বসূরির খালকাটা বিপ্লবকে অব্যাহত রাখেন নি, বরং খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। পরবর্তী সকল শাসকই এই মনোযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। যে কারণে খাল-বিল-নদী-হাওড়-বাঁওয়ের দেশ বাংলাদেশে জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যা হয়ে গেছে উল্লেখযোগ্য সমস্যা। গেলো বর্ষায় এমন সমস্যার সর্বোচ্চ শিকার হয়েছে ফরিদগঞ্জ উপজেলা। সেজন্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর হোসেন দুলালের নেতৃত্বে ডাকাতিয়া নদী ও খাল খনন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা একের পর এক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এর ফসল হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে খাল খননের কার্যক্রম শুরু করেছে এবং চরকুমিরা খাল পুনরুদ্ধারে এলাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এগুলোকে বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ বলেই মনে হচ্ছে। বস্তুত এজন্যে প্রয়োজন সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগ। আশা করি জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং উল্লেখিত সংগ্রাম কমিটি মতবিনিময় করে সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের কাজটি অতিসত্বর সম্পন্ন করবে। এক্ষেত্রে কারো পক্ষ থেকে দীর্ঘসূত্রিতা হবে নেতিবাচক ও যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টির সহায়ক।