প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:২৮
অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খানের মৃত্যুতে গভীর শোক
১৯৪৬ সালে চাঁদপুরে একমাত্র স্বীকৃত সাংবাদিক ছিলেন চাঁদপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আজিম উদ্দিন (বর্তমানে মরহুম)। তিনি ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদের চাঁদপুর সংবাদদাতা ছিলেন । তাঁর উৎসাহে ১৯৫১ সালে অ্যাডভোকেট আব্দুল খালেক চৌধুরী সাংবাদিকতায় এগিয়ে আসেন। তিনি এপিপি ও দৈনিক আজাদের চাঁদপুর সংবাদদাতা ছিলেন। সে সময় সাংবাদিকতা করতে তেমন উৎসাহিত হতেন না কেউ। এমতাবস্থায় আব্দুল খালেক চৌধুরীর উৎসাহে ষাটের দশকে যে ক'জন সাংবাদিকতায় এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান ছিলেন অন্যতম। তিনি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের চাঁদপুর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর চাঁদপুর সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। স্বাধীনতার পর আব্দুল খালেক চৌধুরী সাংবাদিকতা থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এ সময় চাঁদপুর কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক ( পরবর্তীতে যিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ক্রীড়া কর্মকর্তা হয়েছিলেন) কামরুজ্জামান চৌধুরী (বর্তমানে মরহুম) চাঁদপুরের সাংবাদিকতার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তিটি সর্বাগ্রে তাঁর সাথে এগিয়ে আসেন, তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান। তিনি চাঁদপুর কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা এবং অংকুর কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে একজন শিশু সংগঠক হিসেবে নিজেকে চাঁদপুর জেলাবাসীর কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরেন।
১৯৭৪ সালে চাঁদপুর প্রেসক্লাব চাঁদপুর পৌরসভার ভূমিদানে তৎকালীন স্ট্র্যান্ড রোড বর্তমান কবি নজরুল সড়কে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং সে কারণে ১৯৭৫ সালে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই নবতর যাত্রায় যিনি প্রেসক্লাবের প্রথম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বগ্রহণ করেন, তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান। তিনি ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আট বছরের অধিক টানা এই দায়িত্ব পালন করেন এবং চাঁদপুর প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণ সহ এই ক্লাবের সামগ্রিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন। আশির দশকে তিনি চাঁদপুর মহকুমা যখন জেলায় রূপান্তরিত হয় তখন থেকে বহুবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি, চাঁদপুর অন্ধ কল্যাণ সমিতি, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি (নাটাব) ইত্যাদি। তিনি অংকুর কচি-কাঁচার মেলাকে বাংলাদেশে একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে যান। এই মেলার নানা অনুষ্ঠানে তিনি মেলার প্রতিষ্ঠাতা, দেশখ্যাত শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সহ দেশের উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও মন্ত্রী- এমপিকে আনতে সক্ষম হন, যেটা স্থানীয় অন্য কোনো সংগঠনের পক্ষে ছিলো অসম্ভব। তিনি চাঁদপুর কলেজে শিক্ষকদের যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি এই কলেজের উন্নয়নে ও অগ্রযাত্রায় আন্তরিক ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি চাঁদপুর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি এই বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের উল্লেখযোগ্য সফলতা হচ্ছে, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দুজন যথাক্রমে চাঁদপুর সরকারি কলেজের ও সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান। এছাড়া আরো অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের যোগ্যতায় উত্তম অধিষ্ঠান নিশ্চিত করেন। তাঁর বড়ো ছেলে ফেরদৌস খানও বাবার মত শিক্ষক হয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শিক্ষকতা করছেন। চাঁদপুরে তাঁর স্ত্রী শিরিন হোসেনও ছিলেন একজন শিক্ষক। চাঁদপুর প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত উদয়ন শিশু বিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘ সময় সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, শিশু সংগঠক ও সমাজসেবক হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান যে খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেটা তাঁর সমকালীন অন্য কেউ করতে পারেননি। তিনি তাঁর এই খ্যাতি নিজের প্রায় ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এটা অনেকের জন্যে বিরল। তিনি চাঁদপুর কলেজের কোয়ার্টার, নিজের পিতার তালতলাস্থ বাসভবন এবং নিজের খরচে চাঁদপুর শহরের ব্যাংক কলোনীতে নির্মিত বাসভবনে সপরিবারে প্রায় ৫০ বছর বসবাসের পর অসুস্থতাজনিত কারণে ঢাকায় চলে যান। যার ফলে বিগত চার-পাঁচ বছরে চাঁদপুর শহরে তাঁর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। অনেকটা নিভৃতে আড়াল হয়ে যান। সাংবাদিকতার নতুন প্রজন্ম তাঁর সান্নিধ্য ও উপদেশনা থেকে বঞ্চিত হয় এবং অংকুর কচি-কাঁচার মেলা তার অর্জিত সক্রিয়তা হারায়। এরই মধ্যে হারিয়ে গেলেন তিনিও। একেবারে চিরতরে। মৃত্যুর নির্মম বাস্তবতায় প্রায় ৮০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে বারোটায় (২৭ নভেম্বর ২০২৪) ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
অবশেষে অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান চাঁদপুরে ফিরলেন। তবে অ্যাম্বুলেন্স যোগে নিজেকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে। চাঁদপুর প্রেসক্লাব তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় এবং তাঁর পেশাগত জীবনের প্রিয় কর্মস্থল চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে বুধবার বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয় চাঁদপুর শহরের পুরাণ বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন পৌর কবরস্থানে। আমরা চাঁদপুর জেলার সুপরিচিত ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খানের মৃত্যুতে চাঁদপুর জেলাবাসীর পক্ষে গভীর শোক জানাই এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই। মানুষ হিসেবে তিনি ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবে তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো মানুষ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এই পরিচিতি ও তাঁর জীবনের ভালো কাজগুলো মহান সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা কবুল করে তাঁকে পরকালে চির সুখের জান্নাত দান করুন, আমরা নিরন্তর সেই দোয়াই করছি।