প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৩, ১০:১১
জাগ্রত অতীত
প্রাথমিক গণিত শিক্ষার প্রথম ধাপই হলো এক অংক বিশিষ্ট সংখ্যার যোগ। শ্লেট-পেন্সিল দিয়ে তিন বা ততোধিক এক অংক বিশিষ্ট সংখ্যাকে নিচে নিচে বসিয়ে যোগ করতে বলা হতো। যত অংক ততটি দাগ সামনা-সামনি বসিয়ে মোট দাগ সংখ্যাই হতো যোগফল। এভাবে যোগের প্রাথমিক ধারণা ফলপ্রসূ হতো। যোগ না থাকলে তো বিয়োগ হবে না। তাই যোগের পরেই বিয়োগ শিখানো হতো। তেমনি গুণ এবং ভাগ পরস্পর বিপরীত। গণিত শিক্ষানবিসি পর্যায়ে আমি যার কাছে বেশি ঋণী তিনি আমার জননী। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আমার সবচেয়ে প্রিয় গণিত শিক্ষক মরহুম ফাজিলদ্দিন পণ্ডিত। মা যেমন খাওয়ায়ে উদরপূর্তি করাতেন, শিক্ষক মহোদয়ও তেমনি অংক শিক্ষার আকাক্সক্ষায় পরিপূর্ণ তৃপ্তি এনে দিতেন। তবু আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রান্তিক পরীক্ষায় শূন্য নম্বর পেলাম। কারণ জানতে এসে জানলাম এবং দেখলাম, আমি কোনো অংকেরই শেষ স্তরটি লিখি নাই। তাই শূন্য পেয়েছিলাম। ফলে ব্যথিত মনে জেগে উঠে তীব্র ক্ষোভ। পরবর্তীকালে অন্তত গণিতে শতকরা আশিভাগ নম্বর স্থির ছিল।
তারপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই পেলাম সংস্কৃত এবং গণিতের ওপর দক্ষ-বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ একজন পণ্ডিত ব্যক্তি জনাব রামচন্দ্র অধিকারীকে। যিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না যে, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে প্রত্যেক শ্রেণিতে আরবির পাশাপাশি সংস্কৃত বাধ্যতামূলক ছিল। বিষয়গুলোর সাহিত্যের সাথে ব্যাকরণও পড়তে হতো। পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রামচন্দ্র অধিকারী অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন এবং প্রতিদিন আসা-যাওয়ায় দশ মাইল পথ পদব্রজে হেঁটে এসে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ছিলেন বাস্তব অর্থেই ভার্সেটাইল জিনিয়াস।
তখন ওজন পরিমাপের একক ছিল মন-সের-ছটাক-তোলা ইত্যাদি আর দূরত্ব পরিমাপের একক ছিল মাইল-গজ-ফুট-ইঞ্চি ইত্যাদি (যা এখন মেট্রিক বা গ.ক.ঝ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত)। এগুলোর জন্য আর্যা মুখস্থ রাখতে হতো। যেটি শুভংকরের আর্যা নামে পরিচিত ছিল। তারপর সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে মহান গুণধর ব্যক্তিত্ব আমহেদ উল্লাহ বিএসসিকে পেয়েছিলাম, তিনি যে কত বড় মাপের গণিত শিক্ষক ছিলেন তা পরিমাপ করতে আমি সম্পূর্ণ অক্ষম।
তিনি ১৯৪৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেই শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। গণিত শাস্ত্রের মৌলিকত্ব পাটিগণিত এবং জ্যামিতির মধ্যে নিহিত আছে। এগুলোর কোনো জটিল সমস্যার সমাধান এলজাবরার অজ্ঞাত রাশি ব্যবহার করে নিষ্পত্তি করা হয়। পাটিগণিতীয় সরল অংক সমাধানের একটি সহজ সূত্র ইঙউগঅঝ আজও সংশ্লিষ্ট সর্বস্তরে সমাদৃত। এছাড়াও পাটিগণিতে ব্যজ-বাটা, স্টকশেয়ার এবং আরো অনেক জটিল সমস্যার অংক ছিল, যা তিনি নিমিষেই সমাধান করে দিতেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গঠিত ‘হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনে’র বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের দুর্বার আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র শিক্ষা বোর্ড ঢাকার আওতায় অনুষ্ঠিতব্য ১৯৬১ সালের মেট্রেকুলেশান পরীক্ষা ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক মহকুমা সদরে (বর্তমানে জেলা সদর) একটি মাত্র কেন্দ্রেই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তখন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা হতো মাত্র আটশত নম্বরের, যেমন : বাংলায় দুইশত, ইংরেজিতে দুইশত, অংকে একশত, ভূগোলে একশত, ইতিহাসে একশত, সংস্কৃত অথবা আরবিতে একশত। বাংলা ও ইংরেজি প্রথম পত্রে ষাট নম্বর ছিল গ্রামার+চল্লিশ নম্বর ছিল টেক্সট বই থেকে। দ্বিতীয় পত্রে পুরোটাই ছিল টেক্সট বই বহির্ভূত স্বকীয়তা নির্ভর। পরীক্ষার নির্দিষ্ট দিনের দুই-তিন দিন পূর্বে দূর-দূরান্ত থেকে ট্রাংকভর্তি জামা-কাপড়-বই-দোয়াত কলম নিয়ে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে হাজির হয়ে মহকুমা সদরকে জনারণ্যে পরিপূর্ণ করে দিত। ১৯৬২ সালেই বোধ হয় প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অপর্কীর্তি প্রবর্তিত হয়। এতে করে এক গ্রুপ ছাত্র অশেষ উপকৃত হয়, অপর দিকে একটি গ্রুপ সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়। ঢাকা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত প্রবেশপত্রে আমার রোল নম্বর ছিল ৩৩৬। কেন্দ্র সিডিউল অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে হয়েছে চাঁদপুর কলেজ গ্যালারীতে। পরীক্ষা প্রস্তুতির পর্ব পূর্ব রাত্রিতেই হুবহু শেষ। পরীক্ষার হলটি ছিল শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষের জেনেও না জানার ভান, দেখেও না দেখার ভান--এ যেন ভানু মতির খেইল। ভগ্ন চিত্তে নিরুৎসাহিত মনে পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই পরদিন সকাল ৯টার ট্রেনে মধুরোড় হয়ে বাড়ি চলে আসলাম। তখনও কিন্তু চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কে বাস চলাচল আরম্ভ হয়নি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিলাম যে, পরীক্ষাটা বাতিল হবে কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। যথারীতি পত্রিকায় পরীক্ষার ফলাফল বের হল। আমি উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। আমার প্রাণাধিক প্রিয় শিক্ষক বলে উঠলেন, ‘তোর ফেল করা ভালো ছিল’। এরপর কলেজ ভর্তির পালা। আমার অগ্রজের হাত ধরে চাঁদপুর কলেজে ভর্তির জন্যে ট্রেনযোগে চাঁদপুর যাই। আমরা সোজা চলে গেলাম কলেজে। তখন কলেজে ঢোকার পথ ছিল মূল ভবনের ঠিক মাঝে উত্তর-দক্ষিণে সোজাসুজি রাস্তা। কলেজে ঢুকেই বাঁ-হাতি ছিল শিক্ষকদের বিশ্রামাগার। ছাত্র ভর্তি করার চার্জে ছিলেন সুন্দর-গম্ভীর-শান্ত চেহারার একজন অধ্যাপক। তিনি গণিত বিভাগের একমাত্র অধ্যাপক যোগেন্দ্র চন্দ্র সরকার। ওনার প্রশ্নের উত্তর গুলো আমি দুরু দুরু বক্ষে দিয়েছিলাম। পাশে বসা ছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আঃ রশিদ সাহেব। তাঁর প্রশ্নছিল অষষ ঃযধঃ মষরঃঃবৎং রং/ধৎব হড়ঃ মড়ষফ কোনটি শুদ্ধ? উত্তরে তিনি খুশি হয়ে বলেছিলেন এবার সেকশানে গিয়ে ভর্তি ফরম পূরণ কর। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির জন্য শ্রদ্ধেয় যোগেন্দ্র চন্দ্র সরকার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। ভর্তির কিছুদিন পর বুঝলাম আমার পূর্ববর্তী গণিত শিক্ষকগণের আদলে গড়া এই মহৎপ্রাণ গণিতের শিক্ষক। তখন গণিত বিভাগে একমাত্র শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক যোগেন্দ্র সরকার। পদার্থ এবং রসায়ন বিভাগেও মাত্র একজন করে শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে অধ্যাপক ইউনুছ মিয়া এবং অধ্যাপক আঃ মান্নান। পরে যোগ দেন গণিতের অধ্যাপক রনজিত নাহা, পদার্থ বিজ্ঞানে অধ্যাপক হাসান হায়দার এবং রসায়ন বিভাগে অত্যন্ত সু-দর্শন একজন অধ্যাপক যোগ দেন, তাঁকে আমরা প্রিন্স স্যার বলে ডাকতাম। পরে ওনি ঈঝচ করে চলে যান (দুঃখিত ওনার নামটা আমার বিস্মৃত)।
সে সময় চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম উদ্দিন। উপাধ্যক্ষ ছিলেন দবির উদ্দিন আহমেদ। ইংরেজি বিভাগে ছিলেন অধ্যাপক এস.এন. রায় এবং অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। বাংলা বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক ছিলেন সৈয়দ আব্দুছ ছাত্তার। চাঁদপুর কলেজটি জন্মলগ্ন থেকেই উত্থান উন্মুখ, কখনো পতনোন্মুখ হয়নি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহিতা শুধুই কথার কথা, কিন্তু চাঁদপুর সরকারি কলেজের ঐতিহ্যবাহিতা বাস্তবিকই অর্থবহ।
শিক্ষা জীবনের যাদের সাহচর্য, আন্তরিকতা-বন্ধুত্ব-এবং সহমর্মিতার স্নিগ্ধতায় সিক্ত হয়েছিলাম অনতিক্রান্ত বৃত্তে আমি শুধুই তাদের অবয়বই নিরন্তর খুঁজে বেড়াই। কিন্তু হায়! আজ কোথায় বাবুলাল কর্মকার-কালীধন পাল-ননী গোপাল দে-খলিলুর রহমান-তপন চক্রবর্তী প্রমুখ। আজ তারা স্মৃতির কুঠুরীতে চির নিদ্রায় ঘুমন্ত। হে অতীত! তুমি কথা বল-আমাকে শান্ত কর।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।