প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২১, ১২:০৭
মিষ্টির কথা
আকাশের এই বিশালতায়, কোনো এক টুকরো মেঘের ছায়ায় স্থান করে নিয়েছিলো মিষ্টি। আপন জননী ছিলো না তার। পিতাও এই আছে তো এই নেই, ঠিক কর্পুরের মতো। যখন তার বয়স ২ বছরে পা দিবে, ঠিক তখনই তার পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যায়। পিতা-মাতার মতোই মিষ্টির সুখগুলো ও আলাদা হয়ে যায় তার থেকে।
মিষ্টি বেড়ে উঠছিলো তার জেঠিমার কাছে। যদিও তার জেঠিমার তাকে বোঝা মনে হতো, তবুও লোকলজ্জার ভয়ে তাকে নিজের ঘরে ঠাঁই দিলো। জেঠিমার ছিলো দুইটি মেয়ে নিপা ও রুপা। নিপা ছিলো বড় মেয়ে আর রুপা ছিলো মিষ্টির থেকে এক বছরের ছোট। নিপা ও রুপা দুজনেই খুব সুন্দরী ছিলো। এজন্যে তাদের দুজনের খুব অহঙ্কার ছিলো। তারা মিষ্টিকে সহ্য করতে পারতো না। মিষ্টি তাদের বোন হিসেবেই জানতো, কিন্তু ওরা তাকে খুব কষ্ট দিতো। মিষ্টি বড় দুই বোনের মতো জেঠিমাকে মা বলে ডাকতো। এর জন্যে রুপা তাকে মেরে হাত ফুলিয়ে দিয়েছিলো। ছোট্ট মেয়ে মিষ্টিকে দিয়ে তার জেঠিমা নিপা ও রুপার সব কাজ করাতো। চুপ করে সবকিছু মেনে নিতো মিষ্টি। মিষ্টির খাবার নিয়েও হিংসে করতো তার দুই বোন। নিপা এতোটাই হিংসা করতো যে, সে মাঝে মাঝে খাবার খেয়ে মিষ্টির উপর দোষ চাপিয়ে দিতো। তখন জেঠিমা মিষ্টিকে অনেক অনেক মারতো। আর সেটা দেখে আনন্দ পেতো নিপা আর রুপা।
নিপা ছিলো বয়সে বড়, তাই সে সব খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতো। সে মিষ্টিকে তুচ্ছ করার আশায় তার জন্যে একটা কবিতা লিখেছিলো, যা সে মিষ্টিকে সারাদিন পড়ে শোনাতো। কবিতাটি এমন, ‘সারাদিন শুধু করো শুধু খাই খাই/প্রথমত মুড়ি, তারপরে ভাত।/তারপরে মুড়ি, তারপরে ভাত।’ এভাবে সারাদিন খোঁটা দিতো মিষ্টিকে। মিষ্টি ছোট ছিলো বলে এগুলোর মানেও বুঝতো না।
এভাবেই দুঃখের সাথে দিন কাটতে থাকে মিষ্টির। অবশেষে নিপার বিয়ে হয়ে যায় এবং সে তার শশুর বাড়িতে চলে যায়। নিপার শশুর বাড়ি যাওয়ার পর মিষ্টির কষ্ট কিছুটা লোপ পেয়েছে। কিন্তু রুপা মিষ্টিকে কষ্ট দিতে একটা সুযোগ ও হাতছাড়া করতো না।
একদিন সকাল বেলা জেঠিমা এবং রুপা বাজারে যাচ্ছিলো। তখন মিষ্টি তাদের সাথে যাওয়ার জন্যে কান্না শুরু করে। কিন্তু তারা মিষ্টিকে নিয়ে যায়নি। মিষ্টি তখন তাদের অনুসরণ করে তাদের পিছনে ছুটতে থাকে। তারপরও তারা মিষ্টিকে নিয়ে যায়নি। মিষ্টি তাদের পিছনে ছুটতেই থাকে। আশপাশের মানুষজন এই দৃশ্য দেখছিলো এবং আফসোস করছিলো। ছুটতে ছুটতে মিষ্টি এক পর্যায়ে দেখলো জেঠিমা এবং রুপাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে এবার বাড়ি ফিরবে কি করে। সে তো পথ ভুলে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টি একটা দোকানের কাছে গেলো। অতিরিক্ত হাঁটার কারণে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আশপাশে থাকা লোকজন তাকে ধরে একটি টেবিলে শুইয়ে দেয় এবং তার চোখে মুখে পানি ছিটাতে থাকে। আসলে সে না খেয়ে থাকার কারণেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। অবশেষে মিষ্টির জ্ঞান ফিরে আসে। তাকে সবাই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মিষ্টি নিজের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি। তখন দোকানী মিষ্টিকে কিছু খেতে দিলো। সে পথ ভুলে যাওয়ায় দোকানের সামনেই বসে ছিলো। এভাবে সারাদিন কেটে গেলো, কেউ মিষ্টিকে খুঁজতে এলো না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলো কেউ মিষ্টিকে খুঁজতে এলো না। মিষ্টি তখনও সেই দোকানের সামনে বসে ছিলো জেঠিমার আশায়। একজন লোক সকাল থেকেই মিষ্টির উপর নজর রাখছেন। কেউ এলো না দেখে তিনি মিষ্টির কাছে গিয়ে বললেন তার সাথে যাওয়ার জন্যে। মিষ্টিও তার সাথে যেতে রাজি হলো।
মিষ্টিকে এক লোক তার বাড়িতে নিয়ে গেলো। লোকটির স্ত্রী মিষ্টিকে দেখে খুব আনন্দিত হলো। তিনি মিষ্টিকে খুব আদর করলেন। মিষ্টি এখন পর্যন্ত এতো আদর কখনও পায়নি। সে খুব আনন্দ পেলো। মিষ্টি পেলো এক নতুন পরিবার। যারা মিষ্টিকে নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। মিষ্টি তাদের বাবা-মা হিসেবে মেনে নেয়। এভাবেই মিষ্টির জীবন সুখে শান্তিতে কাটতে থাকে।