প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:২৯
পৃথিবী যখন ডুবছে, বাংলাদেশ তখন নতুন ভূমি অর্জন করছে—এ বিস্ময় কি প্রকৃতির দান, নাকি মানুষের সাফল্য?
প্রকৃতির খেয়াল নাকি মানুষের কেরামতি
![প্রকৃতির খেয়াল নাকি মানুষের কেরামতি](/assets/news_photos/2025/02/15/image-58943-1739626266bdjournal.jpg)
যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মালদ্বীপ, টুভালুর মতো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, তখন বাংলাদেশের মানচিত্রে যোগ হচ্ছে নতুন ভূমি। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বহু দেশের উপকূল ডুবে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিবছর নতুন নতুন চর, দ্বীপ এবং ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নিজের আয়তন বাড়িয়ে চলেছে।
|আরো খবর
এটি কি নিছক প্রকৃতির দান, নাকি মানুষের পরিকল্পিত উদ্যোগের সুফল? কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এই বিস্ময়কর পরিবর্তন? চলুন, খতিয়ে দেখা যাক।
ভূখণ্ড বৃদ্ধির রহস্য: প্রকৃতি ও মানুষের সম্মিলিত অবদান
বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে, তবে ভূতাত্ত্বিকভাবে এই বদ্বীপ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গড়ে উঠেছে। হিমালয় থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পলি বয়ে আনে, যা বঙ্গোপসাগরে জমে তৈরি হয় নতুন ভূমি। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাগ্রেডেশন (Aggradation), যার ফলে প্রতি বছর গড়ে ১০-২০ বর্গ কিলোমিটার নতুন জমি সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, প্রতিনিয়ত নদীগুলোর তীব্র স্রোত ও ভাঙনের কারণে কিছু জমি বিলীনও হয়। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের ভূমি বৃদ্ধির হার ভূমি ক্ষয়ের তুলনায় বেশি।
সংখ্যার ভাষায় বাংলাদেশের ভূখণ্ড বৃদ্ধি
১৯৭১ সালে আয়তন: ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার।২০২৫ সালে আয়তন: ১,৪৮,৪৬০ বর্গ কিলোমিটার।
নতুন ভূমি যুক্ত হয়েছে: প্রায় ৮৯০ বর্গ কিলোমিটার।
প্রতিবছর গড়ে নতুন ভূমি: ১০-২০ বর্গ কিলোমিটার।
আগামী ৫০ বছরে সম্ভাব্য আয়তন: ১,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার (প্রায় ঢাকা জেলার সমান নতুন ভূমি)
সরকারি উদ্যোগ ও পরিকল্পনা
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীর মোহনায় নতুন ভূমি গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ হলো—
চর উন্নয়ন প্রকল্প: নবগঠিত চরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ও কৃষি সম্প্রসারণ।
বনায়ন কর্মসূচি: উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন (যেমন সুন্দরবন) বৃদ্ধি করে ভূমি স্থিতিশীল করা।
বাঁধ নির্মাণ: নদীর তীর সংরক্ষণ ও ভাঙন রোধে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে।
নতুন জমির ব্যবস্থাপনা: চরের ভূমিগুলোকে পরিকল্পিতভাবে কৃষি ও বসবাস উপযোগী করা।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অনন্যতা
বিশ্বজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বহু দেশ ভূখণ্ড হারাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ নতুন ভূমি অর্জন করছে।মালদ্বীপ: ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটির প্রায় ৮০% এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
টুভালু: ইতোমধ্যে দেশটি তার বেশ কিছু ভূখণ্ড হারিয়েছে এবং ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
নেদারল্যান্ডস: দেশটির এক-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে, যেখানে বাঁধ ও জলপ্রকল্পের মাধ্যমে টিকে থাকার লড়াই চলছে।
এ পরিস্থিতির বিপরীতে বাংলাদেশ ভূমি অর্জন করে একটি নজির সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র ভূমি বৃদ্ধি পেলেই হবে না, বরং নতুন অর্জিত এই জমিগুলোকে টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুল ইসলাম বলেন "বাংলাদেশের উপকূলে নতুন জমি তৈরি হলেও, এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পিত বনায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উপকূলীয় এলাকার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা না গেলে, এ ভূখণ্ড খুব বেশি কাজে আসবে না।"
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
বাংলাদেশের ভূখণ্ড বৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—
১. নদীভাঙন: নতুন ভূমির পাশাপাশি কিছু জায়গায় জমি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
২. লবণাক্ততা: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নতুন জমিগুলো কৃষির উপযোগী রাখা কঠিন হতে পারে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন: দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে নতুন হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সুপারিশসমূহ—
✅ বনায়ন ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
✅ নদী ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি।
✅ নতুন চরগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
✅ অবৈধ দখল ও ভূমির অপব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ভূখণ্ড হারাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ নতুন জমি অর্জন করছে। এটি নিছক প্রকৃতির অবদান নয়, বরং বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলাফল। তবে, নতুন অর্জিত ভূমিগুলোকে টেকসই ব্যবস্থাপনায় আনতে না পারলে, এ সাফল্য ধরে রাখা কঠিন হবে।
বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরল সম্ভাবনা, তবে তা কাজে লাগাতে হলে এখনই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নতুন করে অর্জিত ভূখণ্ডও ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদন:মো. জাকির হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি
দৈনিক চাঁদপুর কন্ঠ।
ডিসিকে/এমজেডএইচ