প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:০৮
সরিয়ে দেয়া হলো নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ জনস্বার্থে বাতিল করা হয়েছে বলে বুধবার (১৮ অক্টোবর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
|আরো খবর
২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী তিন বছরের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। সেই হিসাবে এই পদে তার ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করায় এক বছরের বেশি সময় আগেই তাকে এই পদ ছাড়তে হচ্ছে। নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর নানান পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় ছিলেন মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী।
পরিবেশবিদ ও গবেষকদের আপত্তির মুখে গত ২৫ সেপ্টেম্বর দেশে নদনদীর তালিকা প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এই তালিকায় নদনদীর সংখ্যা এক হাজার ৮টি; দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, নদনদীর যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে, সেটি ভুলে ভরা। অনেক নদীর ক্ষেত্রে উৎসমুখ, উৎপত্তিস্থল, গতিপথ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা উল্লেখ করা হয়নি। একই নদীর নাম এসেছে একাধিকবার। আবার কোথাও কোথাও এলাকার নামকে নদীর নাম বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র জলাশয়কেও নদী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তত ৫৫টি নদীর ক্ষেত্রে উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য ভুল লেখা হয়েছে। আবার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অসংখ্য নদী। মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী একজন কীটতত্ত্ববিদ। বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না।
নদী রক্ষা কমিশনের প্রস্তুত করা খসড়া তালিকার তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নদ-নদী সিলেট বিভাগে। এ বিভাগের চারটি জেলায় নদীর সংখ্যা ১৫৭। সবচেয়ে কম নদী চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে নদীর সংখ্যা ৬২। নদ-নদীর সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ। এ দুই বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ১৪৫ ও ১২৭। এরপর নদ-নদীর সংখ্যা বেশি ঢাকা বিভাগে, ১২৫টি। তারপর রংপুর বিভাগে ১১৯টি। বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ১০০ ও ৭২।
তবে এ তালিকায় প্রকাশিত নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে আপত্তি রয়েছে নদী গবেষকদের। তারা বলছেন, দেশে নদ-নদী রয়েছে দেড় হাজারের বেশি। কিন্তু এনআরসিসির তালিকায় তা নেমে এসেছে হাজারেরও নিচে। আবার সরকারি অন্যান্য তালিকার সঙ্গেও এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন অসামঞ্জস্য নিয়ে এটি প্রকাশিত হলে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে জটিলতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তালিকায় অসামঞ্জস্যের বিষয়টি স্বীকার করছেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও। এনআরসিসির খসড়া তালিকায় অসংগতি থাকা অস্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দেশে নদ-নদীর সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হবে। নদী রক্ষা কমিশনের গবেষণাকাজের এরিয়া হয়তো এ নদ-নদীগুলো নিয়ে ছিল। নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে সংরক্ষিত আছে। আমরা ভিন্ন একটি প্রজেক্ট নিয়েছি—সারা দেশের নদ-নদী উদ্ধার ও নাব্যতা নিয়ে। এ কাজ সমাপ্ত হলে আমরা নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা পেয়ে যাব।’
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই দেশে নদ-নদীর সংখ্যা আরো বেশি হবে। শুধু সুন্দরবনেই নদী আছে ২১৮টি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় কয়টা নদী আছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। এ সংখ্যা নদীর প্রকৃত সংখ্যা না-ও হতে পারে। আমরা বাংলাদেশের পুরনোসহ সবগুলো নদী ম্যাপ ধরে উদ্ধারের কাজ শুরু করেছি। এটা আমরা করব মৌজা ম্যাপ ধরে।’
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বক্তব্যে সুন্দরবনে ২১৮টি নদীর কথা বলা হলেও এনআরসিসির খসড়া তালিকায় পুরো খুলনা বিভাগেই নদী দেখানো হয়েছে ১২৭টি।
দেশে ৪০৫টি নদ-নদী নিয়ে ২০১১ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ নিয়ে ছয় খণ্ডের বইও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। ওই ৪০৫ নদ-নদীর মধ্যে ১৩৯টিই এনআরসিসির খসড়া থেকে বাদ পড়েছে। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ওই সিরিজের সঙ্গে এনআরসিসির খসড়া তালিকার নদ-নদীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল আছে বলে দাবি করেছে নদীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পাউবোর সমীক্ষার অন্তত ১৩৯টি নদীর নাম এনআরসিসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের আমরি, ইসদার, উমিয়াম, কর্ণঝরা, কর্ণবালজা, কাঁচামাটিয়াসহ ২৭টি নদীর নাম তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগের ১৬টি, রংপুরের ১০, ময়মনসিংহের ২৭, বরিশালের সাত, ঢাকার ৩০, চট্টগ্রামের ১২ ও খুলনা বিভাগের ১০টি নদী তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনআরসিসি নদীর তালিকা প্রকাশ করলে এটি একটি সরকারি দলিল হয়ে যাবে। সংস্থাটি দেশের সব নদ-নদীর তালিকা প্রকাশ করছে দাবি করলে বলতে হয়, সেখানে সরকারি হিসাবেরই অনেক নদীর নাম বাদ পড়েছে। আমরা পাউবোর ৪০৫ নদীর মধ্যে ১৩৯টির নাম পাইনি। জেলা তথ্য বাতায়ন, নদী গবেষক, বিভিন্ন গবেষণা পত্রের তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত নদীর সংখ্যা আরো বেশি। পাউবোর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ মো, ইনামুল হকের বাংলাদেশের নদ-নদী বইয়ে ১ হাজার ২১৬টি নদীর মানচিত্র ও তালিকা দেয়া আছে। আমাদের দাবি হলো, অবশ্যই সরকারি-বেসরকারি এসব তথ্য বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হোক। নয়তো এ তালিকার বাইরে যেসব শত শত নদী থাকবে, সেগুলো অচিরেই দখলদারদের কবলে পড়ে হারিয়ে যাবে। তাহলে তা হবে নদীর সঙ্গে করা এক মারাত্মক অন্যায়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাউবো ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদীর যে তালিকা দিয়েছে, সে তালিকার সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার নদীর তালিকার অসামঞ্জস্য থাকায় আদালত নির্দেশ দিয়েছেন সব সংস্থাকে মিলে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে। নদী রক্ষা কমিশন ডিসিদের থেকে নদীর যে তালিকা এনেছে, তা কোনো অবস্থায়ই সম্পূর্ণ নয়, সঠিকও নয়। এখানে একক কোনো সংস্থার উদ্যোগে নয়, বরং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা মিলে একযোগে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যেই যদি অসামঞ্জস্য থাকে তাহলে আমরা এখানে সমন্বয়ের চূড়ান্ত অভাব দেখতে পাচ্ছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা তালিকাটি চূড়ান্ত করে ফেলেছি। আগামী ২৪ তারিখে এটি প্রকাশ করব। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর একজন ১০৫টি নদীর তালিকা দিয়েছিল, সেখানে অনেক খালকে নদী দেখানো হয়েছে। আমরা সেগুলোও নিষ্পত্তি করে ফেলেছি।’
অনেক নদ-নদীর নাম বাদ পড়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি মিথ্যা অভিযোগ। যারা এসব বলে তারা তালিকাগুলো পড়ে দেখেনি।’
সূত্র : ইন্টারনেট।