প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:০৮
ডেঙ্গু : ‘নেগেটিভ’ রিপোর্টেও ভয়াবহ ঝুঁকি
দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। পরিস্থিতি যেন অনেকটাই মহামারির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগীর চাপ। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করলেও কিছুতেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর।
|আরো খবর
চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। সেই সঙ্গে রোগীর অতিরিক্ত চাপে নাকাল হচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এসবের মধ্যেই নতুন করে আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরীক্ষায় রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও লক্ষণ সব ডেঙ্গুর মতোই। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে নেগেটিভ রোগীদেরও ডেঙ্গুর ‘ট্রিটমেন্ট প্রটোকল’ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে।
নেগেটিভ রিপোর্টে ক্ষুব্ধ রোগী-স্বজনরা
গত ৮ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে জ্বরে আক্রান্ত মো. মওদুদ আহমেদ। পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিভিন্ন উপসর্গও তার মধ্যে দেখা দেয়। এ অবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার এইমস হাসপাতালে গিয়ে এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করান। রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। আবারও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মধ্য বাড্ডা এলাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে গিয়ে পুনরায় এনএস-১ অ্যান্টিজেনের পাশাপাশি আইজিএম টেস্টও করান। এবার তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে।
বিভিন্ন সংবাদ ও টেলিভিশনে এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্টের বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমে ডেঙ্গু নেগেটিভ হয়েও পরবর্তীতে পজিটিভ আসায় অনেকটা অবাক ও ক্ষুব্ধ হন তিনি। ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রথম যে হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছি, সেখানে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। পরে অন্য হাসপাতালে গিয়ে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। এখন আমি যদি প্রথম রিপোর্টে ভরসা করে বাসায় বসে থাকতাম এবং চিকিৎসা না নিতাম, তাহলে তো নিশ্চিত আমার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটতে পারত।’
‘এমন তো নয় যে আমি তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিনি। তারপরও কেন এনএস-১ পরীক্ষায় নেগেটিভ আসল। এটি খুঁজে বের করা এবং করণীয় নির্ধারণ করা খুবই জরুরি।’ শুধু মওদুদ আহমেদ নন, এমন অভিযোগ আরও অনেক রোগীর। এমনকি, ডেঙ্গু আক্রান্ত নন— এমনটি ধরে বাসায় নির্বিকার থাকছেন অসংখ্য রোগী। পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকদেরও করার কিছু থাকছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এইমস হাসপাতালের এক মেডিকেল অফিসার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইদানিং শুধু এনএস-১ পরীক্ষায় ডেঙ্গুর সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। অসংখ্য রোগীর এনএস-১ পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে, কিন্তু ডেঙ্গু আইজিএম বা আইজিজি পরীক্ষার পর রিপোর্ট পজিটিভ আসছে।
‘আমরা নিজেরা যেসব রোগীকে শুরুতে দেখছি, তাদের প্রত্যেককেই এনএস-১ পরীক্ষার পাশাপাশি সিবিসি বা আইজিএম-আইজিজি পরীক্ষা করাতে বলছি। এরপর ডেঙ্গু নিশ্চিত হয়ে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু, কিছু রোগী সরাসরি চিকিৎসক না দেখিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো এনএস-১ পরীক্ষা করান। সেই রিপোর্টে কোনো কারণে ডেঙ্গু পজিটিভ না এসে নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।’
এনএস-১ পরীক্ষায় কেন ডেঙ্গু নেগেটিভ আসছে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (এনআইএলএমআরসি) ভাইরোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্টে পজিটিভ আসে যদি জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু, কেউ যদি চার-পাঁচ দিন পর আসেন, তাহলে তাকে আমরা ডেঙ্গু আইজিএম পরীক্ষাটি করতে বলি। এরপর যেটা দেখা যায়, এনএস-১ নেগেটিভ আসা অনেকেরই আবার ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। ‘কেন এমনটি হচ্ছে— বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য স্বল্প পরিসরে আমরা কিছু সেরোটাইপ করেছি। যেখানে দেখা গেছে, এনএস-১ নেগেটিভ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় প্লাটিলেট কাউন্ট কম ছিল বা পরবর্তীতে আইজিএম পরীক্ষার মাধ্যমে পজিটিভ এসেছে।’
‘যখন আমরা সেরোটাইপিং করি, তখন দেখেছি যেসব রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল সেগুলোর অধিকাংশই ডেন-২ এ আক্রান্ত। অর্থাৎ যারা ডেঙ্গুর ডেন-২ এ আক্রান্ত হয়েছেন, এনএস-১ পরীক্ষায় তাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে।’
এ ভাইরোলজিস্ট বলেন, পরীক্ষা করার জন্য আমরা যে ডিভাইসগুলো ব্যবহার করি, আমাদের বডিতে যে স্ট্রেইনগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর বিপরীতে ডিভাইসগুলো ডিজাইন করা। এখন যেহেতু ডেঙ্গু মিউটেশন হয়ে তার স্ট্রাকচার পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাই আগের ডিভাইসগুলো মাঝেমধ্যে নতুন স্ট্রাকচারটি ধরতে পারছে না। যে কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে।
ডা. আরিফা আকরাম আরও বলেন, এ সেরোটাইপটি আমরা স্বল্প পরিসরে করেছি। আমি মনে করি, এটি নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ হওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সিকোয়েন্সিংয়ের একটি প্রজেক্ট জমা দিয়েছি। বিষয় হলো বড় আকারে কাজ করতে গেলে বিশাল একটি ফান্ডের প্রয়োজন।
‘কারণ, আমরা যদি ২৪/২৫টি স্যাম্পলও সিকুয়েন্স করি, অল্প অল্প রিয়েজেন্ট কেনা যায় না, আবার একসঙ্গে কিনতে হলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। বিষয়টি নিয়ে যদি বিস্তর কাজ করতে পারি, তাহলে বলতে পারব যে, এখানে কোনো চেঞ্জ আসছে কি না, ভাইরাসের স্ট্রাকচারে মিউটেশন হয়েছে কি না বা নতুন কোনো সেরোটাইপ কি না।’ ভুল রিপোর্ট আসতেই পারে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, এনএস-১ পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসতেই পারে। এ টেস্টে ৭০ শতাংশের মতো ঠিকঠাক রিপোর্ট আসে। বাকি ৩০ শতাংশ নেগেটিভ আসতেই পারে। এ ছাড়া, কততম দিনের মাথায় পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটিও অনেকাংশে নির্ভর করে। কেউ যদি চার দিন পর এনএস-১ পরীক্ষা করেন, তার নেগেটিভ আসবে— এটিই স্বাভাবিক। এজন্য আরও কিছু পরীক্ষা করে ডায়াগনসিস করতে হয়। এজন্য অন্যান্য ব্লাডের প্যারামিটার যেগুলো আছে সেগুলো দেখেও ডেঙ্গু ডায়াগনসিস করতে হয়। বিশেষ করে ব্লাডের টোটাল কাউন্ট, প্লাটিলেট কাউন্ট, হেমাটোক্রিট— এগুলোর অনেক কিছু দেখে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হয়।
ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। যেহেতু এটি আরএনএ ভাইরাস, সেহেতু এর মিউটেশন হওয়া খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে মিউটেশন হয়ে যদি ভাইরাসটি তার ক্যারেক্টার চেঞ্জ করে ফেলে, তাহলেও পরীক্ষায় নেগেটিভ আসতে পারে। এমন আরও অনেক কারণ আছে, যার কারণে রিপোর্ট নেগেটিভ আসতে পারে।
‘প্রয়োজনে শুধু এনএস-১ পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য পরীক্ষারও প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে কোন রোগীর কোন পরীক্ষা লাগবে, সেটি রোগীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর না করে চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখতে হবে। তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।’
ডেঙ্গু আক্রান্তের সন্দেহ হলে কোন টেস্ট করাতে হবে
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সাধারণত ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা, সিবিসি (প্লাটিলেট কাউন্টসহ) পরীক্ষা করাই যথেষ্ট। তবে, রোগীর অবস্থা জটিল হলে বা রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দিলে আরও কিছু টেস্ট করানো দরকার হয়।
এনএস-১ : কেউ ডেঙ্গু পজিটিভ কি না, সেটি এনএস-১ টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়। তবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার শুরুর দিকেই এ পরীক্ষা করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, জ্বরের প্রথম দিন থেকেই ডেঙ্গু এনএস-১ টেস্টের ফল পজিটিভ আসে। তবে, চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে হলে এটি নেগেটিভ হয়ে যায়। তাই চিকিৎসকরা সাধারণত টেস্টের ফলের সঙ্গে অন্য উপসর্গ ও লক্ষণ মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেন।
আইজিএম বা আইজিজি : আইজিএম বা আইজিজি পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু আরও ভালোভাবে শনাক্ত করা যায়। এ বিষয়ে সিডিসি বলছে, সাধারণত জ্বর হয়ে যাওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলে এবং এর মধ্যে কোনো পরীক্ষা না করা হলে আইজিজি পরীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে পজিটিভ কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
রক্তে আইজিজি পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে আগে রোগীর সংক্রমণ ছিল। শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু আছে, সেটি বোঝার জন্যও এ পরীক্ষা করা হয়। আইজিজি সূচক স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে শরীর যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করতে অক্ষম এবং সেক্ষেত্রে সংক্রমণে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর রক্তে আইজিজি পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে আগে রোগীর সংক্রমণ ছিল এবং বর্তমানে সে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে।
তবে, একদিক দিয়ে এনএস-১ এর সঙ্গে আইজিজির মিল রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে এ পরীক্ষার ফলও নেগেটিভ আসতে পারে। সাধারণত, জ্বর ৯ থেকে ১০ দিন পার হলে এ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে।
সিবিসি : রোগ সম্পর্কে বেসিক ধারণার জন্য সিবিসি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত একটি সামগ্রিক রক্ত পরীক্ষা। এর মধ্যে রক্তের প্লাটিলেট কাউন্টসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এ টেস্টের মাধ্যমে রক্তের প্রয়োজনীয় কোষীয় উপাদানের ঘনত্বের পরিমাপের পাশাপাশি শরীরে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তাও পর্যালোচনা করা হয়। অর্থাৎ রোগী কোনো সংক্রমণের শিকার হয়েছে কি না, রক্তকণিকা স্বাভাবিক রয়েছে কি না বা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন— এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝার জন্য চিকিৎসকরা এ টেস্ট দিয়ে থাকেন।
এ বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ৮৩৯ জনের : চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ৮৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া, এক লাখ ৭০ হাজার ৭৬৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০ হাজার ৩২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে তিন হাজার ৮৬১ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ছয় হাজার ১৭১ রোগী ভর্তি আছেন।