শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

কেনো এত মৃত্যু, কেনো এত লাশ? অনুসন্ধান-০২

ডিউটি অফিসার বলেন অক্সিজেন নেই, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন আছে ॥ রোগীরা যাবে কোথায়?

ডিউটি অফিসার বলেন অক্সিজেন নেই, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন আছে ॥ রোগীরা যাবে কোথায়?
রাসেল হাসান ॥

প্রতিদিনই চাঁদপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। করোনা ওয়ার্ডে আসন নেই তবুও মেঝেতে বিছানা করে সেবা নিতে উপজেলা থেকে ছুটে আসছেন অসহায় মানুষ। হাসপাতালে পৌঁছতে দেরি করছেন যারা, তারা বাড়ি ফিরছেন লাশ হয়ে। প্রশ্ন হলো, সবাইকে যদি জেলা সদর হাসপাতালেই আসতে হবে তবে উপজেলা হাসপাতালগুলোর কাজ কী? কেনইবা খোলা হলো সেখানে করোনা ওয়ার্ড? উপজেলা হাসপাতালে অক্সিজেন বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ কেন অক্সিজেনের জন্যে স্বেচ্ছাসেবীদের হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালায় চাঁদপুর কণ্ঠ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতই পাওয়া যায় অবাক করা চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের পর্বে থাকছে অনুসন্ধান -০২।

প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আগে জানতে হবে প্রতিটি লাশের ‘লাশ’ হওয়ার পেছনের গল্প। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন উপজেলা থেকে চাঁদপুর জেলা সদরস্থ জেনারেল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশের পিছু নিয়েছে চাঁদপুর কণ্ঠ। জানার চেষ্টা করেছে কোথায় কীভাবে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন স্বজনরা।

৮ আগস্ট বিকেল ৫টায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান ফরিদগঞ্জ বিশকাটালী গ্রামের আব্দুস ছালাম মাল। কথা হয় তার জামাতা মফিজুর রহমানের সাথে। আব্দুর ছালাম মালের জ্বর সর্দি ছিলো বেশ ক’দিন। বাড়ি ফরিদগঞ্জ হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার কারণে মৃত্যুর আগের দিন শনিবার শ্বাসকষ্টে ভোগা শ্বশুরকে নিয়ে হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান তিনি। হাসপাতালের বারান্দায় ভিক্ষুকের মত হাত জোড় করে বলেছিলেন ‘স্যার আমার শ্বশুরকে একটু ভর্তি করান না।’ কর্মরত চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন ইমার্জেন্সি রুম থেকে জানালেন, হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। রোগী রাখা যাবে না। চাঁদপুর সদরে নিয়ে যান।

অসুস্থ শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসলেন মফিজুর রহমান। বাজারের এক বড় ভাইকে সব কিছু খুলে বললেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, হাসপাতালের ভিতরে একজন ডাক্তার প্রাইভেটভাবে রোগী দেখেন। ভিজিট কেটে তাকে দেখান, উপকার পাবেন। যেই কথা সেই কাজ। ১০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালের ভেতরে পৃথক একটি রুমে অসুস্থ শ্বশুরকে নিয়ে প্রবেশ করেই চমকে উঠলেন মফিজুর রহমান। যে ডাক্তার প্রাইভেটভাবে ভিজিট কেটে রোগী দেখছেন তিনিই ইমার্জেন্সি কক্ষে ডিউটি করা ডাঃ আব্দুল্লাহ আল-মামুন! মফিজুর রহমানকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন চিকিৎসক। বললেন, আপনি এখনো যাননি চাঁদপুরে? তাড়াতাড়ি নিয়ে যান। আব্দুস ছালাম জোরে জোরে দম টেনে বলেছিলেন, ‘স্যারগো আমার দম নিতে কষ্ট হয়। হাসপাতালেত্তেন একটু অক্সিজেন দেন না।’ দয়া হয়নি চিকিৎসকের। শেষ পর্যন্ত অক্সিজেন না পেয়ে রওনা হলেন চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের দিকে। পথে প্রায় ৪০ মিনিট বাঁচার জন্য যুদ্ধ করলেন আব্দুস ছালাম মাল। নেয়া হলো চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে। ততক্ষণে তার অক্সিজেন পালস ৪০-এ নেমে এসেছে।

হাসপাতালের ৩য় তলায় ফ্লোরের একটি বেডে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন আব্দুস ছালাম। জামাতা মাহফুজুর রহমান নিচে গেলেন অক্সিজেন আনতে। পালস ৪০ লিখে একজন দায়িত্বরত নার্স ইমারজেন্সি অক্সিজেন দিতে বললেন। কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে অক্সিজেন পাচ্ছিলেন না। বলা হলো লাইনে দাঁড়ান। যারা আগে এসেছে তারা আগে পাবে। আবার ৩য় তলায় দৌড়ে গেলেন শ্বশুরের কাছে। ততক্ষণে পালস ৩০-এ নেমে গেছে। নতুন টোকেন কেটে কাউন্টারে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন মফিজুর রহমান। বললেন আমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। পালস ৩০-এ নেমে গেছে, এক বোতল অক্সিজেন দেন। কাউন্টার থেকে সাড়া মিলেনি। আবার গেলেন শ্বশুরের কাছে। শ্বাস-কষ্ট আরও বেড়েছে তার। আরেকজন নার্স এসে পালস মাপলেন। ২৫-এ নেমে গেছে রোগীর পালস। নতুন টোকন নিয়ে ৩য় বার কেঁদে কেঁদে কাউন্টারে অনুরোধ করার পর দয়া হলো। বললো, আপনি যান অক্সিজেন আসছে। মফিজুর রহমান শ্বশুরের কাছে গেলেন। মৃত্যুর আগে নার্সকে উদ্দেশ্য করে আব্দুস ছালাম মালের শেষ কথা ছিলো, 'সিস্টার, সিস্টার আমিতো মইরা যাই; আমারে কি অক্সিজেন দিবেন না?' যতক্ষণে নিচ থেকে অক্সিজেন আসলো ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

কথা বলা হয় হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ বেলায়েত হোসেনের সাথে। বললেন, অক্সিজেন পর্যাপ্ত মজুত আছে। ডিউটি ডাক্তার কেন বললেন অক্সিজেন নেই তা আমার জানা নেই। আমি বিষয়টি দেখছি।

'সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হাসপাতালের ভিতরেই ভিজিট নিয়ে প্রাইভেট রোগী দেখাটা বৈধ কি-না' জানতে চাইলে ডাঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, তা বৈধ নয়, তবে ডাক্তার হাসপাতালের রুমে প্রাইভেটভাবে রোগী দেখেছেন নাকি কোয়ার্টারে দেখেছেন তা নিশ্চিত হতে হবে। যদি তার ডিউটির বাইরে কোয়ার্টারে বসে রোগী দেখেন তবে দেখতে পারেন, কিন্তু ডিউটি চলাকালীন হাসপাতালে রোগী দেখার ঘটনাটি যদি ঘটে থাকে তবে তা অবৈধ।

চাঁদপুরের জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, চাঁদপুরের সকল উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন বরাদ্দ আছে হাইমচরে। ছোট উপজেলা ও জনসংখ্যার তুলনায় সেখানে অক্সিজেন বেশি। তবুও ডাক্তার কেন রোগীকে ভুল তথ্য দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন তা আমার জানা নেই। ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয় তার জন্য আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।

রোগীর শ্বাসকষ্ট কম থাকলে বলা হয়, বাড়িতে চিকিৎসা নিন আর শ্বাসকষ্ট বাড়লে অক্সিজেনের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে রেফার করা হয় চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে এমন অভিযোগ শুধু হাইমর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধেই নয়, বিভিন্ন উপজেলাগুলোতেও পাওয়া যায় একই অভিযোগ। চাঁদপুর কণ্ঠের অনুসন্ধানে মিলেছে তার প্রমাণ। আগামীকাল অনুসন্ধান-০৩-এ প্রকাশ পাবে তেমনই আরেকটি ঘটনা। দিন শেষে জিজ্ঞাসা একটাই, কেনো এতো মৃত্যু, কেনো এতো লাশ? সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিবেন কি কর্তৃপক্ষ?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়