প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
শোক ও সঙ্কট উত্তরণের আগস্ট
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
আগস্ট বড়ই নির্মম, আগস্ট যেন চিরচেনা এক বিশ্বাসঘাতক। বাঙালির কাছে আগস্ট হলো অঘটন ঘটন পটিয়সী। সেই সাতচল্লিশে বেনিয়া ব্রিটিশ দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভাজন দিয়ে যে অঘটনের সূচনা করে দিয়েছিলো, আজও স্বাধীন দেশে আগস্টে তার জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ঊনিশশো সাতচল্লিশের চৌদ্দ আগস্ট যে দুর্বল পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে, তার ভেতরে রয়ে গিয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের সর্বনাশা বীজ। ধর্মের ওপরে ভিত্তি করে যে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, শেখ মুজিবের করুণ পরিণতি তার জের টেনে যাওয়ার নির্মম ধারাবাহিকতা। সাতচল্লিশের আগস্ট কেবল দুটো রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি, বরং বারোশ মাইল দূরের দুটো ভূখণ্ডের মধ্যে বৈরিতার বীজ বপন করে দিয়ে গেছে। সেই বৈরিতার বীজ হতে ফিনিক্স পাখির মতো বাংলাদেশের জন্ম হলেও পরাজয়ের প্রতিশোধে উন্মত্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের নীল নকশায় হারিয়ে গেছে বাংলা মায়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আগস্টের খলনায়করা মহাভারতের শিখণ্ডির মতো দিন গুণে গেছে প্রত্যাঘাতের বিষফণার ছোবল হানার জন্যে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সেই ছিল মাস্টারমাইন্ড আর এদেশীয় কুলাঙ্গাররা ছিল বেনিফিশিয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা চেয়েছিল নেতৃত্ব শূন্য হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ুক সদ্যোজাত বাংলাদেশ। কিন্তু ঘাতক জানত না ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে।’ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের যিনি বিচার করে দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে, তিনি আর কেউ নন, তাঁরই স্নেহাতুরা কন্যা স্বয়ং। পঁচাত্তরে জার্মানিতে মুক্ত বায়ুতে যিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন মুজিবের শেষ নিঃশ্বাসকালীন, তিনিই আজ গোকূলে বেড়ে ওঠা দেবদূত। তিনিই অভিশপ্ত জাতির কলঙ্ক তিলক মোচনকারী আদ্যাশক্তি। তাঁর হাতেই আজ বাংলাদেশ খুঁজে পেয়েছে আপন গন্তব্যের নান্দনিক ঠিকানা।
প্রথম বিপ্লবে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনকারী বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের বীজ রোপণ করে তার ফসল দ্রুত ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল সেদিনের আগস্ট। আগস্টের সেই সব নৃশংস কুশীলব যেন রক্তবীজের ঝাড়। বিভিন্নরূপে বিভিন্ন কায়দায় তারা সরব হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর দুহিতার দূরদর্শিতার মাধ্যমে নাকচ করে চলেছেন একের পর এক সেই ষড়যন্ত্র। একদিন যে বঙ্গবন্ধুর অন্তিম স্নানে পাঁচশ সত্তর সাবানকেই মনে হয়েছিল মহার্ঘ্য, আজ সেই বঙ্গবন্ধুই ছাড়িয়ে গিয়েছেন হিমালয়কে, তাঁর মরণোত্তর কর্মফলের ফলস্বরূপ। বঙ্গবন্ধু আজ মহাকাশে বাঙালির আত্মপরিচয়ের আধুনিক নিবাস।
আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে বিদেহী করে তুললেও আগস্টই বিমূর্ত বঙ্গবন্ধুকে মহীয়ান করে তুলেছে তার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে। বিশ্বজুড়ে আগস্ট আজ শোকের প্রতিমূর্তি। যে আগস্ট হিরোশিমা-নাগাসাকিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল, যে আগস্ট উপমহাদেশকে খণ্ডিত করে তুলেছিল, সে আগস্টই বঙ্গবন্ধুর প্রাণ হরণ করেও বঙ্গবন্ধুকে অনতিক্রম্য কালজয়ী করে তুলেছে। তাই আগস্ট কেবল শোকের নয়, আগস্ট কেবল চোখ রাঙানোর নয়। আগস্ট আজ বাঙালি জাতির পিতার শেষ নিঃশ্বাসধন্য শোকের জাদুঘর ইতিহাসের বুকে। আগস্টের রক্তধারা আজ ইতিহাসের স্রোতস্বিনী হয়ে অনাগতকালে বহমান।