প্রকাশ : ২১ জুন ২০২২, ০৯:৩৮
এক পায়ে জীবন
মাঠে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলছে মেয়েটি। সবার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁপিয়ে যাচ্ছে বারবার। তবুও চেষ্টার ত্রুটি নেই। পাছে যদি হেরে যায়। কিন্তু মেয়েটি পারছে না। কারণ আর সবার মতো দুপায়ে ভর করে স্বাভাবিকভাবে ছুটতে পারে না সে। এক পায়েই খেলার সাথীদের সাথে চলছে সেই কিশোরীর দুরন্তপনা। চাঁদপুর পৌর ঈদগাহ ময়দানে এমন দৃশ্যটি দেখা গেল। কৌতূহলী মন নিয়ে কাছে গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আসলে মেয়েটির দুটি পা-ই আছে। তবে ডান পায়ের গোড়ালির চামড়া তার উরুর সাথে সংযুক্ত। যে কারণে সেই পা সোজা করতে অক্ষম সে। তাই এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকটা ব্যাঙের মতো চলাচল করতে হচ্ছে তাকে।
|আরো খবর
জিজ্ঞেস করতেই জানালো তার নাম নূরজাহান। বয়স ১২ কি ১৩। মায়ের নাম রুমা বেগম (৩০), বাবা বিশাল মিয়া (৪০)। বাবা কোথায় হারিয়ে গেছে জানে না নূরজাহান। চাঁদপুর শহরের পৌর ঈদগাহ ময়দানের পেছনে ডাকাতিয়া নদী তীরের বেদে পল্লীতে থাকে নূরজাহান। সেখানে একটি পলিথিনে মোড়ানো ঝুপড়ি নৌকায় মা-মেয়ের বসবাস। বাবা লাপাত্তা বলে নূরজাহানের মা নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
তার পায়ের এই অবস্থা কীভাবে হলো জানতে চাইলে নূরজাহান জানায়, জন্মের সময় আর সবার মতো স্বাভাবিকই ছিল সে। তার বয়স যখন তিন বছর তখন তাদের নৌকায় আগুন লাগে। আর সেই আগুনে প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিসপত্র গলে তার পায়ে পড়ে পুড়ে যায়। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় তার পায়ে গোড়ালির চামড়া উরুর সঙ্গে মিশে যায়। মায়ের কাছে এ ঘটনা শুনেছে নূরজাহান।
অভিমানের সুরে নূরজাহান বলে, আমার ওই ঘটনা তো মনে নাই। তয় জ্ঞান হওয়ার পর থাইকা আমি এমনেই লাফাইয়া লাফাইয়া চলি। মানুষ আমারে লেংড়ি কয়। অবহেলা করে। আমারে খেলায় নিতে চায় না।
নূরজাহানের মা রুমা বেগম বলেন, নৌকায় আগুন লাইগ্যা মাইয়াডার পা পুইড়া গেছে। অনেকদিন আগে ডাক্তার কাইছিল ঢাকা নিতাম। অপারেশন করলে মাইয়া ঠিক হইয়া যাইব। এক লাখ টাকা লাগব। আমরা বেদে মানুষ। এক হাজার টাকার নোট-ই দেখি না চোখে। এক লাখ টাকা তো স্বপ্নেও দেখি না। হের লাইগাই মাইয়ার চিকিৎসা করতে পারি না। এহন মাইডায় এক পায়ে লাফ দিয়ে হাঁটে। ওর কষ্ট আর দেখতে পারি না। বড় অইলে তো ওরে বিয়াও দিতে পারুম না। কে নিব এক পায়ে লাফাইন্না মাইয়ারে! আল্লায় যদি কারো দয়া করে, কোনো মানুষ সাহায্য করে বা সরকার যদি কোনো সাহায্য করে তাইলে মাইয়াডার চিকিৎসা করতে পারমু।
বেদে পল্লীর সরদার ফরহাদ বেপারী বলেন, মেয়েটা অনেক কষ্ট করে হাঁটাচলা করে। চোখে না দেখলে অনুমান করা যাবে না। গরিব মানুষ তাই ঠিক মত চিকিৎসা করতে পারে না। হয়তো অপারেশন করে পা আলাদা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চাই আমরা। তিনি যাতে নূরজাহানের চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা করেন।
নূরজাহানের অবস্থা জানিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সার্জন ডা. নুরুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, অপারেশনের মাধ্যমে মেয়েটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে তার রগগুলো ইন্ট্যাক্ট আছে কি না। থাকলে তাড়াতাড়ি ভালো হবে। রগে সমস্যা থাকলে অপারেশনের পর ফিজিওথেরাপি দিয়ে ঠিক করতে হবে। সেক্ষেত্রে কিছু সময় লাগতে পারে। আর এসবের জন্য হাসপাতালে ৫-৬ দিন থাকতে হবে। সব মিলিয়ে লাখ খানেক টাকা খরচ হতে পারে বলে ধারণা। এর কমণ্ডবেশিও হতে পারে। প্রতিবেদক : সাঈদ আল হাসান শিমুল। সূত্র : দৈনিক যুগান্তর।