সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০২

আলঝাইমার্স রোগীর পুষ্টি রক্ষার উপায়

হাসান আলী
আলঝাইমার্স রোগীর পুষ্টি রক্ষার উপায়

আলঝাইমার্স রোগীর পুষ্টি রক্ষা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস, রুচি, স্মৃতি এবং গলাধঃকরণের দক্ষতা হারাতে থাকেন। সঠিক পুষ্টি রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে এবং রোগের গতি ধীর করতে পারে।

নিচে আলঝাইমার্স রোগীর পুষ্টি রক্ষায় করণীয় বিষয়গুলো দেয়া হলো।

১. সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিতে পারেন।

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তিন বেলা খাবার দিন। খাদ্য তালিকায় রাখুন সবজি ও ফল। ভিটামিন, খনিজ, এন্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খেতে দিন।

পূর্ণ শস্য, লাল চাল, ওটস, গম, চর্বিহীন প্রোটিন মাছ ও মুরগী, ডিম, ডাল, বাদাম খেতে দিতে পারেন। স্বাস্থ্যকর চর্বি জলপাইয়ের তেল, সূর্যমুখী তেল ও বাদাম তেল খাওয়া যায়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি পেতে দুধ ও দুগ্ধ জাত খাবার দিন।

২. পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করা। আলঝাইমার্স রোগীরা পানি পানের কথা ভুলে যেতে পারে। দিনে আট/দশ গ্লাস পানি, শরবত, ফলের রস, স্যুপ দেওয়া যেতে পারে। পানির বোতল সবসময় চোখের সামনে রাখতে হবে

৩. খাওয়ার পরিবেশ সহজ ও শান্ত রাখা। পরিচিত পরিবেশে খাওয়ার উৎসাহ দিন। টেবিলের উপর অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখলে রোগী বিভ্রান্ত হতে পারে। একই প্লেট, গ্লাস, বাটি, চামচ ব্যবহার করলে রোগীর পক্ষে মনে রাখা সহজ হয়।

৪. আস্তে ধীরে খেতে উৎসাহিত করুন। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে খাওয়ার সুযোগ দিন। বিরক্ত হয়ে তাড়াহুড়ো করলে খাবার গলায় আটকে যেতে পারে অথবা রোগী দম বন্ধ অনুভব করতে পারে।

৫. গলাধঃকরণের সমস্যা থাকলে খাবার নরম ও সহজ পাচ্য করুন। খাবার থেঁতো করে দিন বা স্যুপ বানিয়ে দিন। খুব গরম ও ঠাণ্ডা খাবার এড়িয়ে চলুন।

৬. ক্ষতিকর খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত লবণ, চিনি, চর্বি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার সীমিত করুণ। ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল থেকে বিরত রাখুন।

৭. রোজকার খাদ্য রেকর্ড রাখতে হবে। কোন কোন খাবারে রুচি বেশি বা কম তা লিখে রাখুন। অ্যালার্জি বা হজমে সমস্যা হলে নোট করুন।

পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগীর পুষ্টি পরিকল্পনা করা ভালো। যদি রোগীর ওজন কমে যেতে থাকে তবে বাড়তি ক্যালোরি ও প্রোটিন প্রয়োজন হতে পারে।

আলঝাইমার্স আক্রান্ত রোগীদের পুষ্টি ব্যবস্থাপনা অত্যান্ত সংবেদনশীল কাজ। এখানে পুষ্টিবিদদের ভূমিকা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগের অগ্রগতি অনুযায়ী রোগীর খাদ্যাভাস, পুষ্টি চাহিদা ও গলাধঃকরণের সমস্যা পরিবর্তিত হয়, তাই ব্যক্তিগতভাবে পরিকল্পিত ও নজরদারি পূর্ণ পুষ্টি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

নিচে পুষ্টিবিদের করণীয় ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো।

ক. পুষ্টি মূল্যায়নÑরোগীর বর্তমান ওজন, ইগও, খাদ্যাভাস, রুচি ও খাবার গ্রহণের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা। যদি ওজন হ্রাস বা অপুষ্টির লক্ষণ থাকে তা নির্ধারণ ও ট্র্যাক করা। গলাধঃকরণ সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়েবিটিস বা হৃদরোগের মতোসহ রোগ থাকলে তা বিবেচনায় নেওয়া।

খ. ব্যক্তিগত খাদ্য পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া। রোগীর পছন্দ, শারীরিক অবস্থা ও রোগের স্তর অনুসারে খাদ্য তালিকা তৈরি করা। যদি ওজন কমে যায় তবে উচ্চ ক্যালোরি ও উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। গলাধঃকরণের সমস্যা থাকলে সহজপাচ্য ও নরম খাবার দিতে হবে। স্মৃতি উন্নতিতে সহায়ক ওমেগা-৩ এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে।

গ. স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিতে হবে। ওমেগা-৩, ফ্যাটি এসিড মাছ, সিয়া সিড, আখরোটে পাওয়া যায়। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বেরি, গাজর ও টমাটোতে পাওয়া যায়। ডিম, দুধ, বাদামে ভিটামিন বি, ডি, ই পাওয়া যায়। লবণ ও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অতিরিক্ত খেলে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা বাড়াতে পারে।

ঘ. খাওয়ার অভ্যাসে সহায়তা করা। ছোট ছোট ভাগে বার বার খাবার দেওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। চোখে পড়ার মতো, পরিচিত খাবারের পরামর্শ দেওয়া যাতে রোগী সহজেই চিনতে পারে। তরল খাবারে শক্তি ও পুষ্টি বাড়াতে মিল্ক পাউডার, ঘন স্যুপ, পিউরি, স্মুদি ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে।

ঙ. পানিশূন্যতা প্রতিরোধে নজরদারি বাড়াতে হবে। পানির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ফলের রস, ডাবের পানি, ঘোল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। পানি পান ভুলে গেলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উপায় নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

চ. পরিবার ও সেবাদাতাদের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া। কীভাবে খাবার প্রস্তুত ও পরিবেশন করতে হবে তা বুঝিয়ে দেওয়া। রোগীর রুচি ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে খাওয়ানোর কৌশল শিখানো।

ছ. নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। প্রতি মাসে পুষ্টিগত পরিবর্তন মূল্যায়ন করা। খাদ্য তালিকায় প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনা। যদি রোগীর ওজন কমে বা সমস্যা বাড়ে তবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জ. বিপজ্জনক ও বিভ্রান্তিকর খাবার থেকে বিরত রাখা। চিবানো বা গিলে খাওয়া কঠিন এমন খাবার এড়িয়ে চলা যেমন শক্ত বাদাম, শুকনো বিস্কুট। কৃত্রিম খাদ্য বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা। চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া কিছু না দেওয়া।

পুষ্টিবিদরা শুধু খাদ্য পরিকল্পনাই দেন না তারা রোগীর মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ খাদ্য পরিচালনা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। আলঝাইমার্স রোগীর জন্য এটি মানসিক সুস্থতা, রোগের গতি কমানো ও জীবনমান বজায় রাখতে সহায়ক হয়।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়