রবিবার, ২৯ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫, ০৯:১৭

'পুকুর মানে শুধু জলাধার নয়, এটি একটি শহরের পরিবেশের শ্বাস-প্রশ্বাস'

চাঁদপুর শহরে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুরের ঐতিহ্য, প্রাণ খুলে গোসলে নেই স্বস্তি

কবির হোসেন মিজি
চাঁদপুর শহরে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুরের ঐতিহ্য, প্রাণ খুলে গোসলে নেই স্বস্তি

একসময় পুকুরে গোসল ছিলো চাঁদপুর শহরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে প্রাণ জুড়ানো, বিকেলের আলোয় পুকুরের পাড় ঘেঁষে গল্প, সব মিলিয়ে পুকুর ছিলো একান্ত আবেগ, মনের প্রশান্তি ও প্রয়োজনের জায়গা। আজ সেই চিত্র শুধুই স্মৃতি। আধুনিক নগরায়ন, দখল ও অদূরদর্শী পরিকল্পনার বলি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুর শহরের পুকুরগুলোর ঐতিহ্য। একসময় চাঁদপুর শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লাতেই ছিলো একাধিক পুকুর। আদালত পাড়া, কদমতলা, পাল পাড়া, উকিল পাড়া, প্রফেসর পাড়া, ট্রাক রোড, বিষ্ণুদী মুন্সিবাড়ি মাদ্রাসা রোড, মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী সড়ক, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিলো পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণাবেক্ষণকৃত বহু পুকুর, যা গোসল করা, মাছ চাষ ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। চাঁদপুর শহরের প্রবীণ নাগরিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৫-৩০ বছর আগেও চাঁদপুর শহরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মালিকানাধীন পুকুর ছিলো সাধারণ চিত্র। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ছাত্র থেকে দিনমজুর, সবার জীবনেই পুকুর ছিলো একটি অনিবার্য অবলম্বন। সময়ের বিবর্তনে একে একে এসব পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কোথাও গড়ে উঠেছে দালান, কোথাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোথাও বাসা-বাড়ি, কোথাও পাকা রাস্তা। কারো কারো দাবি, নিজস্ব প্রয়োজনে বা উন্নয়ন কাজের নামে পুকুর ভরাট করা হলেও এর অধিকাংশই হয়েছে বিনা অনুমতিতে বা প্রভাবশালীদের চাপে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, পুকুর মানে শুধু জলাধার নয়, এটা একটি শহরের পরিবেশের শ্বাস-প্রশ্বাস। পুকুর হারালে শহরের মাটি শুকিয়ে যায়, পানির স্তর নিচে নেমে যায়, আর জলাবদ্ধতা বেড়ে যায়। চাঁদপুর শহর থেকে সব পুকুর হারিয়ে না গেলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক। শহরে এখন হাতে গোণা যে ক’টি পুকুর রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জেএম সেনগুপ্ত রোডের পার্শ্ববর্তী জোড়পুকুর পাড়ের একটি পুকুর। এখানে দীর্ঘসময় ধরে দুটি পুকুর তথা জোড়পুকুর ছিলো। সেজন্যে স্থানটির নাম জোড়পুকুর পাড়। নব্বইর দশকে পশ্চিম পাশের পুকুরটি ভরাট হয়ে যায়, যেটি এখন বহু ইমারতকে বুকে ধারণ করে আছে। জোড় ভেঙ্গে টিকে থাকা পূর্ব পাশের পুকুরটি শহরের ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলোর মধ্যে একটি। এখনো কিছু মানুষ গোসলসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এই পুকুরে আসেন। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই পুকুরও ধীরে ধীরে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। স্টেডিয়াম রোডের বক্ষব্যাধি হাসপাতাল সংলগ্ন পুকুরটি এখনো টিকে আছে। তবে তার পানি অনেকটাই দূষিত। আগে শহরের এই সড়কের দুপাশের অনেক মানুষ এই পুকুরটিতে গোসল করতো স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পুকুরটির আশেপাশের ডোবা এবং খালি জায়গাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেটির পানিও এখন অনেক দূষিত হয়ে গেছে। এজন্যে মানুষজন এখন সেটিতে গোসল করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগের তুলনায় শহরে এখন তেমন পুকুর না থাকায় শহরের বহু মানুষ এখন প্রাকৃতিক জলাধারের পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন । চাঁদপুর শহরের মাদরাসা রোড সংলগ্ন বর্তমান আউটার স্টেডিয়ামটি যেখানে, সেখানে বিশাল একটি দিঘি ছিলো। যেটিতে একসময় শহরের বিভিন্ন এলাকার মানুষজন গোসল করতো বেশ আনন্দের সাথে। প্রায় ২০/২৫ বছর আগে সেই বিশালাকার দিঘিটি ভরাট করে আউটার স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। তারপর থেকেই মানুষজন দিঘিতে গোসল করার আনন্দ-অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। তার নিকটবর্তী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শেরে বাংলা ছাত্রাবাসের সামনে একটি পুকুর রয়েছে। তবে এটির সেই পুরানো সৌন্দর্য আর স্বচ্ছ পানি আগের মতো নেই। অনেকে বলেন, এখন আর শহরের পুকুরে ডুব সাঁতারে প্রাণ খুলে গোসল করার সেই সুযোগ নেই। সেসব এখন যেনো সোনালী অতীত। গোসলের জন্যে টিউবওয়েল বা গভীর নলকূপই ভরসা। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা জল আর নেই, সেই আরামও নেই। তরুণরা আজ সাঁতার শেখে না, শিশুরা জলে ডুবে খেলতে শেখে না। শহরের শিশুরা জানেই না পুকুর মানে কী! বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। কারণ বৃষ্টির পানি যাওয়ার মতো স্বাভাবিক জলাশয় আর নেই। পুকুর শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও নিরাপত্তা। এখন সময় এসেছে পুকুর রক্ষা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার। পৌরসভা বা জেলা প্রশাসনের উচিত শহরের যেসব পুকুর এখনও টিকে আছে, তা সংরক্ষণে আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা। পুরানো পুকুরগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যায়নে শহরের পরিকল্পনায় নতুন জলাশয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি বলে মনে করছেন চাঁদপুরবাসী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়