বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

বিস্ময়ে তাই জাগে প্রাণ
তৃপ্তি সাহা

বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি মোর স্থান

বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান

আকাশভরা...। -রবীন্দ্রনাথ।

স্বাধীনতার পর যেদিন বাংলার বীরাঙ্গনা কন্যারা বঙ্গবন্ধুর বুকে মাথা রেখে জন্মদাতা পিতার চেয়েও অনেক বেশি নির্ভরতা পেয়েছে, সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলেন। কন্যাসম বীরাঙ্গনা মেয়েরা স্বাধীনতার পর ধর্ষিত, লুণ্ঠিত, অনাকাঙ্ক্ষিত অনাগত শিশুটির পিতৃপরিচয় নিয়ে এক দুর্বিষহ জীবন পার করছেন। সমাজ সংসার, নিজের পরিবার এমনকি নিজের পিতামাতা মেয়েকে ঘরে নিতে অস্বীকার জানাতে কুণ্ঠিত হননি সেদিন। সেখানে পাকিস্তান থেকে দেশে দুর্বিষহ পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেয়েদের বুকে তুলে নিয়েছেন। মেয়েদের কান্নার জলে পিতার বুক ভেসে গেছে। পিতা নির্ভরতার হাত রেখেছেন মেয়েদের মাথায়। বলেছেন, ‘ভয় নেই আমি তো আছি’। অশ্রুসিক্ত মেয়েদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পিতার জায়গায়, ‘আমার নাম লিখে দিস। বাড়ির ঠিকানা ৩২নং দিবি’। ভাবা যায়! এমন দুঃসাহসী পিতার তখন মাত্র পঞ্চাশ বছর। সমস্ত বাংলার কঠিন দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। সে পিতা জাতির পিতা এটি খুব যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত । তিনি বর্তমান আমাদের চেয়ে শত শত বছর এগিয়ে যাওয়া স্বপ্নবাজ রাজপুত্র, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে নিয়ে লিখা যেমন খুব সোজা, তেমনি কঠিন। সোজা এই কারণে তাঁকে নিয়ে এত লেখা হয়েছে, সেখান থেকে দু-একলাইন করে লেখলেও অনেক বড় লেখা লেখা যায়। কিন্তু আমি ভাবি তাঁর কোন দিকটি নিয়ে লিখবো? বিশেষ করে তিনি যখন ঠোঁটে প্রায় রবীন্দ্র সংগীত তোলেন। গুণগুণ করে গান করেন। প্রচুর পরিমাণে বই পড়েন। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি দিক এত বেশি আলোকিত এত বেশি উজ্জ্বল এত বেশি মাধুর্যপূর্ণ যে কেউ তাঁর সংস্পর্শে এসে মোহাবিষ্ট হয়েছেন খুব সহজেই। তিনি শুধু নেতা হিসেবে নয়, তিনি পুত্র হিসেবে, পিতা হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, জাতির পিতা হিসেবে, স্বামী হিসেবেও ছিলেন জাদুকরী। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয় যার জন্য অমর্ত্য সেন বলেছেন, তিনি বিশ্বনেতা।

আজ তাই তাঁর নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলির চেয়ে মানবিক বঙ্গবন্ধুর কথাই হয়তো বেশি চলে আসবে। যার বেশির ভাগ কথা একান্ত তাঁর নিজের। রেণুর কথা, আব্বা আম্মার কথা, হামিদ মাস্টারের কথা, ছেলেমেয়েদের কথা, বড় বড় নেতাদের কথা, অতি সাধারণ মানুষের কথা সবকিছুই তাঁর আপন, একান্ত তাঁর নিজের। এর মধ্যে তাঁর প্রিয়তম রেণুর কথা সবার আগে মনে পড়ে। প্রিয়তমা রেণুকে স্নেহ ভালোবাসায় প্রেমে, মুগ্ধততায় এতটাই দিয়েছেন যে, রেণু তাঁর স্ত্রী হিসেবে তো বটেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা, বড় বেশি সহযোদ্ধাও হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নিজের জীবনের প্রত্যেকটি অংশ রঙতুলিতে আঁকা ছবির চেয়েও উজ্জ্বল, সুক্ষ্ম।

বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আমাকে বিদায় দেয়ার সময় রেণু নীরবে চোখের পানি ফেলছিলো। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমু দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিলো না। সবই তো ওকে বলেছি’। কথাগুলো অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর সরলতম উক্তি। আরও লিখেছেন, একদিন আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিলো আমাকে দিতে, আমি রেণুকে বললাম, ‘এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দুজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোন আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না। সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন?’

যে মানুষটা জীবনের উচ্ছ্বসিত সময়ে শুধু দেশের মানুষ আর বাঙলার কথা ভেবেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাটিয়েছেন জেলে জেলে। দেশ দেশান্তরে। সেই মানুষটির পরিবারের প্রতি এত সূক্ষ্ম জীবনবোধ, সূক্ষ্ম চিন্তা তাঁর উচ্চতর শিক্ষা, অসাধারণ মনন আর ব্যক্তিত্বের কথা জানান দেয়।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বনেতা, মহান নেতা, স্বাধীনতার জনক, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দ। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না- এসব কথা যেমন সত্যি একজন স্বামী হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, অসাধারণ। তিনি যখন নিজেই প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণের আগে যার মুখটিকে দেখেছেন, ভেবেছেন তিনি রেণু, সেটি স্বামী হিসেবে তো বটেই মানুষ বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি উজ্জ্বল, মহিমান্বিত করে তোলে।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যেমন দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তাঁকে যেমন দেখেছি তেমনি তিনি যখন তাঁর প্রিয় রেণুর কথা ছত্রেছত্রে তুলে ধরেন, পলে পলে অনুভব করেন, তখন তিনি সত্যিকার অর্থেই স্বামী হিসেবে হয়ে উঠেন অসাধারণ, অতুলনীয়। যখন তিনি প্রিয় বাবা মায়ের কথা বলেন তখন সন্তান হিসেবেও তিনি অনন্য অসাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বারবার আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেন।

কথায় বলে মানুষ একজীবনে সব পায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই পরিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। হতে পারে ক্ষণজন্মা! কিন্তু জীবনের যতটুকু সময় পেয়েছেন তার প্রতিটি মুহূর্ত সার্থক করে তুলেছেন ভাবনার মাধুর্যে, সততায়, সরলতায়, কর্মে, সৌন্দর্যে। বিশ্বের কজন নেতা এতটা সৌভাগ্য নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন আমার জানা নেই।

তিনি তাঁর ডায়েরি লেখার কৃতিত্বও প্রিয়তমা স্ত্রী রেণুকে দিয়েছেন। লিখেছেন, আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে এসে বললো, ‘বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবন কাহিনি’। তারপর একদিন কয়েকটা খাতা কিনে এনে জেল গেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলেন। খাতাগুলো জেল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়েছিল। তারপর আমরা আমাদের প্রিয়তম জাতির পিতার চমকপ্রদ সব জীবনের তথ্য পেলাম। তারপর আমরা তাঁর অসাধারণ সব লিখনি পেলাম। পেলাম একজন অসাধারণ সাধক মানুষকে, প্রকৃত স্বামীকে, পেলাম পিতাকে, পেলাম জনপ্রিয় নেতাকে, শুদ্ধাচার মানুষকে, জাতির পিতাকে। তাঁর সময়ে ডাইরিতে লিখা, স্ত্রীকে একটা ‘চুমু’ দিয়ে বের হলাম, সেই সময়টা চোখের সামনে ভেসে উঠে সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার ছবির কোনো দৃশ্য। সেই ছবির তিনিই লেখক, প্রযোজক, পরিচালক। তিনি পেরেছেন। কারণ ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে থেকেও নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছন্দে গন্ধে সৌকর্যে অটুট বন্ধনে বেঁধেছিলেন তিনি। সব জায়গাতেই তিনি সৃষ্টি করেছেন অনন্যসাধারণ জীবনবোধ। পারিবারিক বন্ধন ছিলো অকৃত্রিম। এর মধ্যে যেমন পবিত্রতা আছে, স্নেহ আছে, আছে ভালোবাসা, আছে শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ, তেমনি আছে সরলতা।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর ধীরে বহে মেঘনাতে লিখেছেন, আমরা কথা বলছিলাম বত্রিশ ধানমন্ডির বাসায়। বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি কক্ষে বসে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের বিকেলে। আত্মজীবনী ডিকটেশন দেওয়ার ফাঁকে চা পানের বিরতির সময় বঙ্গবন্ধু কথা বলছিলেন এভাবে- একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী উত্তর দিলেন, আর তিনি যদি আপনার জীবন পাল্টে দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসও সেদিন পাল্টে যেতো। বাস্তবিক তাই। কী জাদু ছিলো বেগম মুজিবের? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ধীরে বহে বুড়িগঙ্গাতে লিখেছেন, জীবনে অনেক মহীয়সী মহিলার জীবনী পড়েছি। কিন্তু চাক্ষুষ যাদের দেখেছি তাঁদের মধ্যে বেগম মুজিব অতুলনীয়। তিনি শুধু শেখ মুজিবের সংসারে হাল ধরেননি, পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর রাজনীতির হাল ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে সাহস, শক্তি জুগিয়েছন। সকল দুঃখ ও নির্যাতন বরণের জাদুর বাক্স।

বাংলাদেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাতে হয়। সকল ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবনে যে প্রদীপের আলো বিশ্ব-দরবারে আলোকিত করেছে সেই প্রদীপের সলতেটি পাকিয়েছে রেনু। যার ভালো নাম ছিলো বেগম ফজিলাতুন্নেছা। রেণুর তিন বছর বয়সে মুরব্বিদের হুকুম মানতে বার তেরো বছর বয়সেই শেখ মুজিবকে বিয়ে করতে হয়। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মাসে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট মধুমতী নদী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। তাঁর আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান মা সায়েরা খাতুন। তাঁর দাদার ছোট ভাই ইংরেজদের দেওয়া উপাধি ‘খান সাহেব’ শেখ আবদুর রশিদ একটি মিডল ইংলিশ (এমই) স্কুল খুলেন গোপালগঞ্জে। আর দাদার চাচাতো ভাই অর্থাৎ রেণুর দাদা তাঁর জীবনী লিখেছিলেন চমৎকার বাংলা ভাষায়। মুজিব পরিবারে ইংরেজি লেখাপড়া শুরু হয় তাঁর দাদার আমল থেকে। রেণুর যখন পাঁচ বছর তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো দাদা। রেণুর দাদাও সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর থেকেই সায়রা বেগম তাঁর কাছে নিয়ে আসেন রেণুকে। ছেলেমেয়েদের সাথে বড় করেন। যদিও খোকা অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় অনেক ছোট বেলায় কিন্তু বাইশ বছর অর্থাৎ ১৯৪২ এ ফুলশয্যা হয়। অর্থাৎ ২২ বছরে। এসব আমরা জেনেছি।

১৯৪৬ সাল, আগস্ট মাস। বঙ্গবন্ধু তখন কোলকাতায়। তিনি তখন ছাত্র। কোলকাতার বাংলা ছবির বিখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, সবার উপরে মানুষ সত্য, সেই ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্রের ছবি বিশ্বাস। পার্ক সার্কাসে বসবাস করতেন। তিনি স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। কোলকাতার দাঙ্গা শুরু হওয়ার কিছু আগে তিনি নিশ্চিত মনে পার্ক সার্কাসের বাড়িতে তালা দিয়ে সপরিবারে কোলকাতার বাইরে বেড়াতে যান। তিনি একবারও ভাবেননি হিন্দু হিসেবে তাঁর বাড়িতে হামলা হতে পারে। কারণ দর্শক নন্দিত অভিনেতা তিনি। বেড়ানো শেষে এসে দেখেন বাড়ি লুট হয়ে গেছে। আসবাবপত্র, গয়নাগাটি তো গেছেই, কাপড়চোপড়ও নেই। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। বুঝতে পারলেন এ বাড়ি তাঁর জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু মুসলমান প্রধান পাড়া থেকে বের হবেন কীভাবে? এক কাপড়ে যাবেন কোথায়? অনেক ভাবনার পর পুলিশ ডাকার বদলে ফোন করলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। শেখ মুজিব তাঁর দলবল নিয়ে এসে ছবি বিশ্বাসকে বললেন, দাদা আপনি বেঁচে আছেন, তাতেই আমরা খুশি। আমরা পালা করে পাহারা দিবো। ছবি বিশ্বাস ঘটে যাওয়া ঘটনা সব বললেন। শেখ মুজিব মাথা চুলকে একটু ভেবে বললেন, দুদিন সময় দিন।

দু-দিন পর পার্ক সার্কাসে ছবি বিশ্বাসের বাড়িতে যেতেই বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার সব মাল ফেরত পেয়েছি। এমনকি মেয়েদের গহনাগাটিও। তোমাকে কী বলে আশীর্বাদ করবো তা বুঝতে পারছি না। আমি একজন অভিনেতা। আমি আশীর্বাদ করছি, তুমি এই দেশের একজন বড় নেতা হবে। মানুষকে তুমি ভালোবাসো। মানুষও তোমায় ভালোবাসবে।। বাংলা ছবির এই কিংবদন্তি নায়ক ছবি বিশ্বাস মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছেচল্লিশের দাঙ্গার ঘটনাটি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এভাবেই।

একই সময়ে বিখ্যাত চিকিৎসক কর্নওয়ালিস স্টীটের ডাঃ বিধান রায়ের বাড়িটিও দাঙ্গাকারীরা ঘেরাও করে। পুলিশের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভলান্টিয়ার কোর নিয়ে সেখানে হাজির হন। দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করেন। নিজের জীবন বিপন্ন করেই শুধু হিন্দু নয় বহু মুসলমান পরিবারের জীবন রক্ষা করেছেন। এই সময় বেগম মুজিব খুব অসুস্থ ছিলেন। মাত্র দেড় বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়, ছেলেটি বাঁচেনি। ছেলে হারানোর আঘাতে বেগম মুজিবের শরীর মন ভেঙ্গে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সে সময় স্ত্রীর কাছে থাকা জরুরি। সে কথা বুঝে, গ্লানিবোধ করেন। স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিছু দিন পরেই তিনি স্ত্রীর কাছে এসে থাকবেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীও রাজি ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব কোলকাতার দাঙ্গা থামার পর বিহারের তাঁর ভলান্টিয়ার বাহিনী নিয়ে যাবেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি এ ব্যাপারে রেণুর সাথে পরামর্শ করেছো তো?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি তার চিঠি পেয়েছি লিডার’। সেদিন কড়া মেজাজের সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের কাছে এসে বললেন, Mujib, She is a very percious gift to you from God. Don't, neglect her please.

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যখন তাঁর আত্মজীবনী লিখার কাজে ব্যস্ত তখন শেখ মুজিব বেগম মুজিবের সেই বিবর্ণ কাগজের চিঠি চৌধুরীর হাতে দিয়েছিলেন। সেই চিঠি পড়ে চৌধুরী লিখেছেন, চিঠিটা পড়ে আমার কোন অল্পবয়সী মেয়ের চিঠি বলে মনে হলো না। মনে হলো, স্বামীর কাছে লেখা কোন বিদুষী মহিলার চিঠি। রেণু স্বামীকে লিখেছেন, আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজেই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন। সেই নেতাকে আমরা ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করেছি। শুধু নেতাকে নয়, পুরো পরিবার-পরিজনসহ মোট ১৮ জনের হত্যা সংঘটিত হয়েছে একই রাতে। পুরো আগস্ট মাস কালো চাদরে মুড়ে গেলো। এই দায়ভার কতিপয় পথভ্রষ্ট সেনাবাহিনী সদস্যদের উপর ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই।। যদি শুধু কতিপয় সেনাবাহিনী জড়িত হতো, তবে আবার ২১ আগস্টের জঘন্যতম ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। দায় এড়াতে পারি না আমরা।

তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাউশি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়