প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। তখন উন্নয়নের মাপকাঠিতে দেশগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। এই দেশগুলো হলো কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। আজকে অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না যে, তখন সিঙ্গাপুরের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো ছিল না। তা হলে খুব সরল একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, আমরা তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারলাম না কেন? কেন সামগ্রিক উন্নয়নের দিক থেকে আমরা ওই সব দেশের চেয়ে এতটা পিছিয়ে থাকলাম?
এর সহজ উত্তর হলো, যে দেশগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষায় তাদের বার্ষিক বাজেট, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের বিচিত্র সুবিধাদি, বিজ্ঞানচর্চার জন্য তাদের অবকাঠামোগত ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি শিক্ষকদের বেতনাদি ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়গুলো বিবেচনা করলে স্পষ্টই লক্ষ করা যাবে যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষাকে তারা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি তারা যে মনোনিবেশ করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে। আরও একটি ক্ষেত্রে তারা প্রভূত মনোযোগ নিবিষ্ট করেছিল, আর তা হলো কারিগরি শিক্ষা। দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের যে অসাধারণ স্তরে উপনীত হয়েছে, তার পেছনে আছে আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে থেকে কারিগরি শিক্ষার ওপর তাদের গুরুত্বারোপ।
আর এই কারিগরি শিক্ষা বিজ্ঞান শিক্ষারই একটি স্তর। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের যে রিপোর্ট আমরা দেখতে পাই, তা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের চেয়ে সমন্বিত উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু আমরা তার ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারিনি। আর এর পেছনে আছে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে আমাদের চরম অবহেলা। উল্লিখিত দেশগুলো জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে। অথচ শিক্ষাকে সামাজিক সম্পদ হিসেবে গ্রহণ না করায় এবং উন্নয়ন ও উৎপাদনবিমুখ পরিকল্পনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। অতীতে জাপান, জার্মানি থেকে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করতাম, এখন সেসব পণ্য আমদানি করছি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন থেকে। কথিত আছে, পাকিস্তান সরকার যখন পিএল-৪৮০ থেকে গম পেয়েই খুশি হতো, তখন ভারত সরকার বিদেশিদের কাছে গমের পরিবর্তে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা চেয়েছিল। আর সেই প্রচেষ্টার ফল হিসেবে আজকে তাদের বিশ্বমানের আইআইটিগুলোর উদ্ভব। তাদের ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটরা আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের পতাকা বিশ্বের সামনে উঁচু করে তুলে ধরছেন। ফলে স্বাধীনতার সময় যে ভারত ভালো মানের ব্লেড প্রস্তুত করতে পারত না, এখন তারা চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পানির অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমাদের বিজ্ঞানচর্চার একদম গোড়ায়ই রয়েছে মারাত্মক গলদ। একটি উদাহরণ দিই। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭৫ নম্বর লিখিত পরীক্ষায় রেখে বাকি ২৫ নম্বর প্র্যাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় চারটি বিষয়ের জন্য ১০০ নম্বর থাকে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী জানেন, ২৫ নম্বরের ব্যবহারিক পরীক্ষায় সারা দেশে কী ঘটে। অধিকাংশ স্কুল-কলেজে কোনো বিজ্ঞানাগার নেই। অতি স্বল্পসংখ্যক স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানাগার থাকলেও সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি নেই বললেই চলে। আর যদিওবা কিছু সরঞ্জমাদি থেকে থাকে, তার মধ্যে অধিকাংশই অকেজো। যে বয়সে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রচণ্ড কৌতূহল থাকে, সে বয়সে তারা বিদ্যায়তনিক পরিবেশে গবেষণা করার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। কারণ তাদের জন্য হাতে-কলমে কাজ করার, বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করার কোনো উপকরণ থাকে না। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠানে সামান্য উপকরণ আছে, সেখানেও সত্যিকার অর্থে কোনো প্র্যাকটিক্যাল সম্পন্ন হয় না। আর যদিওবা হয়, তার সীমা ৫০-৬০ বছর আগে যে তেলাপোকা ও ব্যাঙ কর্তন ছিল, আজও তাই আছে।
আর আছে প্র্যাকটিক্যাল-পরবর্তী খাতা প্রস্তুত করা। এখন ব্যবহারিক কোনো কাজ না হলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়ের ছবিসংবলিত চারটি খাতা প্রস্তুত করে শিক্ষকের কাছে উপস্থাপন করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতাগুলোও শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে প্রস্তুত করতে হয় না, কোনো রকম ছবি আঁকতে হয় না। একশ্রেণির পেশাদার লোক গজিয়েছে। এরা টাকার বিনিময়ে খাতাগুলো প্রস্তুত করে দেয়। আর শিক্ষকরা ওই খাতাগুলো দেখে লাল কালির দাগ দিয়ে দেন। চূড়ান্ত পরীক্ষায় খাতাগুলো প্রদর্শন করা হয় মাত্র। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় কোনো ল্যাবে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় না। পরীক্ষার সেন্টার থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই টাকার বিনিময়ে তাদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় নম্বর প্রদান করা হয়। এই চিত্র সব পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য একই। তবে কোথাও কোথাও এর ব্যতিক্রম আছে, সর্বত্র টাকা নেয়া হয় না। কিন্তু নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বত্র একই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অনেকেই লিখিত পরীক্ষায় ৭৫ নম্বরের মধ্যে ২৫ কিংবা ৩০ নম্বর পেলেও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় তারা ২৫ নম্বরের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ নম্বর পেয়ে যায়। এভাবে যে শিক্ষার্থী ৭৫ নম্বরের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বর পায়, সে যেমন ২৫ নম্বরের প্র্যাকটিক্যালে ২০ বা ২২ বা ২৫ নম্বর পায়, তেমনি যে শিক্ষার্থী ৭৫ নম্বরের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় ২৭, ৩০ বা ৩৩ পায়, সেও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ২৫-এর মধ্যে ২০, ২২ বা ২৫ পেয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালো ছাত্র টাকা দিতে পারেনি বলে লিখিত পরীক্ষায় ষাটোর্ধ্ব নম্বর পেয়েও প্র্যাকটিক্যালে ১০-১২ নম্বর পেয়ে যেতে পারে। কারণ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক জানেন না ওই শিক্ষার্থী ছাত্র হিসেবে কেমন। এসব জানার প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ জবাবদিহি বলতে কিছু নেই।
প্র্যাকটিক্যালের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই ঘটনা ঘটে। কে অতি উত্তম শিক্ষার্থী, কে দুর্বল শিক্ষার্থী, তার কোনো রকম বাছবিচার না করে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় প্রত্যেককে প্রায় সমান নম্বর প্রদান করা হয়। ছয় দশক ধরে বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এই চরম অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। এগুলো দেখার জন্য কোনো লোক নেই, কথা বলার কোনো লোক নেই, প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধ করার কোনো লোক নেই। ফলে আমাদের দেশের বিজ্ঞানচর্চা যা হওয়ার তাই হয়েছে। সেই শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীরা বুঝে যায়, প্র্যাকটিক্যাল মানে একটি ভুয়া বিষয়, ফাও নম্বর পাওয়া।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই যে অরাজকতা শুরু হলো, শিক্ষার্থীদের মনে ও মননের জগতে বিজ্ঞান গবেষণার প্রতি যে অবিশ্বাস তৈরি হলো, বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য যে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হলো তাকে, এই পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব তার অবচেতনে চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়। গবেষণাকে সে আর কখনোই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না।
গবেষণার নামে এই প্রহসন সবচেয়ে ভয়াবহ রূপে লক্ষ করা যায় কলেজগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিজ্ঞানবিষয়ক অনার্স ও মাস্টার্সের কোর্সগুলোতে। সেখানে গবেষণাগার বলতে তেমন কিছু নেই। ফলে সিংহভাগ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শুধু লিখিত পরীক্ষার ভেতর দিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্যই শিক্ষার্থীরা গবেষণাগারে যায় এবং শিক্ষকদের নির্দেশনা অনুযায়ী গবেষণার কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর বাইরে নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য নিবিড় কোনো গবেষণার ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। অর্থাৎ আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার ও বিজ্ঞান গবেষণার সামগ্রিক বিষয়টি পরীক্ষানির্ভর। পরীক্ষায় পাসের জন্য পরিচালিত হয়ে আসছে আমাদের বিজ্ঞান পড়াশোনা। ফলে অনিবার্যভাবে স্বাধীনতার ৫২-৫৩ বছর পরও বাংলাদেশ বিজ্ঞান গবেষণায় তেমন কোনো অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের দেশেও বিজ্ঞান শিক্ষা, গবেষণা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আর তার জন্যই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, খ্যাতিমান শিক্ষক ও পণ্ডিতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। আর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেয়া সেই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটি যে কেউ পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষা, গবেষণা ও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখনো শুধু সন-তারিখ এবং যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিষয় পরিবর্তন করে ওই রিপোর্টটি বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশ আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিস্ময়কর অগ্রগতি লাভ করবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের ওই রিপোর্টটি বাস্তবায়নে আমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি। এবং আরও পরিতাপের বিষয় এই যে, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটিকে ভিত্তি করে পরবর্তী পর্যায়ের কমিশনগুলো যেসব রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে, তার কোনোটিই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের যে রিপোর্টটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলো, সেই রিপোর্টও আমরা সিংহভাগই বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা যে আঁধারে ছিল সেই আঁধারেই রয়ে গেছে। আর এর শুরুটা এখনো হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার সূচনালগ্নে। গোড়ায় যখন এতটা গলদ, তখন বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার নিয়তি কী হবে, তা আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। এই পরিস্থিতি বদলাতে না পারলে সমন্বিত টেকসই উন্নয়ন কোনো দিন সম্ভব হবে না।