প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
চাঁদপুর। বর্ণমালার আলোকিত ভুবনে চাঁদের হাটে তারার মেলায় চাঁদ সওদাগর, দোনাগাজী, সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান পাটোয়ারী ও মেজর রফিকুল ইসলাম, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, ডাঃ দীপু মনি, ডাঃ সৈয়দা বদরুননাহার চৌধুরী প্রমুখ শব্দের সীমাবদ্ধতায় সংক্ষিপ্তকরণ হলো। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা থাকায় বিশেষ করে নদী ও ট্রেনপথ ব্রিটিশ যুগ থেকে চাঁদপুর ট্রানজিট রূট হিসেবে খ্যাত। চরণধূলা দিয়ে প্রাণের শহরকে ধন্য করেছেন- বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, বাংলার বাঘখ্যাত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই জেলাতে আমার জন্ম দুষ্টুমি, শিক্ষাকর্ম, যৌবনের পালতোলা হাওয়ায় মিশে আছে অজস্র স্মৃতিরমালা।
চাঁদপুর নিয়ে গৌরবান্বিত বোধের প্রথম উপলব্ধি কিশোর বয়সে। দাদা আলহাজ্ব সৈয়দ আলী ভূঁইয়ার সাথে জেঠাতো বোন নাজমা আপার বাসা গাজীপুরের উদ্দেশ্যে সদরঘাট থেকে বাসে উঠি। সিট না পাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছি দাদা-নাতি। দাদা লম্বা-চূড়া সুঠাম দেহের অধিকারী। আমি ছোট মানুষ। আমাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় দাদা অশস্তি বোধ করছেন। পথিমধ্যে বাসের সিটে বসা মধ্য বয়স্ক এক যাত্রী দাদাকে বললেন, চাচা যাবেন কোথায়? বাড়ি কোথায়? দাদা বললেন, যাব নাতনির কাছে গাজীপুর। আমার বাড়ি চাঁদপুর। সিটে বসা ভদ্রলোক যাত্রী সমস্বরে বললেন, চাঁদপুর! আ রে প্রধানমন্ত্রীর এলাকার লোক (ওই সময় রানিং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী)। চাচা চাচা বসেন বসেন। দাদা সৌজন্যতায় বসতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও ভদ্রলোক দাদাকে নিজ হাতে বসিয়ে দিলেন। উপস্থিত যাত্রীরাও আমাদের সম্মানের চোখে দেখলেন। চাঁদপুর নিয়ে ভাবনার জগতে গর্ব ও আত্মতুষ্টির অনুভূতির ‘শিক্ষা বীজ’ ঐ মুহূর্তে হৃদয়ের জমিনে গ্রোথিত হয়; একজন সফল ব্যক্তি একটি জেলার প্রতিচ্ছবি।
২০১১/১২ সালে ব্যাংকিং কাজে সচিবালয়ে যাই। বাড়ি চাঁদপুর শোনার সাথে সাথে সচিব সাহেবের শারীরিক মোটিভ পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্যাংকিং নিয়মে সুদ মওকুফ (ঋণ) বিষয়ে করণীয় একটি গাইডলাইন দিলেন। ভিজিটিং কার্ড হাতে দিয়ে বললেন, সচিবালয়ে আসলে ফোন দিয়ে আসবেন। আমি খুশি। মহাখুশি। এই যেনো না চাইতে চাঁদ হাতে পাওয়া। এই সম্মান-সুযোগ-সুবিধা প্রিয় চাঁদপুর নামক শব্দের প্রীতি-প্রতিদান। সচিব সাহেবের বাড়ি ফরিদগঞ্জ।
এক প্রয়াত চাচা কালিবাড়ি সংলগ্ন রেলের কোয়ার্টারে থাকতেন। রেল স্টেশনের পশ্চিম অংশে ইলিশ মাছের জমজমাট কেনাবেচা ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বরফ ভাঙ্গা হতো। বরফ টুকরো লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম। কী যে মজা পেতাম ছোট বেলায়। বরফ খাওয়া অস্বাস্থ্যকর হলেও ইলিশের ভাসমান সুরক্ষায় বরফ আজো অদ্বিতীয় ভূমিকায়। চাঁদপুরের ইলিশের সুখ্যাতি টইটুম্বর। আমার বাবা মরহুম উমেদ আলী ভূঁইয়া ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদার। প্রায়ই বলতেন, ইলিশ ও চিংড়ি মাছ নিয়ে কুমিল্লা- ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার/অফিসারের বাসায় যেতেন। চাঁদপুরের ইলিশ কঠিন কাজকে সহজলভ্য করে দেয়। কুটনৈতিক জোয়ার-ভাটায় মাছের রাজা ইলিশ এখন ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে জলে-স্থলে-আকাশে। ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আনন্দ বিনোদনে ভোজন বিলাসিতায়।
চাঁদপুর সরকারি কলেজ। শিক্ষা ও ঐতিহ্যের বটমূল। জেলার সিকিকোটি মানুষের মেলবন্ধন সূচিত হয় এই কলেজকে ঘিরেই। রাজনীতিবিদ ডাঃ দীপু মনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী। চাঁদপুরের রাষ্ট্রীয় অলঙ্কার। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক পুলিশপ্রধান জাবেদ পাটোয়ারী সিক্ত করেছেন প্রিয় ভূমিকে। চৌষট্টি জেলার ইতিহাসে চাঁদপুর আজ কবি-কবিতাণ্ডগল্পে ছন্দের ঊর্বর ভূমি। উপজেলার মধ্যে ফরিদগঞ্জ সাহিত্য চর্চায় অগ্রগামী। ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরামের সূতিকাগার। জল ও জোস্নায় শস্য-শ্যামল চাঁদপুর পত্র-পত্রিকায় ভরপুর। তরুণ গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান চাঁদপুরের ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা প্রাণের শহরকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। খোদণ্ডরাজধানী ঢাকা জেলা নিয়ে এমন নিবিড় ইতিহাস চর্চা হয়েছে কিনা তা অবগত নই। গবেষক ফরিদ হাসানের গবেষণার ফসল চাঁদপুর পৌরসভার জন্ম ইতিহাসের দালিলিক প্রমাণ। বিদেশ ভুবনেও নিরলস কর্ম করে অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন প্রয়াসে সমৃদ্ধ করেছেন চাঁদপুরের গর্বিত সন্তানরা। ইতালির রোমে অবস্থান করেও জমির হোসেন জানান দিচ্ছেন একখণ্ড চাঁদপুর ভূমিকায়।
সংস্কৃতি চর্চার আঁতুরঘর অতীতের টাউন হল, বর্তমানের শিল্পকলা একাডেমি, সাহিত্য একাডেমি, মানবতার কল্যাণে রেডক্রিসেন্ট ভবন, রোটারী ক্লাব, প্রেসক্লাব ও প্রেসক্লাব ভবনসহ বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম বহু রূপে রূপায়িত করেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পুরাণবাজারে স্টার আলকায়েদ ও ডব্লিউ রহমান জুট মিল, লবণ ও ডালের মিলের আধিক্য ছিলো। লবণ প্রক্রিয়াকরণ বিলুপ্তিতে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নিভু নিভু অবস্থা। ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরাণবাজারের পাইকারি ভোগ্যপণ্য ব্যবসাযীরা। প্রসাধনী ও পোশাক বিনোদনে কালিবাড়ি এরিয়ায় হকার্স মার্কেট, হাকিম প্লাজা, পূরবী ও মীর শপিং, বিউটি স্টোর, বাস স্ট্যান্ডের ফয়সাল শপিং কমপ্লেক্স, বাবুরহাটে ভূঁইয়া সুপার মার্কেট অনন্য। হেভেনের মিষ্টান্ন আজও মুখে মুখে সমাদৃত। অন্য জেলা থেকে আগত কর্মণ্ডচাকুরীজীবিরা চাঁদপুরের মৌ মৌ ঘ্রাণে বিভোর হয়ে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেন। পাশর্^বর্তী জেলার বাসিন্দাগণ ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা-চিকিৎসায় প্রাণচাঞ্চল্যে আপন মনে জড়িয়ে রাখেন চাঁদপুরের উদারতা।
জেলার যোগাযোগ ব্যস্থায় বাবুরহাট হলো মধ্যবর্তী স্থান। সকল উপজেলায় সহজে যাতায়াত করা যায় বলে সরকারি কর্মযজ্ঞ এখানে ধাবিত হচ্ছে। বিসিক শিল্প নগরী, জেলা পরিষদ, পুলিশ লাইন, জেলা কারাগার, যুব উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (অস্থায়ী), উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (নির্মাণাধীন), সরকারি শিশু পরিবার উল্লেখযোগ্য। শতবর্ষের অধিক স্থাপনায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি লেখার ঠিকানা; বাবুরহাট হাই স্কুল এবং ড্যাফোডিলের গ্রুপের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একাধিক কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সয়লাভ বাবুরহাট এখন উপশহর থেকে শহরের খ্যাতির দৌড়ে। আমার চোখের পলকে যেন রূপান্তর হয়ে গেল বাবুরহাট। নৌকা দিয়ে মালামাল আনা-নেয়া করতাম। ক্রেতাও দূর-দুরান্ত থেকে আসতো। নদীমাতৃক ঐতিহ্যে বাহনে সর্বশেষ সাক্ষী বহনকারী আমিও একজন। বাবুরহাট-মতলব রোডের রাস্তার দু পাশে আশির দশকে কলাগাছ, কলমিলতা ছিল। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগ রেন্ডিকড়ই গাছ রোপণ করে। সড়কের দু পাশে সারি সারি গাছের ছায়াশীতলে জনসাধারণ চলাচল করত, স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য হারানোর ন্যায় সড়কের প্রশস্ততায় বৃক্ষের ছায়াবিহীন মাইলের পর মাইল এখন সড়ক। ভুষামালের জমজমাট কেনাবেচা হতো বাবুরহাট বাজারে। সাপ্তাহিক হাট রবি ও বৃহস্পতিবার ক্রেতা সাধারণের সমাগমে দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে ঘম ঘম আওয়াজ শোনা যেত। আমার শ্বশুর সাত্তার মাল চাকরির পাশাপাশি ভুষামালের ব্যবসা করতেন। একজন জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন। যা আজ অতীত ইতিহাস। বাবুরহাট বাজারে এখন প্রতিদিন শহুরে হাটের বাজনা বাজে। বাবুরহাট নিয়ে একটি মিথ আছে, এ অঞ্চলে এক সময় নদী ছিলো। সেই নদীর উপর এখন আমারা ভাসমান! সত্য-মিথ্যার নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য আমার চোখে পড়ে না। তবে উৎকণ্ঠায় আছি, একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নদীর রূক্ষ্ম আচরণে বিলীন হয়ে যাবে চাঁদপুর! অর্থাৎ বিলুপ্ত হয়ে যাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় চাঁদপুর। নদী-জলে প্রকৃতির শোভায় বিমোহিত আমরা। এই নদীর জলরাশিতে জড়িয়ে আছে আহার বিনোদন-কর্ম ঘণ্টা। এই নদী ইলিশের বাড়ি উপাধি দিয়েছে। আবার এই নদীর জলের নিষ্ঠুরতম আচরণে কান্না শুনতে হয়। রাক্ষুসে নদী গিলে খেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, বসতভিটা, আমাদের সমাজ। নদীর এ কুল ভাঙ্গে, ও কুল গড়ে, এইতো নদীর খেলা। এই খেলায় তলিয়ে গেছে অজস্র বুকভড়া ইতিহাস। আমার ভূঁইয়া বংশের আদি বাসস্থান সফরমালী এলাকায় মুরব্বিদের মুখ থেকে শোনা। আমার দাদার দাদাও দেখেন নাই। নদীর করালগ্রাসে বংশের আপনজনরা ভাঙ্গনে ছিন্ন ভিন্ন। চাঁদপুরের ট্রাক রোড, কুমিল্লা ও না জানা অন্য স্থানে বসতি স্থাপন করেন। ট্রাক রোডের ভূঁইয়া পরিবারে আমার এক চাচা বিয়ে করার সুবাদে মুরব্বিদের খোশগল্পে উঠে আসে আমরা একই বৃত্তের। প্রকৃতিকে দ্বায় দিয়ে আমরা ভুলে যাই দুঃস্বপ্ন। খড়কুটো আকড়ে অসীম আকাশের নিচে কোন এক টুকরো ভূমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তব্ওু ভুলতে পারিনি প্রিয় জন্ম ঠিকানা। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরবর্তী প্রজন্মকে। যেন ভুলে না যায় মাটি ও জলের বন্ধনের নিশানা। এই ভাবেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি কলম্বাসের ন্যায় অনুসন্ধিৎসাহী মানসপটে জাগরিত থাকবে প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় জন্ম ভিটা-মাটি সোনালি রোদ্রজ্জল চাঁদপুর।
বীর বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে স্মৃতি চারণে বিজয়ের মাসব্যাপী বিজয় মেলা গণমানুষে মুখরিত এখন চাঁদপুরের স্মারক ঐতিহ্য। ইতিহাস জাগরণে-সংস্কৃতি বিকাশে-বিনোদন উৎসবে চাঁদপুরবাসী একাকার হয়ে যায়। রাজনীতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও ধর্মীয় সমাবেশের কালের সাক্ষি হাসান আলী মাঠ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ ও স্টেডিয়াম মাঠ, বাবুরহাট হাইস্কুল মাঠ আজো সরগরম।
প্রাণের শহরে প্রাণ আছে বলেই, ঘাত-প্রতিঘাত দুঃখণ্ডযন্ত্রণা প্রেয়সীর মান-অভিমানে দোদুল্যমান হলেও চাঁদপুর মোলহেড ত্রি-নদীর মোহনায় নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে, নির্মল বাতাসে, মোহনীয় সূর্যাস্তে -উন্মুক্ত স্নানে অভিভূত হয়ে ভুলে যাই অতীত গ্লানি। মিশে যাই মায়ার বন্ধনে। স্নেহের পরশে। ভালবাসার জয় ধ্বনিতে-কর্ম উৎসবে মেতে উঠি প্রাণের শহর চাঁদপুরের মাটি মানুষের তৃষ্ণায়।