প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
শহরটি অচীন নয়, যেনো শহরের মানুষগুলোই অচীন। নেই কোনো কোলাহল, আছে শুধুই না পাওয়ার শত যন্ত্রণা। তবে হ্যাঁ প্রাপ্তিও কম নয়। চলতে চলতে নানাজনের সাথে দেখা হলো, চেনা হলো। শুধুই চেনা হলো না-মানুষের ভেতরের রূপটি।
শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আঁকা-বাঁকা নদী, আর এই নদীতে কোনো কোলাহল। নিঃশব্দে বয়ে চলেছে অবিরত। এই চলার কোনো শেষ নেই। নদীর দুপাড়ে সারি সারি পাকা বাড়ি। আর এসব বাড়িতেও লুকিয়ে কত না পাওয়া না পাওয়ার বেদনা।
কখন যে অচেনা মানুষটি এই শহরে এলো, তা হিসেবে করে কী লাভ। নিজেকে রক্ষার জন্য, নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়ার জন্য কত রকমের চেষ্টা। চেষ্টায় চেষ্টায় আজ বড্ড ক্লান্ত মানুষটি। শুরুর জীবনে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা শুরু। হঠাৎ পথ চলতে চলতে, নিজের আশ্রয়ে ঠাঁই ওই ভদ্র পল্লীতে সেখানে পড়াশোনা ও আহার দুটো মিলে গেলো। গল্পের শুরুটা সেখানেই হয়তো শেষ হতে পারতো কিন্তু সে শুরুর দিকেই শেষ করা যায়। নদীর পাড়ে শান্ত কোমল নিবিড় বাতাস। নদীর গর্জন সবকিছু একটু অন্য শহরের চেয়ে আলাদা। এখানে এসে পাঠক হৃদয় সহজেই তার সুখ অনুভব করে। এই সুখ কারো জন্য সাময়িক আবার কারো জন্য অসীমতায় ভরপুর। শব্দের কথামালা গেঁথে দেয়া যায় আনমনে। অথবা ছবির আলবামে সাজিয়ে মনের মণিকোঠায় স্মৃতি হিসেবেও রেখে দেয়া যায়। শান্ত সুনিবিড়, ছায়াঘেরা তিনদিকে জলস্থলের মিলনে অপরূপ এক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। এখানেই আবার কত স্মৃতি, কত কোমল হৃদয়ে রক্ত জমাট বেঁধেছে আবার কত কোমল হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে তা কি কেউ হিসেবে রাখে। আবার কেউ সারাজীবনের জন্যে এই ক্ষত বয়ে বেড়ায়। এখানে নিবিড় এক রাতে ক্লান্ত ও স্বপ্নবাজ মানুষের আড্ডায় হৃদয়ে এতো রক্তক্ষরণ হবে তা কে জানতো।
দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার ২০০৩ সালের জুলাই মাসের ৮ তারিখ। এই শহরের একটি কালো অধ্যায়। অনেক মানুষের আশার রক্তক্ষরণ। অনেক মানুষের করুণ আর্তনাদ। আবার প্রত্যক্ষদর্শীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। শান্ত নিবিড় বাতাসের নদীর ঘূর্ণিপাকের ব্যাকুলতা মনে এখনই সবকিছু ভেঙ্গে-চুরে দিবে। আবার সেই কুল-কুল ধ্বনিও কানে আসে। এই স্থানের কত স্বপ্ন ভেসে গেছে সেই করালগ্রাসে তার হিসাব নেই। সেদিন রাজধানীর কোলাহল থেকে বেড়িয়ে মানুষ ছুটে এসেছিলো আপন গন্তব্যে। তাদের সংখ্যা ৮ শতাধিকেরও বেশি হবে। তারা নদীতে ভেসে এসেছিলো এক রিদম গতিতে। এমভি নাসরিন লঞ্চ রাজধানী থেকে নদীর আঁকাবাঁকা কলকল ধ্বনি পেরিয়ে এসেছে এই স্মৃতিময় জায়গা, এই শহরের স্বপ্ন যেখানে রচিত হয় যেখানে আবার সেখানেই স্বপ্নের সমাধিও হলো। ভয়ে গা শিউরে উঠে এখনো আঁতকে উঠে সে স্বজনহারা মানুষ করুণ আর্তনাদ। অনেকে মনে নানা স্বপ্নও দেখছিলো- কেউ মায়ের হাতের স্নেহমাখা খাবার খাবে, আবার কেউ মেহেদী রাঙা বউয়ের গল্পে ভেসে যাবে। সন্তান তার পিতার বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে হয়তো বলবে বাবা তুমি এতোদিন পরে কেনো এলে। অনেক অনেক স্বপ্নরা ভাসা বেঁধেছিলো। কিন্তু কোথায় সে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো তারা কি স্বর্গসুখে মত্ত হয়ে আছে? নদীর বাঁক পেরুতেই যে স্বপ্নের সলিল সমাধি হলো। ভোলার লালমোহনগামী লঞ্চ এমভি নাসরিনে এতো স্বপ্নের সলিল সমাধি হলো। শহরের নিবিড়-শান্ত পরিবেশটি কেনো এতো রূদ্রমূর্তি ধারণ করলো। মুহূর্তে বাঁচার করুণ আর্তনাদ। ছুটে গেলোও অসংখ্যা নৌযান। অনেকে জীবন বাঁচানো গেলো আবার অনেকেই ¯্রােতের টানে ভেসে গেলো। একবারও কি সেই স্বপ্নবাজদের কথা মনে পড়েনি? না পড়েনি। যদি পরতো তাহলে এতো স্বপ্নের সমাধি হতো না। ইতিহাসের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সেদিন দেখেছিলো এই শহরের মানুষগুলো। দীর্ঘ লাশের সারি, কতদিন সেখানে লাশে গন্ধ ভেসে এসেছে। কত লোক অজানা আতঙ্কে ঘুমের ঘোরে শিউরে উঠেছে। এই লাশের সারির ঠাঁই হলো সেই গণকবরে। কারণ তাদের চেহারাতো ছিলো বিকৃত। চেনার কোনো উপায় ছিলো না ভাই-ভ্রাতাদের। নববধূর মেহেদীর রঙ লেগেছিলো কত স্বপ্ন নিয়ে তারা বেঁধেছিলো ঘর সেটিও মুহূর্তে শেষ। একই পরিবারের সবাই এক সাথে পাড়ি জমালো না-ফেরার দেশে রইলো না ঘরের প্রদীপ জ্বালানো মতো কেউ। প্রাণ হারালো অন্তত ৪ শতাধিক। কেউ হারালো বাবাকে, কেউ হারালো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা মনে করে আজো আঁতকে উঠে ঘুমের ঘোরে স্বজনহারা মানুষরা। থামেনি স্বজন হারাদের আর্তচিৎকার। অনেকে আজো এখানে এসে স্বজন হারাদের জন্য অশ্রুসজল করে।
স্বজনহারা অনেকে ভোলার চরফ্যাশন ও লালমোহনগামী। আজও থামেনি স্বজনহারাদের কান্না। ভয়াবহ সে স্মৃতির কথা মনে করেন আজও কত জানা-অজানা মানুষ। থামেনি নদীর কলকল ধ্বনি, থামেনি সেই মৃদু-মন্দ বাতাস। কিন্তু স্মৃতিতে আজও জমাট বেঁধে আছে সেই করুণ কাহিনি।
এই নৈসর্গিক পরিবেশ হয়ে উঠুক আরো বেশি নৈসর্গিক বেড়ে উঠুক আগামীর স্বপ্নবাজরা। তবে শহরে সেই গল্পতো আর শেষ হবে না। শেষ হবে না স্মৃতিতে জমানো কত না বলা কথা।
উজ্জ্বল হোসাইন : লেখক ও সংগঠক।