প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০০:০০
আমার শহর, আমার নিঃশ্বাসের শহর। আমার ঝুম বৃষ্টির পরশ ছুঁয়ে যাওয়া শহর। আমার প্রথম প্রেমপত্র পাওয়ার শহর। আমার শৈশবের উচ্ছ্বাস মাখানো শহর। আমার কৈশোরের সোনালি আভার সাতটি মহাদেশ ধারণ করার শহর। সেই শহরটা চাঁদপুর।
কে বড় হয়েছে? আমি, না আমার শহর? নদীতে বয়ে চলা জলের মতো শুদ্ধ সময়গুলো এগিয়ে গিয়েছে। নীরবতার অপার সাগরে নিমজ্জিত জলে আলোড়ন ছুঁয়েছে। শহর বড় হয়েছে, হারিয়েছে মায়ার ভুবন।
আমাদের সময় ৯০, সকালে ছেলে-মেয়ে সবাই একাই স্কুলে যেতো। রাস্তায় রিকশা ছাড়া তেমন কোন যানবাহন ছিল না। বাবা মায়েরাও নিশ্চিত ছিল। পড়াশোনা নিয়েও এতোটা চাপ ছিল না।
শহরটা আসলে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারত। রাতে ঘুমাতেও পারত। না, শহরের দোষ নেই। মানুষ শহরমুখি হয়েছে। তাদের প্রয়োজনে দোকান-পাট, রাস্তা, যানবাহন, হাসপাতাল কত কিছু...। তারপরও এ আমার প্রাণের প্রস্ফুটন। এখানে এখনও নদীর পাড়ে টঙ্গের দোকানে চা খেতে খেতে নদীর জলে মন ডুবিয়ে দেয়া যায়। এখানে এখনো ওয়ান মিনিটের আইসক্রিম খাওয়ার মতো আয়োজন হয়। এ শহরের মানুষের ঘরে তাজা ইলিশের গন্ধে মন উচাটন হয়।
এ শহর আমার মতো অনেকের স্মৃতির শহর। এ শহরকে আমরা আমাদের সাথে বড় হতে দেখছি। এ-র চারপাশের নদীর বসবাস। বিশাল নদীর উপর বিশাল আকাশ। নদীর বুকে জেগে উঠা চর। ধানের মৌসুমে সবুজের গল্পে আলোরা জীবনের রং বয়ে আনে। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এটা অন্য রকম অনুভব।
কারো খুব গভীর মন খারাপ হলে চলে যাওয়া যায় পুরাণবাজার। আনমনে হেঁটে চলা যায় নদীর তীরঘেঁষে। বসে থাকুন চাঁদের নরম আলোর মুগ্ধতা নিয়ে। গভীর অনুভব নিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের স্পর্শ আপনাকে নিয়ে যাবে, আপনার ভেতরের আলোকময় আয়নায়। তাতে শুধু আপনার হারিয়ে যাওয়া সময়, বন্ধু, নিজের ভালোবাসা আর নিজের জন্য একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে দেবে।
কে কাকে তৈরি করে? শহর মানুষকে, না মানুষ শহরকে? আমার মনে হয় দুটোই দুটোকে। মানুষের শহরের শুধু বসবাস নয়। থাকে স্মৃতি। থাকে আত্মার কথোপকথন। মানুষ বড় হয়, বাবা-মা হয়। কিন্তু যে শহরে তার জন্ম, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা। যে শহরে তার প্রেমিকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। সেটা তার কাছে শহর নয়, সেটা তার আত্মার অভয়ারণ্যে হেঁটে চলা।
চাঁদপুর সবার মতো আমার শহর, আমার কাছে সেরা। কিন্তু এখানে বড় হওয়া মানুষগুলো সাহসী হয়। হয়ত জোয়ার-ভাটার জলে গড়ে উঠে তাই। একটা গল্প পড়েছিলাম। না গল্প নয়, সত্যি। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্য। কাছিমের বাচ্চারা জন্মের পর সমুদ্রে নেমে যায়। বড় হতে হতে এক সময় এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরেও চলে যায়। কিন্তু যখন তাদের প্রজনন সময় আসে তখন তারা দলবেঁধে ফিরতে শুরু করে তাদের জন্মস্থানের দিকে। তাদের কোন কম্পাস থাকে না। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় তারা, তা-ও গভীর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে। যেখানে আলোর উপস্থিত খুব কম। তারপর একদিন ঠিক পৌঁছে যায় নিজের চেনা সমুদ্রতটে। নিজের প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে। আমার শহর আমার কাছে ঠিক এমনটাই। প্রিয় চাঁদপুর তুমি আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং শেষ আশ্রয়। ভালোবাসি তোমাকে কচ্ছপের মতোই।