বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

‘স্যার’ সম্বোধন-ইনফিরিওর কমপ্লেক্সিটি
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

অফিসের কর্মকর্তাদের স্যার বলতে বাধ্য করা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। রাষ্ট্রের সব কর্মচারী, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয় প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের ট্যাক্সের মাধ্যমে। সেই হিসেবে কর্মকর্তা যতই বড় হোক না কেন, তার বেতন যেহেতু জনগণের টাকায়ই হয়, তাহলে কার কাকে স্যার বলা উচিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্পোরেট ও বেসরকারি অফিসে গ্রাহককে (সেবা গ্রহীতাকে) স্যার বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়।

তাদের যুক্তি, যেহেতু গ্রাহক সেবার জন্য টাকা খরচ করছে, সে কারণে কর্পোরেটের বড় অফিসারও তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেন। একই নিয়ম সরকারি অফিসেও হওয়া উচিত ছিল। বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টো। সেবার মান যাই হোক, সরকারি কর্মচারীরা যে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে স্যার শব্দটি শুনতে চান- এর পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কারণ। তিনি যদি মনে করেন যে, তাকে স্যার বলতেই হবে, না হলে তিনি সেবা দেবেন না কিংবা স্যার না বললে তিনি ক্ষুব্ধ হবেন তাহলে সেটি ওই সম্বোধিত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মানসিক দৈন্য।

সম্প্রতি স্যার বলা না বলা নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে, এমন সময় মতলব উত্তর উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ কুদ্দুস তাকে স্যার না বলার নোটিস ঝুলিয়েছেন অফিসের সামনে। যাদের ভোটে তিনি আজ চেয়ারম্যান, তিনি মনে করেন এই সম্মান পাওয়ার যোগ্য ওই ভোটাররাই। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ এটি। এই ভাবনাটা অন্যদের বেলায় কেন আসে না? দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের মতে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা প্রার্থী নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার কথা।

কিন্তু ‘কলোনিয়াল লিগ্যাসির’ ধারাবাহিকতায় আমরা একে অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার করে তুলেছি। লক্ষ্য করলাম, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে স্যার বলতে বাধ্য করছেন একজন ডিসি। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। যশোরের অভয়নগরের কৃষি কর্মকর্তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তেড়ে আসেন এক সাংবাদিকের ওপর এবং স্মরণ করিয়ে দেন যে, একজন বিসিএস ক্যাডারের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয়! সুনামগঞ্জেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ‘স্যার’ না বলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ওপর ক্ষেপে যান নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার ওসি।

একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি মনে করেন তিনি খুব মেধাবী এবং সে কারণে তাকে স্যার বলে সম্মান করতেই হবে, সেই মানসিকতা দূর করতে পারলে সকল বিতর্কের অবসান হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যার যার অবস্থান থেকে সবাই মেধাবী। কৃষক ফসল ফলাতে মেধাবী, শ্রমিক কারখানার কাজে মেধাবী, ড্রাইভার গাড়ি চালাতে মেধাবী, কাজের বুয়া ঘর সামলাতে মেধাবী। আর শিক্ষক, যিনি সকলকে শিক্ষিত করেছেন, তিনিও মেধাবী। তারা সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সবার সবাইকে সম্মানের চোখে দেখা উচিত।

ইউরোপ আমেরিকায় অধঃস্তন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমনকি শিক্ষককেও স্যার বলে সম্বোধন করা হয় না। সেখানে তাদেরকে নাম বলে ডাকা হয় এবং তাতে তারা কোনো অসম্মান বোধ করেন না। এটা তাদের বহু বছরের অভ্যাস। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি চালু নেই। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীরা সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। যদিও কর্ম পরিপত্র বা রুলস অব বিজনেসে স্যার বলা আর না বলা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বিএসআরএফ সংলাপের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধনের কোনো রীতি নেই। দুদক চেয়ারম্যানও মনে করেন, সরকারি কর্মচারীরা জনগণের কাছ থেকে যে ‘স্যার’ সম্বোধন পেতে চান, এটি এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটি। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই স্যার বলা কিভাবে এলো, কেনইবা এর এত কদর!

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীন ১২৯৭ সালে রাজতন্ত্রের বিশেষ অবদানের জন্য ‘নাইট’ খেতাব চালুর সঙ্গে চালু করা হয় স্যার শব্দটি। ‘নাইট’ হলেন কোনো শাসক যা দেশের জন্য তার কাজের স্বীকৃতি। বিশেষ করে সামরিক কাজের জন্য, সেই শাসক বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সম্মানসূচক উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। নাইট উপাধি, যারা পান তাদের স্ত্রীদের লেডি বলে সম্বোধন করা হয়। এটাই ব্রিটিশ সংস্কৃতি। আভিজাত্য প্রকাশে, কর্তৃত্ব প্রকাশে, প্রভুত্ব প্রকাশে, শাসকদের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের প্রচলন শুরু হয়।

ব্রিটিশদের আভিজাত্য ছিল আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা এবং ভৃত্যদের প্রতি অবিচার ও শ্রেণিবিদ্বেষে পরিপূর্ণ। বর্তমানে ‘স্যার’ শব্দের সবচেয়ে বহুল ব্যবহার দেখা যায় শিক্ষাঙ্গনে, যা অনেকটা শিক্ষককে সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পুরুষ শিক্ষককে ‘স্যার’ এবং নারী শিক্ষককে ‘মিস’ (Miss) বলে ডাকার প্রচলন আজও বিদ্যমান। এরপর স্কুলের প্রধান পুরুষ হলে ‘হেড-মাস্টার’ বা ‘হেড-স্যার’ এবং নারী প্রধান হলে তাকে ‘হেড-মিস্ট্রেস’ (Head- mistress) ডাকা হয় এখনো।

তবে অভিজাত্য প্রকাশ করতে ইংরেজরা ‘ম্যাম’, ‘লর্ড’, ‘মাই লর্ড’, ‘লারনেড’, ‘ইউর অনার’ ইত্যাদি বলতেও বাধ্য করেছে প্রজাতন্ত্রের লোকদের। আবার হিন্দুস্তান আমলে বাংলায় স্যারের পরিবর্তে শিক্ষককে ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’ ‘ওস্তাদজি’ প্রভৃতি নামে সম্বোধন করা হতো, যা এখন আর তেমন শোনা যায় না। পুরনো বাংলা সিনেমায় ‘সাহেব’, ‘বেগম’, ‘মেমসাহেব বা বেগম সাহেব’, ‘ছোট সাহেব’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতে দেখা গেছে জমিদার কিংবা ঘরের কর্তা ব্যক্তিকে। যদিও ‘সাহেব’ শব্দটি আরবি ‘সাহাবী’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সঙ্গী, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধুকে বোঝায়। ইসলামে সাহাবা শব্দ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মহান সঙ্গী-সাথীদের বোঝানো হতো।

ইরানিরা যখন ভারতে এলো তখন ‘সাহাবী’ হয়ে গেল ‘সাহিব’। ইংরেজরা এদেশে আসার পর সেই ‘সাহিব’ হয়ে গেল সাহেব বা সায়েব এবং তখন তা সঙ্গী হিসেবে নয়, ‘কর্তা’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। পরিবর্তিত হয়ে ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীরা হলেন ‘মেমসাহেব’, বাঙালি বিবাহিত মহিলারা পরিচিত হলেন ‘বেগম সাহেব’ হিসেবে। জনগণ কর্তৃক ‘স্যার’, ‘মেম’, ‘সাহেব’ কিংবা বিচারালয়ে বিচারককে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারেই সংগতিবিহীন, অযথার্থ।

আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। ২১ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে বলতেন, তোমরা এদেশবাসীর চাকর ও সেবক। তাদের টাকায় তোমাদের বেতন। তাই তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করোনা ইত্যাদি। যাদের পরিশ্রমের টাকায় এই দেশ পরিচালিত হয়, তাদের কাছ থেকে জোর করে স্যার শুনে প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব আদায় করা কোনো সুশিক্ষিত স্মার্ট নাগরিকের কাজ হতে পারে না।

কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা পেলে জনগণের মন থেকে সক্রিয়ভাবেই সম্মান চলে আসে ওই কর্মকর্তার ওপর। জোর করে স্যার শোনা একেবারেই দৃষ্টিকটু। তবু বিষয়টি যেহেতু সেই ঔপনিবেশিককাল থেকে চলে আসছে, তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কে কাকে স্যার বলবে কিংবা আদৌ বলা দরকার কি না, তার একটি রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের সকল সেবা ও সম্বোধন স্বাধীনভাবেই গ্রহণ করার সুযোগ থাকা আবশ্যক।

সেবার মনোভাব এবং দেশের উন্নয়নকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এ ধরনের হীন সংস্কৃতি পরিহার করা উচিত। কোনোরকম ভোগান্তি ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজটি শেষ করে সেবা দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য ও সুসম্পর্ক তৈরি করে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে সকলের আত্মনিয়োগ করাই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়