প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের সহজাত মাধ্যম বা বাহনই হলো ভাষা। ভৌগোলিক অবস্থান ও জাতিগত তারতম্যের কারণে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার ১১১টি ভাষায় পৃথিবীর মানুষ কথা বলে। তাহলে মনে প্রশ্ন উদয় হতেই পারে যে, গবেষণা ও শিল্পের মতো জীবনহীন সত্তার আবার ভাষা কী? প্রকৃতির সৌন্দর্য বা ভারসাম্য বুঝতে কিংবা চিরচেনা পৃথিবী ছাড়িয়ে বিস্তৃত মহাবিশ্বকে চিনতে অথবা বিজ্ঞানের অবদান বিশ্লেষণ করতে গেলেও বিশেষায়িত ভাষার দরকার। এর অপর নাম ‘গণিত’। গণিত হলো বিভিন্ন ধরনের বিমূর্ত মানসিক খেলা আর গণিতবিদদের কাজ হলো এ খেলার নিয়ম বের করা। গণিত সম্পর্কে গ্যালিলিও বলেছিলেন, ‘গণিত হচ্ছে বিশেষ একটি ভাষা যে ভাষায় ঈশ্বর মহাবিশ্বকে লিখেছেন।’ গণিত শুধু ব্যতিক্রমী একটি সাংকেতিক ভাষা নয়, এটি মানুষের চিন্তা ও যুক্তি বিস্তারের একটি অনন্য ধারা। বিজ্ঞানের জন্য যা অতি প্রয়োজনীয়।
প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে অনুমানগুলোর গণিতের যুক্তিধারায় যথাযথ অঙ্গীভূত করে সেখান থেকে পরীক্ষণ সাপেক্ষে বাস্তব সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াই হলো গবেষণা। গবেষণা জগতে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, মানসম্মত গবেষণার সঙ্গে গণিতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নতুন কিছু আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষক যখন কাজ করে যান তখন তিনি বিদ্যমান নিয়মগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। বিদ্যমান নিয়মগুলোর যেমন গাণিতিক রূপ রয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে উদ্ভাবিত আবিষ্কারগুলোরও গাণিতিক মডেল থাকবে। পৃথিবীতে ঘটা যে কোনো ঘটনাবলিকে গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করার সামর্থ্যই হলো গবেষণার সবচেয়ে শক্তিশালী স্তর। গবেষণার এ শক্তি অনুভব করতে হলে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রবন্ধগুলো নিবিষ্ট মনে পড়লেই আমার কথার যথার্থতা প্রমাণিত হবে। শিল্প হলো গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রায়োগিক রূপ। তাই গণিতে অগ্রসরমাণ জাতিই শুধু শিল্পের অবিরত মান উন্নয়নে সক্ষম।
শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল এখন থেকে ২৪৫ বছর পূর্বে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়। প্রথম শিল্পবিপ্লবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গাণিতিক মডেল তৈরি করতে হয়েছিল গবেষণাগারে। ছোট পরিসরে বাস্তবায়নের পর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করা হয়েছিল। তারপর মানুষের কল্যাণে সেটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এরপর পৃথিবী দেখেছে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার, কয়লার খনি আর ইস্পাতের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পৃথিবীব্যাপী গড়ে ওঠে অনেক শিল্পশহর আর কারখানা। এর মূলে ছিল রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তার যা মানুষের চিন্তাভাবনার দ্রুততর স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতীকরণ কারখানাগুলোকে আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে বিদ্যুতের রোধ, ভোল্টেজ, কারেন্ট ইত্যাদির গাণিতিক সূত্র ও মডেল রয়েছে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল পারমাণবিক শক্তি, টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ইন্টারনেট, কম্পিউটার, টেলিযোগাযোগ ও পারমাণবিক শক্তির বিভিন্ন প্যারামিটার উপস্থাপন করার জন্য গণিত ব্যবহৃত হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে প্রযুক্তির সঙ্গে জৈব অস্তিত্বের সংমিশ্রণে এক নতুন সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, ন্যানো প্রযুক্তি যে অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা করেছে তাতে এ বিপ্লবের ব্যাপ্তি ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউটিউব দেখা হয় দৈনিক ৮৮০ কোটি বার, ই-মেইল পাঠানো হয় ২০ হাজার ৭০০ কোটি আর গুগল সার্চের সংখ্যা ৪২০ কোটি। এটি বদলে যাওয়া পৃথিবীর জীবনযাপনের চলমান চিত্র মাত্র। এ পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ওপর বিশাল প্রভাব পড়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে গণিত। প্রোগ্রামের অ্যালগরিদম মানেই কোনো সমস্যা গাণিতিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের ধাপসমূহ।
প্রযুক্তির শিক্ষক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে কোনো নতুন শিল্পের উন্মেষ ঘটে গণিতকে নির্ভর করে। যুগের অগ্রগতির সঙ্গে গবেষণা ও শিল্পায়নের নাম ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলেও এর শেকড়ের শক্তি গণিত। তাই যে জাতি গণিতে যত পারদর্শী হবে সে জাতির গবেষণা ও শিল্পের উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হবে।
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়ার্ডে ১৯৫৯-২০২২ সাল পর্যন্ত চীন ২৩ বার, রাশিয়া ১৬ বার ও আমেরিকা ৮ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ পরিসংখ্যানের প্রভাব কিন্তু কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের পারদর্শিতার ওপরও পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে প্রোগ্রামিং দক্ষতায় বিশ্বে চীন প্রথম, রাশিয়া দ্বিতীয় ও আমেরিকা ২৮তম অবস্থানে রয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশের মূল চারটি স্তম্ভ হলো—স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি। এখন থেকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হলে অবশ্যই ২০৪১ সালে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সক্ষম হব। স্মার্ট সিটিজেন বলতে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্মার্ট হলে চলবে না। উদ্ভাবনেও সমান পারদর্শী হতে হবে। এটি সম্ভব শুধু নাগরিকরা যদি অঙ্কে পারদর্শী প্রত্যয়ী জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে।
সম্প্রতি আমার এক আত্মীয় আমার কর্মস্থলে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি একটি স্বনামধন্য ইলেকট্রনিকস সংযোজন কোম্পানিতে কাজ করেন। তার কথা থেকেই জানতে পারলাম, তার কর্মস্থলে উৎপাদন শাখায় আমাদের দেশের জনবলের প্রাধান্য নেই। সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশের লোকেরা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। গণিত অলিম্পিয়ার্ড দৃশ্যমান তথ্যই বলে দেয় তাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আমাদের চেয়ে অঙ্কে অনেক এগিয়ে আছে। ২০২২ সালে প্রাপ্ত ফলাফলে আমাদের সেরা গণিতজ্ঞ শিক্ষার্থীরা পেয়েছে ১১৫। আর ভারতীয় গণিতজ্ঞরা পেয়েছে ১৬৫। চীন ২৫২ পেয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে। গবেষণাধর্মী একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিতে ৬১ শতাংশ ও গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও গণিতের শিক্ষার্থীরা বেশ দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার গণিত বিষয়ে ফলাফল যাচাই করলেই স্পষ্টভাবে তা অনুধাবন করা যায়।
গবেষণা, শিল্প ও ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রসৈনিক হতে হলে সর্বপ্রথম দরকার গণিতে পারদর্শী ও অনুরাগী জাতি। গণিতের অনুরাগ বাড়াতে গণিতের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিসহ গণিতকে জয় করার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে গণিত শেখার সঠিক কৌশল অনুসন্ধানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা দরকার। ভবিষ্যতের এমন সচেতন পদক্ষেপই আমাদের উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করবে।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।