প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই বাঙালি জাতি ভাষা শহিদদের স্মরণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শহিদ মিনারের পাদদেশেষ শহিদদের আত্মত্যাগ এ প্রজন্মের কাছে এক উজ্জ্বল ও গর্বিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন ছিলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র-জনতার যে সংগ্রাম হয়েছিলো তাই হলো ভাষা আন্দোলন। সেদিন পুলিশের নিষ্ঠুর গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক অজানা ভাষা সৈনিক। আন্দোলনে যাঁরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আব্দুর রশীদ খান তর্কবাগীশ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল মতিন প্রমুখ। ছিলেন সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বিশ্বস্ত সহচর এমএ ওয়াদুদসহ অনেকে। ছাত্রাবস্থায়ই এমএ ওয়াদুদ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি দুই দুইবার ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও একবার প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার (১৯৫৬) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯), সাপ্তাহিক ইত্তেফাক (১৯৪৯) ও দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৫৩) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি (১৯৫১) ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদেরও (১৯৫২) সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানের জন্ম থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী সৈনিক এবং হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর।
এমএ ওয়াদুদ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের অভিযোগে ১৯৪৮, ১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালে কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে তৎকালীন শাসকদের রুদ্ররোষের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন এবং একই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ওই বছর (১৯৪৯ সালে) ভুখামিছিল আন্দোলনের কারণেও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জনাব ওয়াদুদ ইত্তেফাকে কর্মাধ্যক্ষ পদে চাকরি করার সুবাদে ভাষা আন্দোলনের সমস্ত রিপোর্ট নিয়মিত ইত্তেফাকে প্রকাশ করতেন। আর এ কারণেই তাঁর উপর স্বৈরাচারী পুলিশের অত্যাচার ও নিপীড়ন বেশি হতো। পুলিশি হানায় তার বাসা তছনছ ও ছিন্নভিন্ন করা হয় এবং ১০৪ ডিগ্রি জ্বর থাকা সত্ত্বেও তাকে সেদিন গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী আন্দোলনেও জনাব ওয়াদুদ বাংলা ভাষা প্রচলন ও একুশের চেতনা বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম শহিদ দিবস উদযাপনের শোভাযাত্রাটিও পরিচালনা করেন জনাব এমএ ওয়াদুদ। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের দুর্দিনেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর্য হিসেবে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকার (১৯৭৮ সালে) তাঁকে মন্ত্রিত্বের লোভ দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ফলে আবারও তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।
নিরহংকার এই মানুষটির ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন ওয়াদুদ সাহেব। ছোট বেলা থেকেই তাঁকে অত্যান্ত ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন।’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘আবদুল ওয়াদুদ ছিলেন সেই সব মানুষের একজন যাঁরা অন্তরের প্রেরণায় ও বিবেকের তাড়নায় নিরন্তর কাজ করে যেতেন, কিন্তু কোনো প্রতিদানের আশা করতেন না, এমনকি তাঁর কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি মিললো কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হতেন না।’ আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সেই ঝড়ো উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকার রাস্তায় রিকশার মধ্যে খাকি পোশাক পরা একজন মানুষকে টিনের চোঙা হাতে কোন জনসভা বা প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা প্রচারের কাজে দেখেননি এমন লোক তখন ছিলো না বললেই চলে। এই মানুষটি এম. এ. ওয়াদুদ।’ গাফ্ফার চৌধুরী আরো লিখেছেন, ‘হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর যখন আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন নিয়ে দলের প্রবীণ ও নবীন অংশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় তখন ওয়াদুদ ভাই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ছয় দফা উত্থাপনের সময়েও ওয়াদুদ ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার একনিষ্ঠ সমর্থক।’
সাদা মনের এই মানুষটি ১৯২৫ সালের ১ আগস্ট চাঁদপুর জেলায় রাঢ়িরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল গফুর এবং মাতার নাম রহিমা খাতুন, ছিলেন মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক। এমএ ওয়াদুদ দৈনিক ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন থেকেই পত্রিকাটির প্রতিটি অগ্রযাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। কর্মজীবনে ইত্তেফাক ছাড়াও ঈগল বক্স ও বাংলাদেশ পেপার মিলসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং স্টার পাটিক্যালসের পরিচালক পদেও কাজ করেন। ১৯৮৩ সালে ২৮ আগস্ট তিনি মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। পিতার আদর্শ অনুকরণ করেই দেশের জন্য কাজ করে চলেছেন তার সুযোগ্য কন্যা শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি (এমপি) এবং পুত্র ডায়াবেটিক ফুট সার্জারি ও শল্যচিকিৎসক ডাঃ জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ। আমরা এমএ ওয়াদুদসহ সকল ভাষাবীরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিলো এমএ ওয়াদুদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এবং স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্র তাঁকে ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশ গঠনে তাঁর অবদান ছিলো অবিস্মরণীয়। তাঁর কৃতকর্মকে স্মরণীয় রাখতে অনুষ্ঠিত হয় নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। এমএ ওয়াদুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত হয় জাতীয় বিতর্ক উৎসব। করোনাকালীন দুর্যোগে চাঁদপুরবাসীর করোনা টেস্টের সুবিধার্থে উক্ত ট্রাস্টের নামে মেডিকেল ল্যাব এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির নিজস্ব অর্থায়নে। কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়, মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার এমন একজন লড়াকু সৈনিকের বাড়ি চাঁদপুরে, এটা চাঁদপুরবাসীর জন্যে যেমন গর্বের, তেমনি অহংকারের বিষয়। তাই একজন ভাষাবীর ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় রাখতে চাঁদপুরের একটি সড়কে, একটি এলাকাকে তাঁর নামে নামকরণসহ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চাঁদপুর মেডিকেল কলেজটিকে ‘ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ মেডিকেল কলেজ’ নামে নামকরণের আহ্বান জানাই।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।