প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়ার প্রধান খবরই হচ্ছে- সড়ক দুর্ঘটনা। রাস্তায় বের হলে ঘরে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশে সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানপথে ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ হাজার ১০৪ জন এবং আহত হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৩ জন। নিহতদের মধ্যে ৫ হাজার ২৪২ জন পুরুষ এবং ৯৯২ জন নারী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি।
এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। তাদের হিসাবে, প্রতিদিন সড়কে ১৭ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ২০২০ সালে দেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন।
নিহত পাঁচ হাজার ৪৩১ জনের মধ্যে ৮৭১ জন নারী ও ৬৪৯ জন শিশু। ২০১৯ সালে সড়ক, নৌ ও রেলপথে সব মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ২০১টি দুর্ঘটনায় ৮,৫৪৩ জন নিহত এবং ১৪,৩১৮ জন আহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৩ লাখের বেশি মানুষ সড়কে নিহত হন। ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাঙ্কিং অনুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১.৯০ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। এরপরই আছে যথাক্রমে লাইবেরিয়া, মালাউই, গাম্বিয়া ও টোগো। অন্যদিকে সবচেয়ে নিরাপদ সড়কের তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে সুইডেন। দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ২.৩১ শতাংশ।
উল্লেখ্য, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ইতোমধ্যে যেসব কারণ চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো হলো- ১. অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, ২. ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, ৩. জনসংখ্যার চাপ ও অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা, ৪. ট্রাফিক আইন অমান্য করে উল্টোপথে গাড়ি চালানো, ৫. অপ্রশস্ত রাস্তা, ৬. ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, ৭. অত্যধিক আত্মবিশ্বাস, ৮. মাত্রাতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, ৯. আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা (অননুমোদিত ওভারটেকিং), ১০. রাস্তার মাঝে এবং আড়াআড়িভাবে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, ১১. নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, ১২. গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকের কথা বলা, ১৩. চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা, ১৪. পথচারীদের অসতর্কতা, সরকারের পাশে অবৈধ স্থাপনা, ১৫. অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, ১৬. দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ইত্যাদি।
মূলত এসব অব্যবস্থাপনার ফলেই অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনাষ নিহত ও আহত হয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার পথচারী পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে জীবন বয়ে বেড়ায়। সড়ক দুর্ঘটনার এসব কারণের পাশে নতুন করে সংযোজিত হয়েছে অসহনীয় ধুলাবালি এবং প্রচণ্ড শীতে মাত্রাতিরিক্ত কুয়াশার ফলে ঝাপসা দেখায় গাড়ি চলাচলে অসুবিধা।
গত কয়েকদিনে ঘন কুয়াশার ফলে সড়ক ও নৌপথে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমনকি ট্রেন চলাচলসহ বিমান অবতরণেও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। প্রযুক্তির সহায়তায় কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যায়, তা নিয়ে এখনই পরিকল্পনা করা দরকার।
জার্মানির বিজ্ঞানীরা ‘উইন্ডস্ক্রিন’ নামে এক ধরনের কাচ আবিষ্কার করেছেন, যা মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও বরফমুক্ত রাখবে গাড়ির কাচ। এটি মূলত ‘ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড (আইটিও)’ নামক পদার্থের একটি ‘লোই’ অর্থাৎ লো থারমাল (এমিসিভিটি)-এর প্রলেপ, যা তাপকে ওপরে যেতে বাধা দেয়। ফলে, গাড়ির কাচটি ঠাণ্ডা হয় না এবং বরফ জমতে পারে না। তবে এটি গাড়িকে পুরোপুরি বরফমুক্ত রাখতে পারবে না।
কিন্তু সামনের রাস্তা দেখতে ড্রাইভারের যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু সহায়তা করতে পারবে। অবশ্য এটিতে রেডিও সিগন্যাল এবং মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা হয়। গাড়ির সামনে থাকা চালকের রেয়ার ভিউ আয়নায় পেছনের কিছু অংশ দেখা গেলেও একটি অংশ চোখের আড়ালে থেকে যায়। সেই অংশটিকেই ‘ব্লাইন্ড স্পট’ বলা হয়। ছোট ছোট যান যেমন সাইকেল, হোন্ডা এমনকি ঘন কুয়াশায় রিকশাও অনেক সময় ড্রাইভারের নজরে থাকে না।
‘ব্লাইন্ড স্পট’-এ এই ঘাটতি মেটাতে ‘টার্ন অ্যাসিস্টেন্ট’ নামে সেন্সরভিত্তিক এক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে জার্মানি। কোনো বাধা পেলেই এই প্রযুক্তিতে সিগন্যাল বা সংকেত (শব্দ) পাঠায় চালককে। ইউরোপীয় আইন অনুযায়ী বর্তমানে সব ধরনের ভারি যানবাহনে এই ‘টার্ন অ্যাসিস্টেন্ট’ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
এছাড়াও গুগল ম্যাপের (অ্যাপস) কথা আমরা সবাই জানি এবং ব্যবহারও করছি অনেকেই। বিশেষ করে অপরিচিত গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অ্যাপটি বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ, স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে রিয়াল ফটোগ্রাফি, রাস্তার ৩৬০ ডিগ্রি ইন্টারেক্টিভ প্যানোরামিক দৃশ্য কিংবা রিয়েল-টাইম ট্রাফিক অবস্থা, হেঁটে অথবা গাড়ি, বাইক, বিমান এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সবরকম ভ্রমণের জন্য রুট পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে গুগল ম্যাপ।
ম্যাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিউচারটি হচ্ছে- ‘স্পিড লিমিট ওয়ার্নিং’ অপশন। যখনই গাড়ির গতি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, অ্যাপটির মাধ্যমে নোটিফিকেশন প্রদর্শিত হতে থাকবে, ম্যাপের স্পিডোমিটার রং পরিবর্তন হতে থাকবে এবং গাড়ির চালক সতর্ক হবে। এটুআই, আইসিটি ডিভিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি ও সিএসসি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রতিনিয়তই পরিবহন সংক্রান্ত মোবাইল অ্যাপস, ট্রাকিং সিস্টেম তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা এলন মাস্কের টেসলা মডেল এস গাড়িতে আছে ‘অটোপাইলট মোড’। অর্থাৎ চালকের ক্লান্তি লাগলে কিংবা ঘুমিয়ে পড়লে ‘অটোপাইলট মোড’ অন করে দিলে গাড়ি চলতে থাকবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তবে ব্যয়বহুল সেই গাড়ি এখনো অনেকেরই নাগালের বাইরে।
এদিকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ‘ইনফরমেশন সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড’ ‘সেন্সর ডিভাইস’ উদ্ভাবন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে। গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইলে কথা বললে, এসএমএস করায় ব্যস্ত হলে কিংবা চা, কফি খেলে তাকে সতর্ক করে দেবে।
এছাড়াও চালক সামনের রাস্তার দিকে না তাকিয়ে পাশের বিলবোর্ডের দিকে নজর দিচ্ছে কিনা, সেটাও খেয়াল রাখবে এই ডিভাইস। চালক শারীরিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আছে কিনা, তার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে কিনা, কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেছে কিনা, শরীরে তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা, অর্থাৎ চালক সুস্থ আছে কিনা, সে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যাবে এই ডিভাইসের মাধ্যমে।
সড়ক বিভাগ প্রায় পৌনে তিনশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় মহাসড়কের (এন ৮) ৪০ কিলোমিটার সড়কে এবং গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার মহাসড়কে স্বয়ংক্রিয় ‘ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’ (আইটিএস) হাতে নিয়েছে, যা ডিসেম্বর ২০২৩-এ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।
কন্ট্রোল রুম থেকে ‘ভেহিকল ডিটেক্টিভ সিস্টেমের’ মাধ্যমে এটি দ্রুত গতি নিয়ন্ত্রণে চালকদের বাধ্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ম ভাঙার বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা এবং দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক সহায়তা কার্যক্রমে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। এ ব্যবস্থা চালু হলে নির্ধারিত সড়কে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যান চলাচল এবং নির্দিষ্ট লেইন মেনে চলতে চালকদের বাধ্য করার সুযোগ তৈরি হবে। তাৎক্ষণিক সংকেত আর বার্তা পাঠিয়ে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা যাবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত সাফল্যের হিসাব অনেকটাই শূন্য। ট্রাফিক সিগন্যালগুলো দণ্ডায়মান আছে ঠিকই, কিন্তু অকেজো। আধুনিক মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলের কাছে সড়ক পরিবহন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একেবারেই সেকেলে।
আধুনিক ডিজিটাল ও অ্যাপসভিত্তিক প্রযুক্তি চালু করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদেরও সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বর্তমানে গৃহীত সরকারের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যেমন জরুরি, তারচেয়ে বেশি জরুরি এগুলো সচল ও সংরক্ষণ রাখা।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।