মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অগ্রগতি ও প্রগতির শেকড়ের শক্তি
অনলাইন ডেস্ক

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, অগ্রগতি ও প্রগতির শেকড়ের শক্তি কী? আমি নির্দ্বিধায় বলব, ‘ধৈর্য, ধৈর্য এবং শুধুই ধৈর্য’। কিন্তু বর্তমান সমাজে ধৈর্য নামক গুণটির প্রবল সংকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে মানুষের মধ্যে ধৈর্যের ঘাটতি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করলাম। চাকরিপ্রার্থীরা প্রায়ই এই মর্মে ফোন করেন, ‘স্যার ছয় সেট দরখাস্ত করতে বলা হয়েছে। একটি দরখাস্ত হাতে লিখে ফটোকপি করে সই করে দিলে চলবে? নাকি স্বহস্তে প্রত্যেকটিই লিখতে হবে? বিষয়টি খুবই সাধারণ, কিন্তু এর মধ্যে সমাজের নেতিবাচক পরিবর্তনের আভাস রয়েছে। জীবনে চাকরির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্যও ছয় পৃষ্ঠা দরখাস্ত পৃথকভাবে স্বহস্তে লিখতে মানুষ আজকাল অনীহা বোধ করছে। এমন মানসিক স্থবিরতা জাতির উত্থান, অগ্রগতি ও প্রগতির ক্ষেত্রে অশনিসংকেত।

একটু গভীরে ভাবুন, লক্ষ করবেন প্রকৃতপক্ষে ধৈর্য নামক মানবীয় গুণটিই কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস, কখনো আত্মপ্রত্যয়, কখনো অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, কখনো ভালোবাসা আবার কখনো আত্মোপলব্ধি হয়ে আমাদের জীবনে প্রতিভাত হয়। জীবনে চলার পথে নানা ধরনের আপদণ্ডবিপদ, উত্থান-পতন ইত্যাদি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এমন বৈরী সময়ে আমরা সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করি, সাহায্য চাই তার কাছে। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বিপদে সৃষ্টিকর্তা আমাদের সাহায্য করবেন। তাই বিপদে আমরা ধৈর্য ধারণ করি। সৃষ্টিকর্তার সাহায্যের প্রতীক্ষায় ধৈর্য ধারণই হলো ‘বিশ্বাস’।

কখনো কখনো মানুষ তার পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য থাকে বদ্ধপরিকর। তারা প্রচলিত নিয়ম বা সামাজিক ধাপগুলো অতিক্রম না করেও জীবনে সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে নিজের কর্মের ওপর বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। বিল গেটস, জাকার বার্গ প্রমুখ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেননি। তারা প্রচলিত নিয়মকে ভেঙেই পৃথিবীতে সফল হয়েছেন। তারা ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী। ধৈর্যের আরেকটি রূপ হলো ‘আত্মপ্রত্যয়’।

সমাজে চলতে গেলে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয়। বড়দের আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে সেগুলো পালন করার প্রচেষ্টাও কিন্তু ধৈর্য। তরুণ বয়সে অনেক সময় বয়োজ্যেষ্ঠদের নিষেধ, উপদেশ বিষের মতো মনে হয়। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়গুলোর অন্তর্নিহিত ভালো দিকগুলো নিয়ে ভাবলে তাদের ওপর রাগ হওয়া তো দূরের কথা বরং মস্তিষ্ক হবে শ্রদ্ধাবনত। এখানেও ধৈর্যের জয়গান। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রকৃতপক্ষে ধৈর্যেরই আরেকটি রূপ।

পারিবারিক জীবনে মা-বাবা, সন্তানসন্তুতি ও অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি হৃদয়ের অন্তস্তলের ভালোবাসা কিন্তু ধৈর্যেরই ভিন্ন রূপ। আমি অনেক সময় মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের চরম অমানবিক আচরণ দেখেছি। তার পরও কিন্তু মা-বাবা সন্তানের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। তারা চরম মমতায় সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। ছেলেবেলায় আমরা অসুস্থ হলে মা-বাবা কত বিনিদ্র রজনী পার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিছুতেই তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। তাদের ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি সন্তানের জন্য। পরিবারের জন্য ধৈর্য ভালোবাসার ফল্গুধারা হয়ে নিঃসৃত হয়েছে।

বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাল্বের ফিলামেন্ট আবিষ্কার করতে গিয়ে বিভিন্ন ধাতব উপাদানের ২ হাজার ৭৭৪টি ভিন্ন মিশ্রণ পরীক্ষা করেও কার্যকর ফিলামেন্ট তৈরি করতে ব্যর্থ হন। এমন পরিস্থিতিতে তার সহকারী বলেন, ‘আমাদের এতো পরিশ্রম বিফলে গেলো?’ সহকারীর কথায় এডিসন বলেছিলেন, ‘মোটেও বিফলে যায়নি। আমাদের পরে যারা এ বিষয়ে গবেষণা করবেন তারা ২ হাজার ৭৭৪টি মিশ্রণ বাদ দিয়ে কাজ শুরু করবেন। আমরা কাজটিকে এগিয়ে রাখলাম মাত্র।’ এখানে ধৈর্য আত্মোপলব্ধি হয়ে প্রতিভাত হয়েছে।

ধৈর্য প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধির সোপান। শিক্ষা দ্বারা মনোজগতের নিয়ন্ত্রণ ও মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করার নিরন্তর প্রশিক্ষণ চালু রাখা সম্ভব। আর গণিত হলো মানুষের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যম। আমরা যখন স্কুলে সরল অঙ্ক কষেছি, তখন অঙ্কটি করার সময় নিবিষ্ট চিত্তে থাকতাম। অঙ্ক কষা শেষে যখন সঠিক উত্তরটি পেতাম, তখন আমাদের কষ্ট সার্থক হতো। সরলের মান নির্ণয় করতে গিয়ে সামান্য ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি চিহ্নের ভুলের কারণে অঙ্কের উত্তর মিলতো না। আমার মতে ক্যালকুলেটর ব্যবহার না করে হাতে-কলমে অঙ্ক করার অভ্যাস হচ্ছে মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করার একটি প্রক্রিয়া। অঙ্ক ছাড়া যে কোনো বিষয়ে ভুল ও শুদ্ধের শতকরা পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। কিন্তু গণিতের ক্ষেত্রে হয় ছক্কা নয়তো ফক্কা। তাই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত শিখনের ক্ষেত্রে ক্যালকুলেটরের ব্যবহার নবপ্রজন্মের মনোজগতের ক্ষতিসাধন করছে। আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা নষ্ট করছে। পরিণামে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তার গভীরে যাওয়ার ধৈর্য ও মনোযোগ তৈরি হচ্ছে না।

ধৈর্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলার সঙ্গে শরীরে সুখের হরমোন নামে পরিচিত অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও ডোপামিনের বৃদ্ধি ঘটে। ফলে মানুষ যে কোনো কাজ করতে আনন্দ এবং স্বতঃস্ফূর্ততা পায়। ডোপামিন হরমোন বৃদ্ধির মূল উপাদান হলো সূর্যালোক। শরীরের ৮০ শতাংশ ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ করে সূর্যের আলো। আমাদের প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ রয়েছে। কিন্তু উপলব্ধির অভাবে আমরা রোদণ্ডপলাতক প্রজন্মে পরিণত হয়েছি। ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে। ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি ডায়াবেটিস, স্থুলতা, হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রজনন ক্ষমতাও ভিটামিন ডি-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি রিপোর্টে প্রকাশ, ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতা মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত করে। গবেষণায় প্রমাণিত, অমনোযোগিতা দূর করতে ভিটামিন ডি অতুলনীয়। তাই আমাদেরকে নিয়মমাফিক রোদে যেতে হবে। কমপক্ষে ১৮ শতাংশ শরীরের অংশে রোদ পড়তে দিতে হবে। এভাবে জীবনযাপন পদ্ধতিকে আদর্শ মানে নিয়ে এসে আমরা সুস্থ ও সবল থাকতে পারি; যা স্বাভাবিকভাবে জাতির ধৈর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

আমরা সবকিছুর উন্নয়ন ও অগ্রগতি চাই ধৈর্য নামক মানবীয় গুণের পরিচর্যার ব্যাঘাত ঘটিয়ে। জীবনের সফলতাকে আমরা যে আঙ্গিকেই দেখি না কেন, এর মূলে রয়েছে ধৈর্য ও একাগ্রতা। তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্য বৃদ্ধির প্রয়াস জাতিকে সুস্থ, সমৃদ্ধ ও উন্নত করবে।

অধ্যাপক ড. মোঃ নাছিম আখতার : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়