মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষাভাবনা
অনলাইন ডেস্ক

বাংলা ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই। আর তারই জের হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছরখানেকের মধ্যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবসে’ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মীসহ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার তাঁকেসহ অন্যান্য নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

ভাষা আন্দোলন যখন ক্রমেই একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং ১৯৫২ সালে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র জাতি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে আন্দোলনের পটভূমিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় আন্দোলন সফল করার জন্যে তিনি নানা কৌশলে আন্দোলনরত ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিতে থাকেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয় তার ভেতর থেকেই জেগে ওঠে শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা। ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। আর এ বছরই রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে নয়াচীন সফরের সুযোগ লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁর চীন সফর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার বিবরণ আছে মনোজ বসুর চীন দেখে এলাম গ্রন্থে। তখন ব্যাঙ্কুয়েট হলে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভোজসভা চলছিল। তিনি লিখেছেন :

সামনেই তরুণ বন্ধু মুজিবুর রহমান- আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। জেল খেটে এসেছেন ভাষা-আন্দোলনে; বাংলা চাই বলতে বলতে গুলির মুখে যারা প্রাণ দিয়েছিল, তাদেরই সহযাত্রী। আর রয়েছেন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন; যুগের দাবীর সম্পাদক খোন্দকার ইলিয়াস। বাংলা ভাষার দাবি এঁদেরি সকলের কণ্ঠে। বাঁ-দিকে দেখতে পাচ্ছি ইউসুফ হাসানকে- আলিগড়ের এম. এ., উর্দুভাষী হয়েও বাংলা ভাষার প্রবল সমর্থক। এই বিদেশে বাংলা বলার এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কোথায়?

ভাষা আন্দোলনের ওই পরিস্থিতি শেখ মুজিবুর রহমানকে চীনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে হয়। বক্তৃতাটি যে আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ঠিক করে দিয়েছেন তা বলতে ভুল করেননি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি লিখেছেন :

বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।

শেখ মুজিবুর রহমান তখন মাত্র বত্রিশ বছরের যুবক। এই বয়সে তিনি আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক মানসিকতা স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের উপনিবেশগুলোতে খুব সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে তিনটি বিষয়কে গ্রাস করতে চেষ্টা করেছে। এর প্রথমটি হলো ভাষা, তারপর শিক্ষা ও সংস্কৃতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের উপনিবেশগুলোতে ইংরেজি ভাষা, শিক্ষাপদ্ধতি, জ্ঞানকাণ্ড এবং তাদের সংস্কৃতি এমনভাবে মানুষের মনের গড়নের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে, বিশ্বাসের মধ্যে প্রোথিত করে দিয়েছেন যে এখন ওই ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে আমরা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করি। শেখ মুজিবুর রহমান ওই সাম্রাজ্যবাদী মনোগড়ন থেকে আমাদের মুক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। ভাষা আন্দোলন ঔপনিবেশিক দাস্যবৃত্তি থেকে আমাদের মানসিক মুক্তিরও একটি যুদ্ধ।

বক্তৃতাশেষে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের কথা, যিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বময় পরিচিত করে তুলেছেন। এছাড়া পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং দুনিয়ার অন্যতম ভাষা বাংলা। সুতরাং তিনি তো বাংলা ভাষায়ই বক্তৃতা করবেন। চীনের অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, অনেকে ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও ইংরেজিতে কথা বলেন না, বক্তৃতা করেন না। দোভাষীর সাহায্য নেন। নানকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ভালো ইংরেজি জানেন। কিন্তু তিনিও ইংরেজিতে কথা বলেননি। অধিকন্তু দোভাষীর ইংরেজি ভুল হলে তিনি আস্তে আস্তে ও ক্ষীণকণ্ঠে সংশোধন করে দিতেন। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “একেই বলে জাতীয়তাবোধ। একেই বলে দেশের ও মাতৃভাষার উপর দরদ।”

ছবিযুক্ত বুলেটিনের প্রত্যাশায় সভায় অনেকেই বক্তৃতা দিতে চাইতেন। আর শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করতে চান। আর তাঁরই যেন প্রতিধ্বনি শুনতে পাই নিচের বিবরণে :

Language is not simply an assortment of words but an entity that connects an individual to his family, identity, culture, music, beliefs and wisdom. It is the carrier of history, traditions, customs and folklore from one generation to another. Without language, no culture can sustain its existence. Our language is actually our identity.

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে নিজের পরিচয়ই তুলে ধরতে চেয়েছেন আর তা হলো তিনি বাঙালি; বাংলা তাঁর ভাষা। তিনি দেখেছেন, বাঙালিরা ইংরেজিতে কিংবা উর্দুতে কথা বলার জন্য কেমন অস্থির হয়ে ওঠেন। অনেকে ইংরেজি ভালোভাবে বলতে পারেন না বলে হীনমন্যতায় ভোগেন। আবার কেউ কেউ ভুল ইংরেজিতে কথা বলে বেশ গর্ববোধ করেন। এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্ত করতে চেয়েছেন এবং বিশ্বদরবারে জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শেষে তুমুল হাততালি পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত প্রতিনিধিরাও জোরে হাততালি দিয়েছেন। সুতরাং প্রতিদিন রাতের খাবার শেষে ওইদিন যখন আড্ডা চলছিল তখন মনোজ বসু কথা উঠালেন। শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে মনোজ বসু জানতে চাইলেন :

কিগো ভায়া, পশ্চিমণ্ডপাকিস্তানিদের খুব তো নিন্দেমন্দ করেন বাংলা ভাষার শত্রু বলে। এমন সম্বর্ধনা কি জন্যে হল তবে?

শেখ মুজিব বললেন, ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ওরা আমাদের ভয় করে। গুঁতোয় পড়ে বাংলা ভাষার এত খাতির।

আবার বললেন, যে ক’টি এসেছে- এরা লোক ভালো, আমাদের মনের দরদ বোঝে। এদের দেখে সকলের আন্দাজ নেবেন না।

ওই সম্মেলনে ৮৬ জন বক্তার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান বা মনোজ বসুর বাংলায় বক্তৃতা খুব বেশি প্রতিনিধি যে বুঝেছিলেন তা নয়, কিন্তু পিনপতন নীরবতা ধারণ করে সবাই সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তাদের মনও একআধটু ছুঁয়ে গেছে ওই প্রাণমাতানো বক্তৃতা। ৩৫টি দেশের ভাষাভাষী মানুষের সামনে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করে তোলাই ছিল ওই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য। শেখ মুজিবের আগেই বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন মনোজ বসু। সেই অভিজ্ঞতা শেখ মুজিবকে আলোড়িত করে থাকবে। মনোজ বসু লিখেছেন, “গভীর প্রীতিতে হ্যান্ডশেক করলেন, পাকিস্তানের মজিবুর রহমান। বললেন, বড় ভাল বলেছেন দাদা- ” দুইজনের বক্তৃতা শেষে একটি মজার ঘটনার অবতারণা করেছেন মনোজ বসু। তিনি লিখেছেন :

এক ভদ্রলোক গুটিগুটি এসে বসলেন আমার পাশের খালি চেয়ারে। মার্কিন মুলুকের মানুষ বলে আন্দাজ হয়। চুপি চুপি শুধালেন, মশায় আপনি বলেছেন- আর ঐ যে উনি বলেছেন, দু-জনের একই ভাষা নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাংলা।

একই রকম অক্ষর?

বুক চিতিয়ে দেমাক করি, বাংলার নাম জানো না- কে বট হে তুমি?- টেগোর যে ভাষায় লিখেছেন!

কদ্দুর কি বুঝল, মা-সরস্বতী জানেন। আমতা আমতা করে বলে, সে তো বটেই! কিন্তু উনি এক দেশের মানুষ আপনি অন্য দেশের, অথচ দুটি দেশের ভাষা একরকম-

বুঝতে পারলে না, বাংলা আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশ-সেদেশের মানুষ ঐ এক ভাষায় কথা বলে, একরকম অক্ষর তাদের, মা বলে ভাবে ঐ ভাষাকে, তার জন্য জান কবুল করে।

আর ১৯৪৭ এর পর থেকে বাংলা ভাষা ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বাংলা ভাষায় বক্তৃতা শুধু ভাষাপ্রেম ছিল না, অধিকন্তু বাঙালি জাতির আন্দোলনের শক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই চেষ্টার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ১৯৭৪ সালের পঁচিশে সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ প্রদানের মধ্যে।

ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের পরিচয় খুব বেশি নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষার শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি স্পষ্টতই অনুভব করেছিলেন যে, মানুষে মানুষে যোগাযোগের ঐক্যের চেয়ে বড় কোনো ঐক্য নেই। সুতরাং চমৎকার ইংরেজি জানা সত্ত্বেও তিনি বাংলায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অফিস-আদালত ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়