মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

শৈশবের জারি-সারি-কিচ্ছা
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের চৌচালা ঘরের পেছনে একটি ছোট টিনের দোচালা ঘর ছিল। ঘরটির চারদিকে ছিল পাটকাঠির বেড়া। আমরা বলতাম হমডাইলের বেড়া। ঘরের ভেতরে কোনো খাট ছিল না, শোয়ার চকি ছিল না। খাওয়া-দাওয়া ছিল মাটির মেঝেতে, পিঁড়ি বা কাঠের চকি পেতে। শুধু হোগলা পাতার বিছানা পাতা হতো রাতে ঘুমানোর সময়। বালিশ বলতে ছিল পুরোনো এবং ছেঁড়া কতগুলো কাপড়ের একটি দলা। শীতে বিছানার নিচে ধানের খড় বিছিয়ে জাজিমের মতো উঁচু করা হতো। তার উপর বিছানো হতো কাঁথা। কাঁথা না বিছালেও কোনো অসুবিধা হতো না। পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন আসলে বসতে দেওয়া হতো পিঁড়ি বা কাঠের চকি। যারা বেশি সম্মানিত তাদের বসতে দেওয়া হতো বেতের মোড়া। চেয়ারের প্রচলন ছিল। তবে সবখানে নয়। অবস্থাসম্পন্ন ও অভিজাত পরিবারে চেয়ার ছিল। পারিবারিক জীবনের কোথাও প্লাস্টিকের চিহ্নমাত্র ছিল না।

ওই ঘরে থাকতেন আমার এক জেঠা- বাবার চাচাত ভাই। তার নাম আনোয়ার হোসেন। চাচী, দুই ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে ছিল ওই সংসার। সংসারে ছয়জন মানুষ। কিন্তু কী করে এই সংসারটি চলত তা আজও আমার কাছে এক রহস্যময় ব্যাপার। জেঠার ফসলের কোনো জমি ছিল না, ক্ষেত-খামার ছিল না। কোনো ব্যবসা ছিল না। চাকরি ছিল না। সারা দিন তিনি ডুলা বানাতেন। বাঁশ থেকে হাইল ও বেতি তৈরি করতেন তিনি নিজেই এবং সেখান থেকে তৈরি হতো ডুলা। মাছ ধরে রাখার ডুলা তৈরির একটি পল্লি হয়ে উঠেছিল আমাদের ওই মহল্লাটি। আমাদের মতো দু-একটি পরিবার ছাড়া ছোট মহল্লাটির প্রায় সব পরিবার ডুলা বানাতো। আর একটি বাঁশের ভাড়ের সঙ্গে ডুলাগুলো এমনভাবে সাজিয়ে বাঁধা হতো যাতে খুব সহজেই বিশ-ত্রিশটি ডুলা বিক্রির জন্য বাজরে নিয়ে যাওয়া যায়। জেঠা ছাড়া মহল্লার আর সবাই ডুলা বানানো ছাড়াও অন্য কাজ করত। যেমন পুকুর বা খালে মাটি কাটার কাজ, শীতের সময় পুকুরের পানি সেচে মাছ ধারার কাজ, ক্ষেতে মজুরি দেওয়ার কাজ। এই কাজটির নাম ছিল বদলি দেওয়া। এছাড়া মাছ ধরে বিক্রি করা, মৌসুমি সবজির ব্যবসা করা- এইসব তো ছিলই। কেউ কেউ গরু-ছাগল পালত। হাস-মুরগি ছিল প্রায় ঘরে ঘরে। জেঠা কোনো দিন গরু-ছাগল পালেননি। জেঠির হাস-মুরগির খোয়াড় ছিল কি না এখন আর আমি মনে করতে পারছি না। কিন্তু আনোয়ার জেঠা শুধু ডুলা বানাতেন এবং ওগুলো বিক্রি করতেন। ঝাকি জাল বুনতে দেখেছি দিনের পর দিন। সাদা লাইলন সুতার জালটি বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে বাঁশের একটি কঞ্চি দিয়ে তৈরি সুইটি জেঠা চালিয়ে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিরাম নেই। যখন তিনি ঝাঁকি জাল বুনতেন তখন তার হাত দেখা যেত না। আমরা জেঠর হাতটি দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জেঠা বলতেন ‘কী দেহস?’ বলতাম? ‘আমনের হাত দেহি। দেহা তো যায় না, এমন চলে। ক্যামনে করেন জেডা’। জেঠা হাসতেন। কিন্তু ওগুলো বিক্রি করতে দেখিনি।

সত্তরের দশকের সেই দিনগুলোতে ছোট একটি ডুলার দাম ছিল বারো আনা থেকে এক টাকা। একটি বড় ডুলার দাম ছিল দেড় টাকা থেকে দুই টাকা। দিনে দশটি ডুলা বানানো ছিল কষ্টকর। দুই কুড়ি তিন কুড়ি ডুলা তৈরি হলেই বাজারে যাওয়া দরকার হতো।

মানুষের জীবনে শত শত অঙ্কের বিষয় ছিল না। এক সঙ্গে একশ টাকা ছিল বিরল ঘটনা। আর হাজার হাজার টাকা কারো কাছেই থাকত না এবং এই নিয়ে কোনো গল্পও মানুষ করত না। ফলে তাদের হিসাবের দৌড় ছিল ওই কুড়ির মধ্যে। এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি। বড়োজোর চার কুড়ি। ওর মধ্যেই গ্রামীণ জীবনে মনুষের হিসাবগুলো হয়ে যেতো। তবে বর্ষাকালে বাড়ির ঘাটে ঘাটে নাও ভিড়িয়ে যারা পাট কিনতেন তাদের টাকার হিসাব কেমন ছিল তা আমাদের জানা নেই। কিছু মানুষ তাড়স্বরে চিৎকার করে বলে যেত ‘মা-বইনেরা গো...বউ-ঝিয়েরা গো...। সোনা আছে গো ..., সোনা ..., পুরান সোনা...।’ পুরোনো স্বর্ণ কেনার লোকদের কত টাকা থাকতে হয়, তাও আমাদের জানা ছিল না। ব্যবসায়ীদের কথা চিরকালই আলাদা।

কখনো কখনো বাড়িতেই বিক্রি হয়ে যেতো ডুলা। কিন্তু তা যে বাইরে থেকে কোনো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী কিনে নিয়ে যেতো, তা কিন্তু নয়। বরং এই মহল্লাটির অন্য কেউ বাজারে যাওয়ার সময় দামদর করে কিনে নিয়ে যেতো ডুলাগুলো। আমার এই আনোয়ার জেঠা পারতপক্ষে বাজারে যেতেন না। কিছুটা কম দামে হলেও জেঠা কাউকে না কাউকে গছিয়ে দিতেন। এখন বুঝি, ডুলা বিক্রির ওই টাকায় তার সংসার চলার কথা নয়। ফলে দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। নুন আনতে পান্তা ফুরাত সারা বছর। কিন্তু কেনো দিন হাহাকার দেখিনি। ‘নাই’ শব্দটা কখনো শুনিনি। সংসারের এই দারিদ্র্য পরিবর্তন করার চেষ্টাও লক্ষ করিনি। চিরকালের অনিবার্য নিয়তির মতো পরিবারটি দারিদ্র্যকে সঙ্গে করে নিয়ে চলত। এ যেন জীবনের চিরকালের বিধান।

শরীরের নিম্নাঙ্গে একটি লুঙ্গি পরিধান করা ছাড়া গায়ে দেওয়ার মতো আর কিছু তার ছিল না। সারা বছরই তিনি থাকতেন খালি গায়ে। মাছ ধরতে গেলে লুঙ্গিটা কোচা দিয়ে নিতেন। শীতের সময় গায়ে একটি চাদর জড়াতেন। ওই চাদরটি কবে, কোথা থেকে এবং কীভাবে সংগ্রহ করেছিলেন তার কোনো ইতিহাস আমাদের জানা নেই। কারণ জন্মের পর থেকে আমরা শীতের সময় জেঠার গায়ে ওই একটি চাদরই জড়াতে দেখেছি। মানুষের জীবনে কত কম জিনিসের প্রয়োজন হয়, তার আশ্চর্য এক নজির ছিলেন আমার ওই জেঠা। এবং ওই অতি অল্পের মধ্যে এক জীবন তিনি ভেতরগত গভীর এক আনন্দের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন।

কী যে নির্জন আর চুপচাপ মানুষ ছিলেন তিনি তা আর এখন ভাবতেও পারি না। সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতেন। আর গুণগুণ করে গান গাইতেন। ঘরেই থাকতেন অধিকাংশ সময়। তবে সুযোগ পেলেই ধর্মজাল বা ঝাঁকিজাল নিয়ে বের হয়ে পড়তেন মাছ ধরতে। মাছ ধরার নেশা ছিল তার। কিন্তু মাছ যে খুব পেতেন, তা কিন্তু নয়। দু-একটা মাছ ডুলাতে রাখার পর থেকে একটু পর পর ডুলার দিকে তাকাতেন- মাছ কতটা হলো। ডুলা নেড়েচেড়েও দেখতেন। যখন বুঝতেন একবেলা বা দুবেলার জন্য পর্যাপ্ত হয়েছে, তখনই চলে আসতেন। এত নির্লোভ মানুষ কী করে হয় ভাবতেই অবাক লাগে। না হলে নয়- এমন প্রয়োজনেই ছিল টনাটানি, সারা জীবনেই তাই। ফলে প্রয়োজনের বেশি ভাবতেও পারেননি কোনো দিন।

কোনো দিন তার কোনো বন্ধু দেখিনি। পাড়া-প্রতিবেশী কারো সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক বা দহরমণ্ডমহরম ছিল না কোনো কালে। এবং এক জীবন কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখিনি। ঝগড়া তো দূরের কথা, তিনি এত নিচু স্বরে কথা বলতেন যে, খুব কাছের মানুষটি ছাড়া কেউ কোনো দিন তার কথা শুনতে পায়নি।

আমাদের ঘর ছিল ওই জেঠার ঘরের একদম লাগোয়া। কিন্তু আমি মনে করতে পারি না যে, তিনি কোনো দিন আমাদের ঘরে পা রেখেছেন। কখনো কারো বাড়িতে যেতেন না, ঘরে যেতেন না। নিজের ঘরটুকুই ছিল তার পৃথিবী। অথচ ওই ঘরটাকে একটি প্রায় উদোম ভিটি বললেও চলে। ভিটির যে জায়গাটুকুতে তার অধিষ্ঠান ছিল, সেই জায়গাটুকুর মাটি পর্যন্ত কালো হয়ে গিয়েছিল। আমার অলস জেঠি মাটি দিয়ে মাটির ঘর লেপেপুছে তকতকে করার প্রয়োজন বোধ করেননি কখনো। তাই জেঠার অবস্থানের জায়গাটুকুর কালসিটে রং প্রকট হয়ে উঠেছিল।

পরম এক বন্ধু ছিল তার। সে হলো একটি হুঁকা। দিনের অধিকাংশ সময় ওই হুঁকাতে টান দিয়ে সময় কাটাতেন তিনি। সময় পেলে জেঠা এই বন্ধুর যত্ন নিতেন। পানি পরিবর্তন করা, নলচে পরিষ্কার করা, কলকি পরিষ্কার করা- বেশ যত্ন করেই এইসব কাজ করতেন। আর ছিল চিরকালের এক নেশা। সন্ধ্যার পরই যে নেশা তাকে পেয়ে বসত, আর তা হলো সুরের নেশা, গল্পের নেশা, আখ্যানের নেশা।

ঘরের ভেতরে কিংবা ঘরের সামনে সমান্য উঠানটুকুতে হোগলা পাতার বিছানা বিছিয়ে আমরা শিশু-কিশোররা, পাড়া-প্রতিবেশী বউ-ঝিরা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বসে পড়তাম। আর জেঠা গভীর আবেশে সুর দিয়ে শুরু করতেন কিচ্ছা পরিবেশন। তখন মনে হতো না যে, তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। এতগুলো মানুষের মাঝে থেকেও যেন তিনি থাকতেন না। তিনি থাকতেন তার নিজের মধ্যে। কে এলো, কে গেল, কে কথা বলছে, কে ঘুমাচ্ছে তার দিকে সামান্য নজর ছিল না জেঠার। মনে হতো, তিনি নিজেকেই যেন গান শুনিয়ে যাচ্ছেন, কিচ্ছা শুনিয়ে যাচ্ছেন। অধিকতর অভিভূত হয়ে তার পাশে বসে থাকতেন জেঠি।

বিচিত্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন আমাদের এই জেঠি। এর সঙ্গে, তার সঙ্গে ঝগড়াজাটি করতেন মাঝেমধেই। একটি ঘর যে এখানে আছে তা বোঝা যেত আমাদের ওই জেঠির জন্য। জেঠাকেও বকাবাদ্য করতে ছাড়তেন না। কিন্তু কার সঙ্গে জেঠি জগড়া করছেন তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। কারণ প্রতিপক্ষের রা শব্দটি ছিল না। এমন আজব ঝগড়া করা খুব মুশকিল। প্রতিপক্ষ ছাড়া কোনো যুদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু আমাদের ওই জেঠি চিরকাল ঝগড়া করেছেন, কিন্তু জেঠার কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। এখন মনে হয়, জেঠিও নিজের সঙ্গেই নিজে ঝগড়া করেছেন, যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু বিকেল হতেই ভিন্ন এই জেঠিকে আমরা আবিষ্কার করতাম। একজন বিন¤্র ও লাজুক কিশোরীর মতো তিনি কিচ্ছার আসরে জেঠার কাছে এসে বসতেন এবং তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জেঠার কিচ্ছার সুর আর মর্মার্থ অনুধাবন করতে চেষ্টা করতেন।

আনোয়ার জেঠা যেসব কিচ্ছা শোনাতেন তার মধ্যে ছিল ইউসুফ-জুলেখা, লাইলি-মজনু, গুলে বাকাওয়ালি, আমির হামজা, মধুমালতি, শিরিন-ফরহাদ, হাতিম তায়ি, সখী সোনা, জঙ্গনামা, আলিফ লায়লা, বিদ্যাসুন্দর, বেহুলা-লখিন্দর, মা মনসা, কমলাবতী রানি, রূপবান-রহিম বাদশাহ, মালেকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামণি, কাজলরেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি কিচ্ছা। আরও কত কি কিচ্ছা ছিল, তার নাম আর এখন মনে নেই।

জেঠা কোনো একটি কিচ্ছা পরিবেশনের আগে ওই কিচ্ছাকে লিখেছেন তার পরিচয় দিতেন। এবং সেই ব্যক্তির প্রতি কত যে শ্রদ্ধা দেখাতেন, কত যে ভক্তি করতেন তা আর এখন বলে বোঝানো যাবে না। শাহ মুহম্মদ সগীর, বাহরাম খান, কবি নওয়াজীশ খান, সৈয়দ হামজা, নাসের আলী, রওশন আলী, ফকির গরীবুল্লাহ- এদের কোনো দিন আমরা দেখিনি। এরা আমাদের আত্মীয়-স্বজনও নয়। কিন্তু কি যে আপন হয়ে গিয়েছিল এরা, আজ আর তা বলে বোঝাতে পারবো না। বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে এই মানুষগুলোর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় ঘটে। একই মানুষ, কিন্তু পরিচয়টা হয় একদম আলদাভাবে। এরা কেউই যেন জেঠার ভালোবাসার মানুষ নয়, ভক্তিমার্গের মানুষ নয়। আমার মধ্যেও একই মানুষ চিরকাল আলাদাই থেকে গেলেন- শৈশবের ভালোবাসা ও ভক্তির মানুষ এবং যৌবনে জ্ঞানের মানুষ। ভালোবাসার সঙ্গে, ভক্তির সঙ্গে জ্ঞানের মিলন হলো না।

আমার জেঠা যেসব কিচ্ছা পরিবেশন করতেন তার অধিকাংশই ছিল প্রেমের-মানব-মানবীর প্রেম কিংবা ঈশ্বর প্রেম। বীরত্বের কিচ্ছাও ছিল। সেসব কিচ্ছা ছিলো লৌকিক, অলৌকিক আর অতিলৌকিক ঘটনায় অবিশ্বাস্য। কিন্তু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনো বোধ আমাদের মধ্যে তখনো তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে শুধু চেতনা। চৈতন্যের ওই ¯্রােতে সব কিছুই ধরা দিত গভীর অনুধ্যানে। পাহাড় উপড়ে ফেলতে পারে না মানুষ। হাতিকে কাঁধে নিয়ে আছাড় মারার শক্তিও তার নেই। শতসহস্র সিংহ আর বাঘ মেরেকেটে সাফ করে ফেলার সামর্থ্য কোথায় পাবে একজন মানুষ? এইসব অসম্ভই আমাদের মধ্যে ধরা দিত বিস্ময়কর শক্তি, সাহস আর সামর্থ্যরে প্রতীক হিসেবে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের বিষয় ছিল না।

তখনো আমাদের মধ্যে যৌনতার বোধ তৈরি হয়নি। ক্যানভাসে শিল্পকর্ম তৈরির পূর্বে যেমন শিল্পীর মাথার মধ্যে শিল্পের একটি রূপ তৈরি হয়ে যায়, তেমনি যৌনতা ছাড়া প্রেমের একটি রূপ আমাদের মাথায় তৈরি হয়ে গেছে তখন। এ যেন ক্যানভাস ছাড়া চিত্রকর্ম। ওই রূপের কোনো পরিধি নেই, কোনো আকার-আকৃতি নেই, কোনো গড়ন-সৌষ্ঠব নেই। একদম লাগামছাড়া। চিরকালের শিশু আমাদের জেঠা যখন অসম্ভব প্রেমের কাহিনিগুলো আবেগ দিয়ে, মমতা দিয়ে, ছন্দ দিয়ে, সুর দিয়ে গেয়ে যেতেন তখন আমরা সেইসব গল্পের নায়ক-নায়িকা হয়ে যেতাম। শৈশবের বিচিত্র ঘোরের মধ্যে আমরা যে বসবাস করতাম তার মধ্যে কিচ্ছা শোনার এই ঘোরটিও শুরু হতো সন্ধ্যা থেকে এবং স্বপ্নের মধ্যে আমরা অনেকেই হয়ে উঠতাম ইউসুফ-জুলেখা, লাইলি-মজনু, আমির হামজা, মধুমালতি, শিরিন-ফরহাদ, হাতিম তায়ি, সখী সোনা, বেহুলা-লখিন্দর, মা মনসা, কমলাবতী রানি, রহিম বাদশাহ, মালেকা বানু, গুনাইবিবি, দুর্গামণি, কাজলরেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা। ‘রূপবান’ কীভাবে যে ‘রুব্বান’ হয়ে গিয়েছিলা তার ব্যাকরণ জানা না থাকাতে রুব্বান বাদশার গল্প আমাদের মধ্যে কোনো সংশয় তৈরি করেনি।

আমাদের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ছিল। সুযোগ বুঝে জেঠাকে আমরা ওইসব অজগুবি প্রশ্ন করতাম। জেঠা খুব সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আমরা খুশি হতাম। উত্তরের সঠিকতাণ্ডবেঠিকতা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। উত্তর একটা পেলেই হতো। কারণ ওই উত্তরটাই ছিল আমাদের কাছে বেদবাক্য। আজ এই পরিণত বয়সে এসে মনে মনে, জীবনে যা কিছু হারিয়েছি তার মধ্যে মহার্ঘ্য ছিল ওই সরলতাটুকু, বিশ্বাসটুকু।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়