ক্যালেন্ডারের পাতায় হেমন্ত হলেও হিমের পরশে শরীরে যে অনুভূতি তৈরি হয় তাতে শীতের আগমনী ঘোষিত হয়। শীত মানে পিঠা-পার্বণ যেমন তেমনি শীত মানে শরীরের জন্যে প্রকৃতিকে মানিয়ে নেয়ার নিরন্তর সংগ্রামও বটে। উষ্ণতাধন্য প্রকৃতি যখন হঠাৎ করেই উত্তরী হাওয়ায় নিজে কেঁপে কেঁপে ওঠে তখন বাঙালির দেহজুড়ে শুরু হয় আত্মরক্ষার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শরীরকে রসদ যোগানোর দায়িত্ব যদি ঠিকমতো পালন করা না যায় তবে জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। শীত যেমন দুই প্রান্তিক বয়সের জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ হানে, তেমনি তরুণ-যুবারাও এ আক্রমণের বাইরে নয়।

শীতে প্রথম আক্রমণ আসে সংবেদনশীল ত্বকের ওপর। ত্বকের আর্দ্রতা শুকিয়ে গিয়ে ফাটলের সৃষ্টি হয়। সেই ফাটল ঠোঁট থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজিত থাকে। কখনও কখনও ফাটলের তীব্রতায় কারও কারও রক্তপাতও ঘটে থাকে। তাই শীতের হিমের সূচনালগ্ন হতেই ঠোঁট-মুখ, ত্বক ও পায়ের পাতায় পেট্রোলিয়াম জেলি, অলিভ অয়েল, অয়েল বেইজ্ড লোশন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নারকেল তেল মাখলেও ত্বক ফেটে যাওয়া রোধ করা যায়। পাশাপাশি ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ক্যাপসুল সেবন করে ত্বকের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা যায়। বয়ষ্ক এবং মধ্য বয়ষ্কদের বিশেষ করে পায়ে ইকথায়োসিস নামে ত্বকের শুষ্কতাজনিত ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। শীতের শুরু থেকে যত্ন নিলে ইকথায়োসিস হতে রেহাই পাওয়া যায়।

শিশু ও বৃদ্ধরা শীতে নিউমোনিয়ায় ভোগে। তাই উপযুক্ত উষ্ণ আবরণে প্রবীণ ও শিশুদের রাখতে হয়। কডলিভার অয়েল, ভিটামিন সি-জাতীয় সিরাপ সেবনে শিশুরা ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকতে পারে। প্রবীণদের ক্যালসিয়াম পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করতে হয় যাতে শীতে অস্থি ও অস্থিসন্ধিগুলো সচল থাকে এবং হাতে-পায়ে ঠাণ্ডার প্রকোপ কম অনুভূত হয়। যাদের অ্যাজমা আছে তারা গরম-ঠণ্ডার সংযোগলগ্নে আক্রান্ত হতে পারেন। তাদের অ্যাজমা-অ্যাটাক তীব্রতা ধারণ করে। তাই এ সময় নিয়মিত অ্যান্টি অ্যালার্জি বা অ্যান্টি হিস্টামিন এবং মন্টিলুকাস্ট জাতীয় ঔষধ সেবন করা বাধ্যতামূলক। সাথে ভিটামিন ই-ক্যাপসুল ও ভিটামিন এ সেবন করা উচিত। শীতে ঘরের দরজা-জানালা অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হয় বলে আবদ্ধ কক্ষে বিভিন্ন ডাস্ট-মাইট-পোলেন জাতীয় অ্যালার্জেন ঘোরাফেরা করে যা পরবর্তীতে তীব্র শ্বাসকষ্ট ঘটায়। তাই কেবল সন্ধ্যা বেলা ব্যতিরেখে অন্য সময় ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে রোদ-হাওয়া খেলতে দেয়া উচিত।

শিশুরা শীতে কোল্ড ডায়রিয়া এবং ফাংগাল ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়। শিশু খাদ্যের উপকরণাদি ভালোভাবে ধোয়া দরকার। পায়খানার বর্ণ সবুজাভ হতে পারে। শিশুকে বার বার পরিষ্কার করতে গিয়ে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। সেদিকেও নজর দেয়া জরুরি। নারীদের যারা কোমড়-হাঁটুর ব্যথায় ভুগতেন শীতে তাদের সে ব্যথা তীব্রতা ধারণ করে। এক্ষেত্রে ব্যথা নিরসনে প্যারাসিটামল লং অ্যাক্টিং জাতীয় ঔষধ সেবন করাটাই যুক্তিযুক্ত।

শীতে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেশি। কেননা, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় দেহের উষ্ণতা বজায় রাখতে গেলে তাতে হৃদপিণ্ডের নিজের পক্ষে অক্সিজেন সংকটে ভুগতে হয়। পাশাপাশি এ সময় মুখরোচক খাবারের আধিক্যের কারণে হৃদপিণ্ডের ওপর খাদ্য হজমের চাপ তৈরি হয়। এ চাপ সামাল দিতে গিয়ে হার্ট নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়। কাজেই শীতকালে খাবার পরিমাণ মতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনুরোধে ঢেঁকি গিলে অতিরিক্ত খাবার গলাধঃকরণ কোনো দরকার নেই।

শীতে দেহের প্রতিরক্ষায় দুর্বলতা তৈরি হয়। সেই দুর্বলতাকে জয় করতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চা ও সুষম পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে হবে। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পর পর অল্প অল্প করে খাবার খাওয়াটাই স্বাস্থ্যের পক্ষে উত্তম। আতঙ্কের নয়, শীত হোক উপভোগ্য এবং নিরাপদ।