শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

নানা রোগে নানা মুখ

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
নানা রোগে নানা মুখ

মুখ বা চেহারা মানুষের মুখমণ্ডলের কাঠামোকে যেমন সুনির্দিষ্ট অবয়ব দান করে তেমনি তৈরি করে মুখশ্রী। এক একজনের মুখ বা মৌখিক পরিচিতি এক এক রকম। মুখ দিয়ে যেমন সুনির্দিষ্ট মানুষকে চেনা যায় তেমনি মুখ দিয়ে তৈরি হয় ব্যক্তির পরিচিতি। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের মুখচ্ছবি বিশেষ বিশেষ রোগের লক্ষণ বা পরিচিতি তুলে ধরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগজনিত বিশেষ মুখ বা চেহারাকে ইংরেজিতে ফ্যাসিস (ঋধপরবং) বলে অভিহিত করা হয়। এক এক রোগে মুখের অবয়ব বা চেহারার ভঙ্গি এক এক রকম হয়। নিম্নে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এরকম কয়েকটি চেহারা বা মুখের কথা বয়ান করা গেল :

১. হিপোক্রাটিজ মুখ : Hippocrates facies

চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হলেন হিপোক্রাটিজ। টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত রোগীর মুখাবয়ব তিনিই প্রথম সনাক্ত করেন। তাই এই টাইফয়েড জ্বরগ্রস্ত মুখাবয়বকে তাঁর নামের সাথে মিল রেখে হিপোক্রাটিজের মুখ নামে অভিহিত করা হয়।

দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা, অতিরিক্ত মলত্যাগ, অতিরিক্ত ক্ষুধা এসব উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখাবয়ব বা চেহারা আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়।

এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির নাক তীক্ষè হয়, চোখ কোটরে দেবে যায়, মাথার দুপাশের অস্থি দেবে যায়, বহিঃ কর্ণ শীতল হয়ে যায়, কানের লতির বিকৃতি ঘটে, মুখের ত্বক শক্ত, কুঞ্চিত ও শুষ্ক হয়ে যায়। মুখের বর্ণ ফ্যাকাশে এবং ধূসর হয়ে যায়। কপাল শীতল হয় এবং ঠোঁটের চামড়া উঠে যায়। অবস্থার উন্নতি না হলে রোগী মৃত্যু বরণ করে।

২. চাঁদমুখ বা চাঁদপনা মুখ : Moon face

কুশিং সিনড্রোম নামে হরমোনজনিত একটা রোগ আছে যাতে মুখ ফুলে গিয়ে পূর্ণিমা চাঁদের মতো গোলগাল হয়। মুখে ও ঘাড়ে অতিরিক্ত লোম গজায়। একে মুন ফেস বা চাঁদমুখ বা চাঁদপনা মুখ বলে। কুশিং সিনড্রোমে কর্টিসল হরমোন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়। উচ্চমাত্রায় গ্লুকোকর্টিকয়েড জাতীয় ড্রাগ গ্রহণ কিংবা পিটুইটারি গ্রন্থি হতে অতিরিক্ত অ্যাড্রেনো কর্টিকোট্রপিক হরমোন ক্ষরণের কারণে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি হতে অতিরিক্ত কর্টিসল তৈরি হলে কুশিং সিনড্রোম দেখা দেয়।

৩. এলফিন মুখ : Elfin facies

শিশুদের উইলিয়াম সিনড্রোম বা এলফিন ফ্যাসিস সিনড্রোম নামে একটা রোগ আছে যাতে কোনো কারণ ছাড়া রক্তে ক্যালসিয়ামের উচ্চমাত্রা হয়, মানসিক বৃদ্ধি রহিত হয়, রক্ত সংবহনতন্ত্রের গাঠনিক অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত এদের ঊর্ধ্ব মহাধমনী এবং প্রান্তীয় ফুসফুসীয় ধমনীগুলোর গাত্র শক্ত হয়ে যায়। বিশেষ ধরনের এলফিন ফ্যাসিস-এ মুখগহ্বরের গাঠনিক বিকৃতি ঘটে এবং দাঁতের এনামেল কম বিকশিত হয় ও দাঁতের সংখ্যা কম হয়।

৪. পটার চেহারা বা পটার ফ্যাসিস : Potter facies

মাতৃগর্ভে থাকাকালীন যে ভ্রূণের কিডনি তৈরি হয় না এবং এ কারণে মাতৃগর্ভের থলিতে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বা গর্ভস্থ তরলের স্বাভাবিক পরিমাণে ঘাটতি হয়, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ চেহারা দেখা যায়। এই বিশেষ চেহারাকে পটার চেহারা বলে। ১৯৪৬ সালে বিজ্ঞানী এডিথ পটার মাতৃগর্ভস্থ শিশুর কিডনি তৈরি হয়নি এরকম কুড়িটি কেস সনাক্ত করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐ সব শিশুর মাথা ও ফুসফুসের আদল দেখে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। আবিষ্কারকের প্রতি সম্মানার্থে এ ধরনের চোহারাকে তাঁর নামে পটার মুখ বা পটার ফ্যাসিস নামকরণ করা হয়েছে।

৫. মুখোশ মুখ : Mask like facies

মানুষের ক্ষেত্রে বেশকিছু স্নায়বিক এবং মানসিক অবস্থা তার মুখের অভিব্যক্তিকে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রবণতা দেখায়। পার্কিনসন্স রোগ তেমন একটি অবস্থা যাতে মুখের আদল কোনরূপ অভিব্যক্তিহীন হয়ে পড়ে। এধরনের মুখের অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুখোশ মুখ বা মাস্ক ফ্যাসিস হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

৬. সিংহমুখ : Leonine facies

লেপ্রোমেটাস লেপ্রোসি বা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের আদল পরিবর্তিত হয়ে এমন আকৃতি ধারণ করে যে, ঐ ব্যক্তিকে দেখতে সিংহের মতো মনে হয়। এতে তার কপালের চামড়া পুরু হয়ে যায়, নাক-কান-থুতনি মোমের মতো মসৃণ হয় এবং বিভক্তকারী রেখা দ্বারা পৃথকভাবে তা বুঝা যায়। লিওনাইন ফ্যাসিস বা সিংহমুখ আদলে চোখের পাতার পাপড়ি ও ভ্রূ ঝরে যায়। লেপ্রোমেটাস লেপ্রোসি ছাড়াও এধরনের সিংহমুখ অন্যান্য কতিপয় রোগেও দেখা যায়। যেমন :

লিশম্যানিয়াসিস, দীর্ঘদিনের ত্বকীয় ছত্রাক সংক্রমণ, সারকয়ডোসিস, হাড়ের প্যাজেটস ডিজিজ ইত্যাদি।

৭. মাইট্রাল মুখ : Mitral facies

আমাদের হার্টে মাইট্রাল ভাল্ব নামে একধরনের দ্বিপত্র কপাটিকা আছে যাদের কাজ হলো রক্তের সঠিক নির্দেশনায় পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করা। এরা হৃদপিন্ডের অলিন্দ হতে নিলয়ের দিকে রক্তকে প্রবাহিত হতে সহযোগিতা করে। যাদের এই মাইট্রাল ভাল্ব শক্ত হয়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে হৃদপিন্ডের রক্ত পরিসঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় এবং হৃদপিন্ড হতে বহির্গামী রক্তের পরিমাণ হ্রাস পায়। রক্তনালীগুলোর সংকোচন কমে যায় এবং প্রসারণের হার বেড়ে যায়। ফলে মুখের গন্ডদেশে রক্ত সঞ্চালন বেশি হয়। এতে মুখমন্ডলের গাল গোলাপি বা হাল্কা বেগনি হয়ে ওঠে। গাল বা গন্ডদেশের ত্বকে ছোপ ছোপ রক্তের আভা ফুটে ওঠে। এরকমের মুখের অবয়বকে মাইট্রাল মুখ বা মাইট্রাল ফেসিস বলে।

৮. অ্যামিওডেরন মুখ : Amiodarone facies

অ্যামিওডেরন হলো হৃদপিন্ডের বেতাল স্পন্দনকে তালে আনার ঔষধ। এই ঔষধ সেবনের কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরে মুখমন্ডলের যে অংশ সৌর আলোকের সংস্পর্শে আসে সে অংশের বর্ণ নীলাভ ধূসর হয়ে যায়। তখন মুখের আদল এক ধরনের বৈশিষ্ট্য লাভ করে। একে অ্যামিওডেরন মুখ বলে অভিহিত করা হয়।

৯. দৈত্যাকৃতি মুখ : Acromegaly facies

মানবদেহে প্রাপ্তবয়সের পরে পিটুইটারি নামের অনাল গ্রন্থি হতে সংশ্লিষ্ট রোগের কারণে যখন অতিরিক্ত গ্রোথ হরমোন বা বৃদ্ধিকারক হরমোন নিঃসৃত হয় তখন দেহ আর দৈর্ঘ্যে বাড়তে না পারলেও তার বিভিন্ন অঙ্গ আকৃতিতে বেড়ে যায়। উপাঙ্গিক অস্থিগুলো আকারে বাড়ে। হাত-পা-মুখ ইত্যাদির আকার বেড়ে গিয়ে দৈত্যাকৃতি হয়ে যায়। এ অবস্থাকে বলে অ্যাক্রোমেগালি এবং মুখের অবয়বকে বলে অ্যাক্রোমেগালিক ফেসিস। এতে অক্ষিকোটরের উপরের অংশে স্ফীতি ঘটে, নাকের গোড়া প্রশস্ত ও চ্যাপ্টা হয়ে যায়, ঠোঁট স্ফীত হয়ে অত্যধিক চ্যাপ্টা হয়ে যায়। নিচের চোয়াল সামনের দিকে প্রবর্ধিত হয় ও তাতে ঘন ঘন দাঁতের কামড় লাগে, জিহ্বা আকারে বড় হয় এবং মুখের ত্বক মোটা হয়ে যায়। হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কিছু কিছু রোগীর চেহারা অ্যাক্রোমেগালিক ফেসিস বা দৈত্যাকৃতি মুখের আদল হয়।

১০. চ্যাপ্টা মুখ : Flat facies

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মুখের আদল চ্যাপ্টা বা থাবড়া হয়। একে ফ্ল্যাট ফেসিস বলে। এধরনের ব্যক্তিদের চোখের কোণের দিকটা উপরের দিকে উঠানো থাকে। এদের ছোট কান, ক্ষুদ্র গলা, মুখে না আঁটার মতো বড় জিহ্বা থাকে। ছোট ও প্রশস্ত হাত, ক্ষুদ্র কনিষ্ঠা ও হাতের তালুতে আড়াআড়ি রেখা থাকে। পায়ের বৃদ্ধাঙুল ও দ্বিতীয় আঙুলের মাঝখানে প্রশস্ত গ্যাপ থাকে যাকে স্যান্ডেল গ্যাপ বলে।

১১. মারফান মুখ : Marfanoid facies

মারফান সিনড্রোম নামে একটা বিশেষ রোগের অবস্থা আছে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের উচ্চতার তুলনায় লম্বা হাত-পা, ঠাসা ম্যাক্সিলা এবং উঁচু খিলানসম্পন্ন মুখণ্ডগহ্বরের তালু থাকে। এটি একটি জীনগত সমস্যা যাতে রক্ত সংবহনতন্ত্র, কঙ্কালতন্ত্র এবং চোখ অধিক আক্রান্ত হয়। হাত ও পায়ের লম্বা অস্থিগুলো অধিক বৃদ্ধি পায় এবং ডানে-বামে পাশাপাশি মেরুদন্ড বেঁকে যায়।

১৮৯৬ সালে ফরাসী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি মারফান প্রথম পাঁচ বছরের একটি মেয়ে শিশুর মধ্যে এইসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন। তাঁর নামে এই রোগকে নামকরণ করা হয়েছে মারফানয়েড সিনড্রোম এবং চেহারাকে মারফানয়েড ফেসিসর

১২. খেঁকী মুখ : Snarling facies

মায়াসথেনিয়া গ্রেভিস রোগে আক্রান্ত হলে স্নায়ু ও পেশির বিপর্যয় ঘটে এবং মুখের উভয় পার্শ্বে প্রগাঢ় দুর্বলতা দেখা দেয়। এতে মুখমন্ডলের আদল বদরাগী বা খেঁকী অভিব্যক্তি সম্পন্ন হয়ে পড়ে। একে স্নার্লিং ফেসিস বলে। ফলে হাসতে গেলে উপরে-নিচে ঠোঁট ফাঁক হয়ে ভেতরের দাঁত দেখা যায় এবং ঠোঁটের কোণের দিকের পেশি সংকোচন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একে 'ভার্টিকাল হাসি' নামে অভিহিত করা হয়। বহু বছর ধরে মুখের পেশির এই অপুষ্টি গবেষণা করে বিজ্ঞানী ডা. রবার্ট টি.লেশনার জন্মগত মায়েসথেনিয়া গ্রেভিস রোগ সনাক্ত করেন।

১৩. টান টান পেশি মুখ : Myotonic facies

পেশির টানজনিত বিপর্যয় ঘটলে পেশিগুলো প্রসারণের পর আর শিথিল হতে পারে না। তখন মুখের আদল একটি বিশেষ রূপ লাভ করে। একে মায়োটোনিক ফেসিস বা টান টান পেশি মুখ বলে অভিহিত করা হয়।

যারা হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কিংবা কিছু সুনির্দিষ্ট ঔষধ সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই জটিলতা দেখা দেয়। ফলে মাংশপেশি শক্ত হয়ে যায়, চোখের লেন্স ঘোলাটে হয়, ধীর ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হয়, কথা জড়িয়ে যায়, খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।

১৪. জড় মুখ : Torpid facies

মিক্সিডিমা নামে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত একটা রোগ আছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেহারা জড়ভাব সম্পন্ন হয় দেখতে। এ ধরনের মুখকে টর্পিড ফেসিস বা জড় মুখ বলে অভিহিত করা হয়।

থাইরয়েড গ্রন্থির কম কার্যকারিতার কারণে উদ্ভূত মিক্সিডিমা রোগে ত্বক পুরু হয়, মাথার চুল পড়ে যায়, চোখের কোটরের চারপাশ ফুলে যায়, হলদে স্পট দেখা দেয়, ত্বক শীতল ও শুষ্ক হয়ে যায় এবং জিভ ফুলে যায়। এই বিশেষ ধরনের মুখ দেখেই বলা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি মিক্সিডিমা রোগে ভুগছেন।

১৫. মুষিক মুখ : Mouse facies

দীর্ঘদিনের কিডনি রোগে কিংবা শক্ত ত্বক বা স্ক্লেরোডার্মায় মুখের আদল ইঁদুরের মতো দেখতে হয়। মুখের ত্বক টান টান থাকে, মুখে কোন বলিরেখা থাকে না, চিমটি টানা নাক হয়, ঠোঁট পাতলা হয়ে যায়। এই মুখের আদলকে মাউস ফেসিস বা মুষিক মুখো নাম দেওয়া হয়েছে।

১৬. পাখি মুখ : Bird facies

প্রোজেরিয়া নামে একটি বিরল রোগ আছে যাতে অল্প বয়সে দেহের অবয়বে ও আঙ্গিকে বার্ধক্য নেমে আসে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের আদল দেখতে অনেকটাই পাখির মতো হয়। এদের ছোট মুখ, ঠোঁটের মতো বাঁকানো পাতলা নাক এবং হ্রস্বাকৃতি থুতনি থাকে।

১৭. শূকর মুখ : Bovine facies

পেশাগত ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে যাদের নিরাপত্তার খাতিরে মুখে মুখবন্ধ বা মাজল্ ব্যবহার করতে হয়, তাদের মুখের ঠোঁটের কোণায় প্রদাহ ও সংক্রমণ ঘটে। তাদের হাতে-বাহুতে সীমিত কিছু ক্ষত থাকে। এদের মুখের আদল দেখতে অনেকটাই শূকরের মুখের আদল পায়।

১৮. ব্যাঙ মুখ : Frog like facies

গোল্ডেনহাম সিনড্রোম নামে একটা বিশেষ রোগের অবস্থা আছে যাতে চোখ,কান, মুখ ও মাথার অংশ আক্রান্ত হয়। মুখের এই আদলকে ব্যাঙমুখো বা ফ্রগ লাইক ফেসিস বলা হয়।

এই রোগে মুখমণ্ডলের একপাশ বা উভয় পাশ আক্রান্ত হতে পারে। এদের বুকের ডানদিকে হৃদপি-, ডান ফুসফুস অবিকশিত, অস্থানিক কিডনি, উভয় হাতে ঢাকের কাঠি সদৃশ আঙুল থাকতে পারে।

১৯. অমসৃণ মোটা মুখ : Coarse facies

কিছু কিছু ব্যক্তির জন্মগত বিপাকজনিত ত্রুটির কারণে মুখের আদল বিশেষ ধরনের হয়। এদের মাথা বড় ও সামনের দিকে ফোলানো থাকে। মাথার ত্বকে প্রকট শিরা দেখা যায়। এদের নাক থ্যাবড়া ও ঠোঁট মাংসল হয়। ঠোঁট ও জিহ্বা উভয়ই বড় হয়। দাঁতগুলো ছোট ছোট, অতিরিক্ত ফাঁক বিশিষ্ট এবং এবড়ো থেবড়ো হয়। দাঁতের মাড়িও আকৃতিতে বড় হয়। মাথা সামনে-পেছনে লম্বাটে হয়।

হাইপোথাইরয়েডিজম জাতীয় রোগে মুখের সূক্ষ্ম ও তীক্ষè ভ্রূ অনুপস্থিত থাকে, নাক-ঠোঁট-মুখণ্ডথুতনি ভারী হয়ে যায় এবং ত্বক মোটা হয়। মুখটাকে মনে হয় অমসৃণ। মুখে বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের মুখকে মোটামুখো বা কোর্স ফেসিস বলে।

২০. অ্যাডেনয়েড মুখ : Adenoid facies

শিশুদের নাসারন্ধ্রের পেছনের অংশে লিম্ফয়েড টিসু বা টনসিলের মতো একধরনের গঠন দেখা যায়। এদের কাজ হলো ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়াকে ফাঁদ পেতে আটকানো। এই অ্যাডেনয়েড যখন বড় হয়ে যায় তখন আক্রান্ত শিশুর শ্বাস নিতে ও খাদ্য গলাধঃকরণে অসুবিধা হয়। তখন তাদের নাকে নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিবর্তে হা করে নিঃশ্বাস নিতে হয় এবং রাতে দুঃস্বপ্নজনিত কারণে ঘুমুতে পারে না বিধায় দিনে ঝিমুতে থাকে। এরকম শিশুদের হা-করা মুখকেই অ্যাডেনয়েড ফেসিস বলে।

২১. কাঠবেড়াল মুখ : Chipmunk facies

থ্যালাসেমিয়া নামক রক্তরোগে মুখমন্ডলের ম্যাক্সিলা নামক অস্থিদ্বয় বড় হয়ে যায় যাতে মুখখানা কাঠবেড়ালের আদল পায়। এদের পাশাপাশি দুই দাঁতের মাঝখানে গ্যাপ বা ফাঁক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। দাঁতে-ঠোঁটে অতিরিক্ত কামড় লাগে এবং লালাগ্রন্থি বেদনাময় ও স্ফীত হয়। খাবার গিলতে অসুবিধা হয় ও মুখ হা-করে থাকে বিধায় মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। এদের দাঁতের ক্ষয় অধিক হয়।

২২. বিদঘুটে মুখ : Gargoyle facies

হার্লার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুর মানসিক স্তরের ক্রম অবনতি, বামনাকৃতি এবং যকৃত-প্লীহার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মুখের আদল এক বিশেষ আকৃতি লাভ করে। এই বিশেষ আকৃতির মুখকে বিদঘুটে মুখ বা গার্গয়েল ফেসিস বলে। এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশু জন্মের সময় আকার বড় ও স্বাভাবিক দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে এদের ইঙ্গুইনাল বা আমবিলিকাল হার্নিয়া দেখা দেয়।

২৩. মার্শাল হল মুখ : Marshall Hall facies

মস্তিষ্কে কোন কারণে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড জমে মাথার আকৃতি বড় হয়ে গেলে তাকে হাইড্রোকেফালাস বলে। এই হাইড্রোকেফালাসে আক্রান্ত রোগীর মুখের আদলকে ব্যাখ্যা করেছেন শারীরতত্ত্ববিদ মার্শাল হল। তাই তাঁর নামে এই মুখের আদলকে মার্শাল হল মুখ বা গধৎংযধষ ঐধষষ ভধপরবং বলে। এতে রুগ্ন ব্যক্তির চোখ কোটরে নিচের দিকে দেবে যায়। মাথার খুলির হাড় পেটানো তামার পাতের মতো মনে হয়।

২৪. পরশু মুখ : Hatchet facies

মুখমণ্ডলের মাংশপেশির অপুষ্টিতে গালে বা গন্ডদেশে রক্ত সরবরাহকারী খুদে ধমনীগুলো ফুলে মোটা হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালিত হওয়ায় গন্ডদেশ আরক্তিম গোলাপি আভা ধারণ করে। এই মুখাবয়বকে পরশু মুখ বা ঐধঃপযবঃ ভধপরবং বলে।

২৫. ছাইধূসর মুখ : Ashen gray facies

হৃদপিন্ডের রোগ হলো মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন যাতে হার্টের পেশিস্তরে অক্সিজেন না পৌঁছানোর কারণে পেশিতে পঁচন ধরে। একে হার্ট অ্যাটাকও বলে। এই রোগে আক্রান্ত হলে চোখের ভ্রূ নিচে নেমে আসে, ঠোঁটে চাপ অনুভূত হয়, ঠোঁট ভাগ হয়ে যায় এবং মাথা বামে ঘুরে যায়। মুখ হয়ে যায় ছাইধূসর। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঐ ব্যক্তি মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসনে আক্রান্ত।

২৬. ককেইন মুখ : Cockayne facies

ককেইন সিন্ড্রোম নামে এক ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে ক্যালসিফিকেশন দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির মাথা আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয়, দেখতে এরা বামনাকৃতি হয়, চোখ অক্ষিকোটরে ডুবে যায় এবং চেহারায় বার্ধক্য দেখা যায়। এ ধরনের মুখকে ককেইন মুখ নামে অভিহিত করা হয়। ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড আলফ্রেড ককেইন প্রথম এ রোগটি বর্ণনা করেন বিধায় তাঁর নামে এ রোগের নামকরণ করা হয় এবং চেহারার বিশেষ আদলকে ককেইন মুখ বা ককেইন ফেসিস নামে অভিহিত করা হয়। এদের ছোট চিবুক, বড় কান এবং সূক্ষ্ম, পাতলা নাক হয়।

২৭. রিকেট মুখ : Ricketic facies

শিশুদের হাড়ের এক রোগের নাম রিকেটস। এতে অস্থি নরম ও দুর্বল হয়, হাড়ের বিকলাঙ্গতা তৈরি হয়।

এতে ব্যথাজনিত কারণে আক্রান্ত শিশু হাঁটতে চায় না এবং অল্প কিছুদূর হাঁটলেই দুর্বল হয়ে যায়। তার হাঁটার ধরন নূতন হাঁটতে শেখা শিশুর মতো মনে হয়। পায়ের হাড়গুলো বাইরের দিকে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। আক্রান্ত শিশুর নরম, সরু মাথার খুলির হাড়ের কারণে কঙ্কালের বৈকল্য দেখা দেয়। একে ক্র্যানিওট্যাবস বলে। এটা রিকেটস্ এর প্রথম চিহ্ন। এ কারণে শিশুর মুখের আদল বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত হয়। একে রিকেট মুখ বা রিকেটিক ফেসিস বলে।

২৮. ইউরেমিক চেহারা : Uremic facies

আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে রক্তে নাইট্রোজেনঘটিত এক প্রকার রেচন পদার্থ উৎপন্ন হয় যা কিডনির ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ হতে বর্জিত হয়। এই পদার্থটাই হলো ইউরিয়া। যখন এই ইউরিয়ার পরিমাণ রক্তে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় তখন ইউরেমিয়া নামে বিশেষ এক শারীরবৃত্তীয় অবস্থা তৈরি হয়। এতে মুখের আয়তন বাড়ে, নাক, চোয়াল ও মাথার খুলির ভিতের আকৃতি বাড়ে। গন্ডদেশের হাড় বা ম্যাক্সিলা চোয়াল বা ম্যান্ডিবলের চেয়ে আয়তনে বাড়ে। এ অবস্থায় মুখ এক বিশেষ আদল লাভ করে। একে ইউরেমিল চেহারা বা ইউরেমিক ফেসিস বলে।

২৯. বানর মুখ : Monkey facies

শিশুদের মারাত্মক অপুষ্টিজনিত একটা রোগের নাম মেরাসমাস। এতে যুগপৎ আমিষ ও ক্যালরির ঘাটতি হয়। ফলে আক্রান্ত শিশুর চেহারা একপর্যায়ে বানরের মুখের আদল পায়। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বানরমুখো বা মাঙ্কি ফেসিস নামে অভিহিত করেছেন।

৩০. লিভার মুখ : Hepatic facies

ভাইরাল সংক্রমণ বা অতিরিক্ত প্যারাসিটামল সেবনজনিত বিষক্রিয়ায় বা অটোইমিউন লিভার রোগে লিভার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের আদলে পরিবর্তন আসে। মুখের এ আদলকে লিভার মুখ বা হেপাটিক ফেসিস বলে।

আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ পাওয়া যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়ত গবেষণার মধ্যে দিয়ে নিজের পরিধিকে বিস্তৃত করে তুলছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও কিছু নতুন রোগ বা সিন্ড্রোমের উদ্ভব হবে এবং এইসব নতুন রোগ বা সিন্ড্রোমকে যথার্থভাবে প্রকাশ ও পরিচিতি দিতে আরও নতুন নতুন মুখ বা ফেসিস এর অবতারণা করা হবে। মূলত রোগের অধ্যয়নকে সহজ করে তোলা এবং চিকিৎসার খাতিরে রোগ সনাক্তকরণে সহজ পন্থা অবলম্বনের তাগিদেই নানা রোগে নানা মুখের নামকরণ। এর মধ্য দিয়ে রোগ সম্পর্কে জানা যেমন সহজ হয়েছে তেমনি মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা বিজ্ঞানও নানা অবদান নিয়ে এগিয়ে আসতে পেরেছে। মুখ যেমন মনের কথা বলে মুখ তেমনি রোগের কথাও বলে। মুখ দিয়ে রোগের পরিচিতি আমাদের কল্যাণে কার্যকর হোক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়