প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ০০:০০
কথায় বলে দুধে-ভাতে বাঙালি। এদেশবাসীর হাজার বছরের উচ্চারিত তৃপ্তির অহংকার। পারিবারিক পরিমণ্ডল এবং স্কুলজীবন হতে গো-দুগ্ধের মাজেজার বয়ান শুনে আসছি। শুধু আমাদের এ ভূ-ভাগেই নয় পৃথিবীর সকল জনপদেই গরুর দুধ খাদ্য হিসেবে বিশেষভাবে আদৃত। এক গ্লাস গরুর দুধ খেয়েই মানুষ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। সদ্যজাত শিশুকেও খাওয়ায়। রোগীদের জন্যে আমাদের দেহ-প্রকৌশলী তথা ডাক্তার সাহেবদের বিজ্ঞজনোচিত ব্যবস্থাপত্রে গরুর দুধ পানের তাগিদ থাকে। আধুনিক গবেষণার আলোকে এবং বাস্তবতার নীরিখে আসলেই কি গরুর দুধ মানব দেহের জন্য কল্যাণকর না পুরো ব্যাপারটাই একটি বিপজ্জনক মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা চলে আসছে শতাব্দির পর শতাব্দি তথা পুরুষানুক্রমে?
আধুনিক খাদ্য ও দেহ-বিজ্ঞানীদের পূর্বপুরুষেরা বৈজ্ঞানিক ফতোয়া জারী করে বলেছিলেন, গরুর দুধ আদর্শ খাদ্য! দৈহিক গঠন ও শক্তিমত্তা উৎপাদনে গরুর দুধের বিকল্প নেই। হয়তো তাঁরা ষাঁড়ের স্বাস্থ্য ও দৈহিক শক্তি দেখে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন মানবস্বাস্থ্য তথা মানুষ ও ষাঁড়ের পার্থক্য। অদ্যাবদি সে ফতোয়া কার্যকর। আবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞাপনী ভাষা। যেনো গরুর দুধ পান করলে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মঙ্গলও সাধিত হবে! শুধু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কেনো খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে অস্ত্র শিল্পের পরের সর্বোচ্চ শিল্প দুধ শিল্প। আর এ দুধ শুধু তরলিতই নয় এর হাত ধরে জাতে উঠেছে ছানা, দই, টকদই, ঘোল, চিজ, ছানা গোলগোল চেহারার রসগোল্লা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে এ সুন্দরী দুধের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জাতের ক্যামিকেল, কৃত্রিম রং, টিস্যু পেপারের মণ্ড, বিট চিনির মতো ভিলেনের। তবে এর প্রেমিক অসংখ্য। যেমন : এলার্জি, ডায়াবেটিস, গ্যাসট্রিক, গ্যাসট্রিক আলসার এবং তা ক্যান্সারেও গড়াতে পারে।
গরুর দুধ সামাজিক অনেক প্রাচীন অনুসৃত বিশ্বাসের মতই একটি অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস। অন্তিম শয্যায় সন্তানের প্রতি গুরুজনদের আশীর্বাদ ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। অথচ মানুষ জানলে সন্তানকে এ ধরনের অভিশাপ দিতেন না। স্মরণযোগ্য যে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী শিশু ৬ মাস থেকে ১ বছর যাবৎ মাতৃদুগ্ধনির্ভর। তারপর শক্ত খাবারই সকলের প্রয়ােজন। মানব শিশুর বেলায়ও তাই। অথচ মা-বাবাই শিশুদের সাথে সাথে গরুর দুধ পানে নিজেদের অভ্যস্ত করে রাখেন। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জানা যায় যে, স্বাস্থ্যবৃদ্ধির জন্য আমরা যে দুধপান করছি ফলাফল দাঁড়ায় তার বিপরীতে। আমাদের প্রাচীন পন্থি খাদ্য বিশারদগণ বলেন যে, দুধে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন ডি মানব দেহের জন্য উপকারী অথচ দুধের প্রোটিন তথা কেজিন অত্যন্ত নিম্নমানের, যা উপকারের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি করে। এক গ্লাস দুধ তথা ২৪০ মিলিলিটারে থাকে নাকি প্রচুর ক্যালসিয়াম! বৃটিশ মেডিকেল জার্নাল ২০১৪ সালের ১১ জুন সংখ্যায় ৬১,৪৩৩ জন মহিলা যাদের বয়স ৩৯ বছর থেকে ৭৪ বছর এবং ৪৫,৩৩৯ জন পুরুষ যাদের বয়স ৪৫ বছর থেকে ৭৯ বছর যারা নিদেনপক্ষে দৈনিক ১ গ্লাস থেকে ৩ গ্লাস দুধ পান করতেন, তাদের উরুসন্ধির হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। কারণ গরুর দুধে রয়েছে 4-iso-PGF2a এবং Interlexuin-6 যাদের কাজই হলো অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং ইনফ্লেমেশন বা ধমনীর প্রদাহ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মহামারী ও পুষ্টিবিভাগের অধিকর্তা অধ্যাপক ওয়ালটার ইউলেটের মতে, দুধ পানের যে নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো ঢালাওভাবে দিচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। পৃথিবীতে মার্কিনীরা সবচে বেশি দুধ পান ও ক্যালসিয়াম সেবন করে অথচ মার্কিনীদের হাড়ই সবচে’ বেশি ভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু। অথচ সবচে’ কম দুধ ও ক্যালসিয়ামসেবী চাইনিজদের হাড় তুলনামুলকভাবে বেশি শক্ত।
সুইডিস বিজ্ঞানীদের গবেষণায়ও প্রমাণিত যে, গরুর দুধে হাড়ের স্বাস্থ্য ততো বৃদ্ধি করতে পারছেই না। বরং হৃদরোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অকালমৃত্যু ডেকে আনে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিকরা আরও সতর্ক করেছেন যে, গরুর দুধে হাড় বা স্বাস্থ্যকে উপকৃত না করে দেহে চর্বি বৃদ্ধি করে এবং ক্যান্সারকে আমন্ত্রণ জানায়। দুধের শতকরা ৮৭ শতাংশ পানি, ৪ শতাংশ প্রােটিন। আবার এ ৪ শতাংশ প্রােটিনের শতকরা ৮০ ভাগই কেজিন। আবার এ কেজিন হলো আঠা। তা-ও আবার নিম্নমানের, যা আসবাবপত্রের কাজে লাগে।
এতো গেলো একেবারে খাঁটি দুধের আখলাক। বাণিজ্যিকভাবে পোষা গরুর কৃত্রিম খাদ্য, রোগ-শোক হতে বাঁচাবার জন্যে গরুকে দেয়া অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমন ইনজেকশন, অক্সিটোসিন ইত্যাদি। এ ধরনের দুধে ওএঋ-১ একপ্রকার হরমন থাকে, যা খেলে স্তন ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার ও অন্ত্রের ক্যান্সার হয়। অ্যালার্জি, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া এ সকল রোগের সরবরাহ একেবারে ফ্রি! এছাড়া দুধের ঘনত্ব বৃদ্ধির জন্য দুধে মেশানো হয় ইউরিয়া, গ্লুকোজ, ফরমালিন। দুধ জমানোর জন্য সালফিউরিক এসিড, পানি, মেলামাইন, রেনেট তৈল, ডিটারজেন্ট ও কষ্টিক সোডা। এর শেষ পরিণতি হৃদরোগ এবং ক্যান্সার। স্মরণ রাখা উচিত প্রত্যেক প্রাণীর পৌষ্টিকতন্ত্র সৃষ্টিকর্তা এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে সে প্রাণীটি তার মায়ের দুধই হজম করতে পারে। এখন রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে দেখতে পাবেন, গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যসেবী বেশির ভাগ শিশুই তার দৈর্ঘ্য হতে প্রস্তে বড়। শেষ পরিণতি হার্ট ডিজিজ, প্রেসার, অ্যালার্জি, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার। আরো মনে রাখতে হবে একজন মানুষ উচ্চতা হারে যতো শতাংশ বেশি ওজনের ঠিক বিপরীত দিক হতে তার দৈহিক শক্তি ও মগজের কার্যকারিতা ততো কম। নিশ্চিত থাকুন পরীক্ষায় দেখা গেছে গরুর দুধে গোবর থাকে। আপনি গোবর খাবেন কি না ভেবে দেখুন। মানব দেহের জৈবিক প্রক্রিয়ার বাইরে গেলে নিশ্চিতভাবে আপনাকে মানব গ্যারেজে তথা হাসপাতালে যেতে হবে। ১ মিলিলিটার দুধে কমপক্ষে ৭৫০,০০০ পশু রক্তের শ্বেতকণিকা আর ২০,০০০ রোগ-জীবাণু থাকে। আমাদের দেশের গরু, গরুর দুধ, দুধের মালিক সবই প্রাণঘাতি ভাইরাস! নির্ভেজাল একমাত্র স্বাস্থ্যসম্মত, মানবদেহে আমৃত্যু কার্যকর মাতৃদুগ্ধের জন্যে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র : বিদেশী জার্নাল ও মাসিক গণস্বাস্থ্য।
আহমেদ উল্লাহ ভূইয়া : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আয়কর আইনজীবী।