প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
বাবার নয়জন ছেলে-মেয়ে। পাঁচ-চার। ইস্ আর দুজন হলে একটি ক্রিকেট টিম হয়ে যেতো। অথবা এক জন বোন হলেও চলতো। সমানে সমান হতো। সে যাই হোক ভাইদের মধ্যে সবার ছোট আমিই। আমার ছোট একটি বোন আছে। ছোট বলতে ছোট নয়, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা যতোদিন ছিলেন আমরা ভাই মিলে ভালোই ছিলাম। বাহান্নবর্তী না হলেও বিয়াল্লিশবর্তী বলা যেতো। সাদাসিদে বাবা আমার। বাবার কাঁধে সবসময় একটা গামছা থাকতো। বৃহস্পতিবার সোনাপুরে হাট বসে। বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার সোনাপুর হাটে যেতেন। বৃহস্পতিবার মানেই আমাদের জন্যে ছিলো ঈদের দিন। বিকেল হলেই অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাবা হাট থেকে আসবেন। হাট থেকে নিয়ে আসবেন আমাদের শখের জিনিস। বাবার জন্যে সামনে এগোতেই দেখি এক হাতে একটি বড় ব্যাগ, অন্য হাতে ছোট আরেকটি ব্যাগ। বাবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারতেন না। দৌড়ে গিয়ে হাত থেকে ব্যাগ নিতাম আর নাচতে নাচতে বাড়িতে আসতাম। বাড়িতে আসা মাত্রই বাবা উঠোনে আসন পেতে বসতেন। আমরা বাজার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতাম।
একটা সময় চাঁদপুরে বোনের কাছে চলে যাই। এখানে একটা স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। বাবা-মা থেকে অনেক দূরে চলে এলাম। বাবা আমার খুব কেয়ারিং করতেন। আগলে রাখতেন। আবার অল্পতেই ক্ষেপে যেতেন। আমি ছিলাম অগোছালো। ঠিকমতো গোসল করতাম না। তাই বাবার সাথে যেখানেই দেখা হতো সবার সামনে বলে দিতেন ‘কয়দিন হইছে গোসল করিসনা?’ খানিকটা লজ্জা পেতাম, আবার খারাপও লাগতো, তাই চুপ করেই থাকতাম সবসময়।
জেএসসি পরীক্ষার পরে চাঁদপুর থেকে চলে আসি ফরিদগঞ্জ। আমার এসএসসি পরীক্ষার আগেই চার ভাই বিদেশে চলে যায়। বাড়িতে পুরুষ বলতে আমি আর বাবা। কিছু হলেই আমাকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবাকে নিয়ে যাই ময়নামতি কেন্টনম্যান্ট হাসপাতালে। বাবা এতোটাই দুর্বল হয়ে গেছেন যে, হাঁটতে পারতেন না। তারপরও হাসপাতের করিডোরে নিজে নিজে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি পাশেই ছিলাম, বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বুঝ হবার পর এই প্রথম বাবাকে জড়িয়ে ধরি। বাবার কষ্ট দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলাম না।
বাবা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। সবসময় বলতেন, ‘তুইও বিদেশ চলে যা। কি করবি দেশে থেকে? আমি থাকতেই চলে যা বাবা।’ সে থেকেই বাবা কদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। আমিই নিয়ে যেতাম চিকিৎসকের কাছে। করোনাকালে বাবা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক অনেকগুলো টেস্ট দিলো কিন্তু লিভার, কিডনির কোনো পরীক্ষা দেননি। তিনি বললেন, ‘কোনো সমস্যা নাই, ওষুধ দিছি ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু দিন দিন তিনি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। একদিকে লকডাউন। ঢাকায় নিতে পারছি না। আমি এক পল্লী চিকিৎসকের চেম্বারে সময় দিই। তিনি একদিন বললেন, ‘অনেক চিকিৎসকই তো দেখালে, আমাকে একবার দেখাও।’ তিনি বাবার পেট দেখেই বলেন, ‘তোমার বাবার লিভার পরীক্ষা করে দেখো।’ বাবাকে নিয়ে যাই চাঁদপুরে। জন্ডিস, লিভার, কিডনি পরীক্ষা করে চিকিৎসক বললেন, ‘বাবার লিভারে সমস্যা, হাসপাতাল ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।’ বিষয়টি ভাইদের জানালাম। বললেন, ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করাতে। সন্ধ্যার দিকেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে গেলাম। রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেলাম। কিন্তু সেখানে কোনো সিট পেলাম না। সেখান থেকে রাত ১২টায় নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেখানেও সিট পেলাম না। ঘুরতে ঘুরতে রাত ২টা বেজে গেছে। আমার সাথে ছিলো আমার বন্ধু সৌরভ। দুই বন্ধুর অবস্থা পাগলপ্রায়। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ইবনে সিনা হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করাই।
বাবা তখনো মানসিকভাবে স্ট্রং ছিলেন। রমজান মাস, সে রাতে আর ঘুমাইনি। বাবার পা মালিশ করতে করতে সেহরী খাওয়ার সময় হয়ে গেলো। পরদিন রিপোর্ট আসলো। চিকিৎসক জানালেন, বাবার কিডনী সমস্যা, জন্ডিসের সমস্যাও আছে। আরো জানালেন, বাবাকে মিনিমাম ১৫-১৬ দিন হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হবে। চিকিৎসকের কথা শুনে একটু শান্তি পাইলাম। চিকিৎসক যাওয়ার পরে বাবা আমারে বলেন, ‘আরেহ ভাবিস না বাবা, দুইদিন পরে আমরা বাড়িতে যাইয়ামগিন’। আমি হেসেই বললাম, ‘হ ডাক্তার কইছে ১৫-১৬ দিন থাকতে হবে।’ বাবা বলে ‘আর আছেনি কথা? তুই থাইস, আঁই দুইদিন থাই যাইয়ামগিন।’
ওই রাতেই বাবার অক্সিজেন সমস্যা দেখা দেয়। পরের দিন চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (পিজি) হাসপাতালে রেফার করেন। বাবা পানি খেতে চাইছে কিন্তু সাততলায় পানি নেই। লিফ্টে দেরী হবে বলে সাত তালা থেকে লাফাই লাফাই নেমে রাস্তা গিয়ে আবারও সিঁড়ি দিয়ে উঠে পানি নিয়ে আসছি। পানি খাওয়ার পরে বাবা গেলো ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম থেকে এসেই বাবা হাফাচ্ছে আর আমাকে বলে, ‘বাবা, তুই কী আমারে মেরে ফেলবি? এখানে আনলি কেন? আমারে ইবনে সিনায় নিয়ে যা।’
বাবার অবস্থা দেখে আমি অস্থির হয়ে যাই। তাকে নিয়ে আবার ইবনে সিনায় রওনা দিলাম। দ্রুত জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম। বাবার অবস্থা এতোটাই করুণ যে, অক্সিজেনের লেভেল ৬০-এর নিচে নেমে গেছে। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত আইসিইউতে নিলেন। বাবা ভয়ে যেতে চাইলেন না। এ সময় ক্রন্দনরত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বাবা, আঁরে আইসিইউতে ঢুকাইলে আমার লাশ পাবি; ঢুকাইস না। স্বাক্ষর দিতে গিয়ে চোখের পানিতে কাগজ ভিজে যায়। সারা রাত বাবার পাশে ছিলাম। বাবার অবস্থা আগের থেকেও খারাপ। এদিকে মা বলতেছে বাবাকে চাঁদপুর নিয়ে যাইতে। শেষ পর্যন্ত মায়ের অনুরোধে বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে চাঁদপুর মিডলেন্ড হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। পথে বাবা খুব ছটফট করছিলো, বাবার অবস্থা দেখে খুব খারাপ লেগেছে। সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে, আমি ঘুরে পড়ে যাচ্ছি। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আর কিছুই মনে নাই। উঠে দেখি বেডে শুয়ে আছি। বাবা পাশের বেডে।
জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম বাবা হাসফাঁস করছে। কিছুক্ষণ পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বাবাকে কোলে নিয়ে বসে আছি। এভাবেই কেটে গেলো সারা রাত। সকালে ডিউটি চিকিৎসক সব রোগীকে দেখলো কিন্তু বাবাকে দেখতে আসলো না। দীর্ঘ একঘণ্টা অপেক্ষার পর চিকিৎসক এসেই বলে, ‘এই রোগী আমি দেখবো নাহ, আইসিইউর রোগী। ঢাকায় নিয়ে যান। কিছু হয়ে গেলে দায়ী আমরা না।’ চিকিৎসকের কথা শোনে বাবা সাথে সাথেই স্ট্রোক করেন। বাবার এ অবস্থা দেখে বোনেরা ভাবীরা হাসপাতালের ভেতরেই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নিজেকে কন্ট্রোল করে বাবাকে ধরে রাখলাম। একটু পরেই তিনি চোখ খুলে বসে গেলেন। কেনো জানি বাবা আইসিইউতে যেতে চাইতেন না। তাই তিনি বার বার বলতে লাগলেন, ‘বাবা আঁরে আইসিইউতে ঢুকাবি...?’ আমি কান্না করায় অবস্থা বললাম, ‘নাহ বাবা’। এ কথা শুনে বাবা এবার শান্ত হয়ে বেডে শুয়ে পড়লেন। নার্স আসলো, বাবারে চেকআপ করালো। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘বাবার কী অবস্থা?’ জবাব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে চাইছে বাবার সাথে আমিও চলে যাই। বাবাহীন আমি বাঁচবো কী করে। নার্স বললো, ‘বাবা মারা যাবেন।’
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম বাবার হাত দুটা বাঁকা হয়ে আসতেছে, চোখ কেমন জানি উল্টে যাচ্ছে, বোনদের সাথে আমিও বাবা বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম। ততোক্ষণে বাবা আর নেই। বাবার পুরো শরীর ঠা-া হয়ে গেছে। এক নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেলো। এদিকে মা-ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।
বাবাকে হারিয়ে যতোটা না আঘাত পেয়েছি তারচেয়ে দিগুণ আঘাত পেয়েছি বাবার লাশ চাদর দিয়ে মোড়াতে গিয়ে। সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাই। জ্ঞান ফেরার পরে দেখি চাচাতো ভাইদের ঘরে। আমার চারপাশ মানুষ ঘিরে আছে।
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা