প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
ভালোবাসার কোনো বয়স নেই। তবে পাগলামির একটা নির্দিষ্ট সময় লুকিয়ে। শরতের কাশফুল ফুটবে, জোসনা আলোর ঝলকানি দেখাবে, গ্রীষ্মে প্রখর রোদ্দুর হবে, বর্ষায় বর্ষণ হবে, হেমন্তে ধান পাকবে, শীতে কুয়াশা পড়বে আর বসন্তে কোকিলের কলোতানে মুখরিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তবতা। আজ লোপার কথা বেশি মনে পড়ছে, হৃদয়ে পেরেক গেঁথে যাওয়ার মতো অবস্থা।
পাগলামির কথা মনে পড়তেই বেশ লাজুকতায় গুটিয়ে নিচ্ছি শীতের চাদরে গুটিয়ে নেওয়ার মতো। কি আশ্চর্য সময়ের ভেতর পার করছি! ভৌতিক কি না জানা নেই, তবে অদ্ভুত সময় ছিল। পাওয়ার জন্য ছিল আকুলতা আর না পাওয়ার জন্য ছিল অস্থিরতা। পাওয়ার আকুলতায় কোথায় না গিয়েছি। কতই না পাগলামি করে গারদে থাকার মতো সময় পার করছি।
লোপা ছিল আমার ক্লাসমেট। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দরী ছিল। ছাত্রী হিসেবে ছিল মেধাবী। তাকে আমার শুধু ভালো লাগত বললে ভুল হবে। তাকে আমার অস্বাভাবিক ভালো লাগত। তার জন্য ছিল মূলত আমার সব পাগলামি। আমার নিঃশ্বাস নেওয়ার অক্সিজেন, আমার বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় ভাবতাম। সে যেখানে টিউশন নেয়। আমিও সেই স্যারের কাছে একই সময় বেঁধে টিউশনে যুক্ত হই। স্যারের কাছে পৌঁছাতে ভার্সিটির ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে যেতে হতো। প্রাইভেট ছিল সকাল ৯টায়। আমি ঘুম থেকে উঠতাম সকাল ৭টায়।
উঠেই ব্রাশ নিয়ে চলে যেতাম বেসিনে। বেসিনে গিয়ে অনেকক্ষণ পানি ঝাপটা দিতাম। পানি ঝাপটায় নাকি মুখের ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিতাম। এবার ফেসওয়াশ দিতাম। অনেকক্ষণ মুখে লাগিয়ে রাখতাম। আবার আয়না দেখতাম। এভাবেই চলতে থাকত আমার প্রাইভেট যাওয়ার প্রস্তুতি। বেশির ভাগ সকালের খাবার খাওয়া হতো না। অনেক দিন খেতে বসেই খাবারে পানি দিয়ে চলে যেতাম। রুমে পোশাক পরতেও অনেক সময় লাগত। কেডস নাকি স্যান্ডেল? কোনটা পরলে যে ভালো হতো এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতাম। এ সময় অনেক কিছুই ভাবতাম। তারপর ছুটে চলতাম কলেজ ক্যাম্পাসে। বসে থাকতাম লোপার জন্য।
সে কখন আসবে! তার জন্য অস্থিরতার প্রহর পার করতাম। সে দেরিতে এলে আমার প্রাইভেট পড়া দেরি হতো। সে আগে এলে আমার প্রাইভেটে আগে যাওয়া হতো। সে প্রাইভেটে না এলে আমার প্রাইভেটে যাওয়া হতো না। সে যখন ক্যাম্পাসে আসত, আমি দূর থেকে দেখতাম। সে ২০০ গজ গেলে আমি তার পিছু পিছু যেতাম। এই যাওয়াটা যে কত সুখের, এই যাওয়াটা যে কত আনন্দের, এই যাওয়াটা যে কত মধুরতম, এই যাওয়াটা যে কত ভালো লাগার, এই যাওয়াটা যে কত মিষ্টিময় তা হয়তো সেই সময়ই বুঝতাম।
এক দিন লোপার জন্য অপেক্ষার প্রহর পার করছি। কিন্তু সে আসছিল না। আমতলা যাচ্ছি, জামতলায় যাচ্ছি, বটতলায় যাচ্ছি। এদিক তাকাচ্ছি, ওদিক তাকাচ্ছি। তার পরও তার কোনো খবর নেই। প্রাণের ভেতরে যেন দাউ দাউ করে পুড়ছে। অস্থিরতায় হৃদয় কাতর। আমার হৃদয় আকাশ গর্জনে বিকট শব্দ হচ্ছে। মনের মহাসাগরে উত্তালতরঙ্গ বহমান। হৃদয় যেন ধু-ধু সাহারা মরুভূমির মতো। তাকে তখনো বলাই হয়নি তোমাকে ভালোবাসি। না বলা প্রেমেই তার জন্য অস্থির থেকে অস্থির। তাকে দেখার জন্য আমার উন্মাদনা বেড়ে চলে।
এক দিন, দুদিন, তিন দিন পড়ে সে আসে। জানতে পারলাম সে ছিল অসুস্থ। তার অসুস্থতার কথা শোনার পর যেন আমার ভেতর কান্নার আহাজারি শুরু হয়। চোখে জল এলেও তা আড়াল করে মুছে ফেলি। তার প্রতি আরো মায়া বেড়ে যায়। স্থির করি তাকে মনের না বলা কথাগুলো বলে দেব। আর নিজেকে আড়ালে রাখতে চাই না। আর নিজেকে দূরে সরে রাখতে চাই না। বান্ধবী মুন্নীকে দিয়ে আমি তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিই। কিন্তু সে সরাসরি নাকচ করে দেয়। সে জানায় লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু না।
কথাটি শোনার পর বুকে কালো মেঘ জমাট বাঁধল। মনে সিডর বয়ে যেতে শুরু করল। আমি অনেকটাই নিরাশ হলাম। তবে মুন্নী আমায় আশান্বিত করে বলল আমি যেন তাকে সরাসরি বলি। হ্যাঁ, আমিও নিজেকে তৈরি করলাম তার সামনে দাঁড়ানোর জন্য। রাতে আয়নার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করলাম। আমার একটাই সমস্যা আমি সবার সামনে বেশ কথা বলতে পারতাম কিন্তু তার সামনে পারতাম না।
আয়নাকে লোপা বানিয়ে কথা বলতাম আয়নার সঙ্গে। পরদিন সকালে অনেক আগেই ক্যাম্পাসে গিয়ে হাজির। অপেক্ষা ছিল শুধু লোপার জন্য। একবার লেকের ওপর বসি, আবার উঠি। শেয়ালের মতো এদিক-সেদিক বারবার তাকাই। সে এলো। সাহস করে তার সামনে গেলাম। তার পথ আটকালাম।
‘লোপা দাঁড়াও! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
‘তোমার যে কথা তা আমি জানি। তোমার প্রশ্নের উত্তরও আমি জানিয়ে দিয়েছি’ লোপা বলল।
‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তোমাকে ছাড়া আমি চলতে পারব না। তোমাকে আমি ভালোবাসি।’ বলতেই চোখে জল চলে আসে।’
সে বলল, ‘সরি, আমার কিছু করার নেই।’
বলে সে ফাইভ-জি গতিতে চলে গেল। তখন সেই সময়টায় নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। আমি তখন পুরোপুরি স্থির করি আত্মহত্যা করব। এই পৃথিবীর আলো দেখার আমার আর কোনো ইচ্ছেই নেই। বিষ খাব। ফাঁস নেব। না হয় গাড়িচাপায় মারা যাব। মুন্নীকে সব জানালাম।
সে আমায় বেশ সান্ত্বনা দিল। পরের দিন দেখি লোপাসহ মুন্নী রেহেনা ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি সেখানে গেলাম। লোপার হাত ধরলাম। আর বললাম, লোপা প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে ছাড়া সত্যি চলতে পারব না। সে হাত জোরে সরিয়ে নিল। আমায় একটা থাপ্পড় দিয়ে সে জায়গা ত্যাগ করল। সবাই হতবাক। কী কা-! কারো মুখে যেন কোনো কথা নেই। পুতুলের মুখে যেন এবার কথার খই ফুটল।
সে বলল, ‘তোর কাছে একটা অনুরোধ ভাই, তুই এই রকম পাগলামি করিস না। তোর নিজস্ব একটা ফ্যামিলি স্ট্যাটাস আছে। ওই রকম এক লোপা তোর না হলে চলবে। সে নিজেকে কী মনে করে, নিজেকে কী ভাবে। তুই লোপা বাদ দিয়ে এই ক্যাম্পাসে কোনো মেয়েকে চাস। আমি এনে দেব তোর হাতে।’
‘আমি লোপাকে ছাড়া চলতে পারব না রে’ বলেই বোবা কান্নার আহাজারিতে নিজেকে সামলাতেই পারছিলাম না। সবাই আমায় কতভাবে সান্ত্বনায় বেঁধে রাখতে চাচ্ছে, আমার কিছুই খেয়াল হচ্ছিল না।
কয়েক দিন বেশ নীরব। সুনসান নীরবতায় যেন আমার সব বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যাওয়া নদীর মতো স্থির হয়ে যাই আমি। ক্লাস-প্রাইভেট, ফোন সবই বন্ধ। সিদ্ধান্ত নিলাম কাউকে না জানিয়ে দেশের বাইরে যাব।
কাউকে না জানিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে চলে যাই। দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়ে জীবনকে বেশ পরিবর্তন করে ফেলি। শুরু করি সিরিয়াসলি স্টাডি। ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করি লোপাকে। মোটামুটি আমি লোপাকে ভুলে যাই। উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরি। একটা বৃহদায়তন কোম্পানিতে জবে যুক্ত হই।
হঠাৎ করেই এক দিন মুন্নীর ফোন। সে আমার ভয়েস শুনেই আবেগে কেঁদে ফেলে। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। সে আমার নম্বর অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছে। জানতে পারলাম লোপার কথা। তার বিয়ে হয়েছে। দুটো বাচ্চাও হয়েছে। সে একটা ব্যাংকে জব করে। আমার সঙ্গে সেদিনের ব্যবহারের পর থেকে আমাকে সে হন্ন-তন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি। মুন্নীর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সে এখনো মুন্নীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আমার দেশে ফেরার খবর জানতে পেরেছে। সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ক্ষমা নিতে চায়। সে অনুশোচনায় ভুগছে। তার অপরাধবোধ তাকে দৈনন্দিন পীড়ন দেয়। আমি মুন্নীকে সরাসরি বলে দিই। সে সময়ের নিখোঁজ হয়েছে। বলে রেখে দিই। সময়ের পালাবদলে এভাবেই সময়ের নিখোঁজ হয়।