প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
একজন অচেনা লোককে গত কয়েকটা দিন ধরে খালি ঘুরঘুর করতে দেখছি আমাদের এলাকায়। আচার-আচরণ কেমন যেনো শিথিল ভাব। যেনো স্থবির হয়ে গেছে সবকিছু। চারপাশে কতকিছু প্রবল বেগে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ছোট ছোট শিশুরাও ‘বড় বড়’ পা ফেলে তার আগে আগে চলে, কিন্তু বেচারার মধ্যে যেনো কোনো বেগ নেই, যেনো কোনো গন্তব্যও নেই তার। কখনো কচ্ছপ গতির হণ্টনে এলাকায় টহল মারেন। কখনো বা কোনো এক জায়গায় বসে ঝিম মেরে থাকেন।
লোকটির বয়স ৪৫। এই লোককে আমি কখনো দেখিনি। কী চায় সে এখানে? লোকটা কি পাগল? নাকি কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চর? নাকি কোনো দুষ্টু চক্রের কার্যকরী সদস্য? কয়েকদিন ধরে বেশ পর্যবেক্ষণে রেখেছি আমি লোকটিকে। কিন্তু, না, তাকে উপর্যুক্ত তিন ক্যাটাগরির কোনোটিতেই ফেলতে পারিনি। তবে কে সে?
একদিন জানতে পারলাম, লোকটা অনেক আগে আমাদের এই পাড়াতেই থাকতো। সেও প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। বাবা-মা ভাই-বোনদের নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। একদিন, হঠাৎ ২০ বছরের তরুণ ছেলেটির আর এলাকায় কোনো দেখা পাওয়া যায় না। অথচ, তার এক মনের মানুষ ছিল। জীবনে যার পিছনে অনেক সময় কাটিয়েছে সে। তার বাবা-মা বেঁচে ছিল। অনেক ভালোবাসতেন তারা ছেলেটিকে। ভাই-বোনদের কথা নাহয় নাই বললাম। তাদের সবার মায়ার বাঁধন ছেড়ে সে কোথায় গেল?
এতদিন পরে, দীর্ঘ ২৫ বছর পরে লোকটা ফিরে এসেছে। কিন্তু কী চায় সে এখানে? সে চলে যাওয়ার পর তার বাবা খুব বেশিদিন বেঁচে ছিলেন না। মাও গত হয়েছেন অনেক বছর। ভাই-বোনদের তো কোনো খবরই নেই। হয়তো এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা।
আজ এতদিন পরে সেদিনের সেই তরুণটি কী মনে করে এখানে এলো? কী করছে সে, তার তৎকালীন সেই ভালোবাসার মানুষটির বাসার আশপাশে? তার সেই প্রিয় মানুষটি তো আর সেখানে নেই। স্বামীকে নিয়ে কোথায় ঘর বেঁধেছে কে জানে? হয়তো ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত কেটে যাচ্ছে দিন। রহস্যময় লোকটি কী করছে তাদের সেই পুরনো ভাড়া বাসার আশপাশে? বাবা-মা তো নেই। ভাই-বোনরাও থাকে না। কেন সে তাদের কোনো খোঁজ নিচ্ছে না? কেন সে তাদের কাছে না গিয়ে এখানেই পড়ে আছে?
লোকটি যখন এখানে ছিল, তখন সে তরুণ। একেবারে আমার মতোই। আমার মতোই উচ্ছ্বাস ছিল তার জীবনে। ভবিষ্যতের সুন্দর একটা স্বপ্নও বুঝি সে এঁকে রেখেছিল তার মনের রঙিন ক্যানভাসে। আমার মতোই হয়তো সে অনাবিল আনন্দে কাটিয়ে দিচ্ছিল তার যৌবনের দিনগুলো? তবে কেন সে চলে গেল? আর গেল যখন সকল মায়া-মহব্বতকে পাশ কাটিয়ে, তখন ফিরে এলো কেন? সে কি জানে না, তার সেই সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে অনেক ফারাক। সেই সময়ে যে আমার জন্মই হয়নি, সেও এখন তখনকার তার বয়সী! তার সে সময়কার প্রেমিকাটি এখন সেই একই বয়সী কোনো মেয়ের মা। তবে, কেন? কীসের মায়ায় সে এখানে পড়ে থাকে?
‘আমি জেল থেকে এসেছি।’
উদাস নয়নে সেদিন লোকটি আমার কৌতূহলের জবাব দিল। প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেললাম আমি তাকে। শেষে এমন অবস্থা হলো-আমার কোনো প্রশ্নই আর করার রইল না। না, আমার প্রশ্ন ফুরিয়ে যায়নি, আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।
‘হ্যাঁ, গত ২৫টা বছর আমি জেলে ছিলাম। তাও বিনা বিচারে। আমি সবসময়ই বলেছি যে, আমি নির্দোষ। আমাকে যে অভিযোগে জেলে পুরা হয়, সেই অপরাধেও এত বছরের শাস্তির বিধান নেই। তারপরেও আমি জেলে ছিলাম। বারবার বলেছি, কেউ শোনেনি আমার কথা। প্রথম প্রথম বাবা-মা আসত। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আসত। সেও গত হওয়ার পর আর কেউ আসেনি। মায়ের মৃত্যু সংবাদটাই তো পাইনি ঠিকমতো। এখন আমি কী করব? কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার হারানো যৌবনের দিনগুলোকে?’
এই বলে লোকটি একটু থামল। হয়তো আমার পরবর্তী প্রশ্নটি শোনার অপেক্ষায়...
এদিকে আমি তখন কান্না লুকানোর উপায় খুঁজছি।