রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

পাতাদের সংসার

সোহেল নওরোজ

পাতাদের সংসার
অনলাইন ডেস্ক

রাত থেকে পাতাদের পাড়ায় শোরগোল হচ্ছে। সে শব্দ আর্তনাদের মতো ভেসে আসছে। মারাত্মক কিছু কি ঘটেছে? খবর পৌঁছে যায় দ্রুত। কাল-সন্ধ্যার দমকা হাওয়ায় একটা পাতা ঝরে পড়েছে। এ দুর্ঘটনায় ঝরাপাতার চারপাশের পাতারা সারারাত বিলাপ করেছে। এদের আহাজারিতে দূরের পাতারাও শরিক হয়েছে। যারা রাতে জানতে পারেনি, সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। তারাও শোকে শামিল হয়েছে। পাতাদের বার্তা পাঠানোর কৌশলটা বেশ অদ্ভুত! পাতা থেকে গাছের শরীরের নির্দিষ্ট কোষে সংকেতাকারে খবর পৌঁছায়। গ্রাহক কোষ তা গ্রহণ করে অন্যান্য ডালে পাঠিয়ে দেয়। ডালেও খবর সংগ্রহের জন্যে এমন কিছু গ্রাহক কোষ থাকে। যারা সংকেত নিয়ে ডাল থেকে আবার পাতার দিকে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই পুরো শরীরে একটা সংকেত সঞ্চারিত হয়। পাতাগুলো তা বিশ্লেষণ করে বুঝে নেয় ঘটনা কী ঘটেছে।

‘পাতাটার কী হয়েছিলো?’ পাশের ডালের কনিষ্ঠ পাতার উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন।

‘কী আর হবে! দমকা বাতাস তীব্র বেগে আঘাত করেছিলো। সর্বশক্তি দিয়ে শেষ পর্যন্ত আটকে থাকার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।’ তার পাশের বয়োজ্যেষ্ঠ পাতাটি জবাব দেয়।

‘কী মর্মান্তিক পরিণতি! আমাদেরকেও কি এক দিন এভাবে ঝরে পড়তে হবে?’ কনিষ্ঠ পাতাটির সম্পূরক প্রশ্ন।

‘কার ভাগ্যে কী আছে কেউ জানে না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বয়োজ্যেষ্ঠ পাতা।

২.

ঝিরঝিরে বাতাসে দুটি পাতা কাছাকাছি আসে। তাদের ভেতর নানা বিষয়ে কথা হয়। সুখের কথা, দুঃখের কথা, ভাবের কথা, ভালোবাসার কথা। একসময় অনুভব করে একে অপরকে ছেড়ে বেশি সময় থাকতে পারছে না। এ কেমন টান? এমন আচানক অনুভূতি তাদের আগে কখনো হয়নি। এমন অধীর হয়নি কখনো। তাদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতি আজ হাসছে না। কেমন মন বেজার করে আছে! গুমোট পরিবেশে তাদেরও মন খারাপ হয়। আবার কখন একে অন্যের কাছে আসবে সে প্রতীক্ষায় থাকে। প্রকৃতি বেশি সময় নেয় না। খুব শিগগিরই গুমোটভাব কেটে গিয়ে আবার ঢিমতালে বাতাস শুরু হয়। পাতা দুটি খুব কাছে আসে। কিছুক্ষণ পর আবার দূরে সরে যায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে আক্ষেপ বাড়তে থাকে। একে অপরকে একবার ছুঁতে উতলা হয়ে ওঠে। প্রথম ছোঁয়ার শিহরণের কথা বয়স্ক পাতাদের কাছে শুনেছে। অভিজ্ঞরা জানিয়েছে, আর কদিন পরেই তারা যখন আকারে আরেকটু বড় হবে তখন সহজেই একে অপরকে ছুঁতে পারবে। একবার ছুঁতে পারলে বারবার ছোঁয়া যাবে।

‘তোমার কী মনে হয়, আর কয়দিন লাগবে আমাদের স্পর্শ পেতে?’ ওপরের পাতাটি নিচের পাতাকে জিজ্ঞেস করে।

‘খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। আরেকটু জোরে বাতাস হলে এখনই আমি তোমাকে ছুঁয়ে দিতাম।’ নিচের পাতার সলজ্জ উত্তর।

‘তুমি আমার নিচে থাকো। চাইলেও আমাকে ছুঁতে পারবে না। আমিই প্রথম তোমাকে ছুঁয়ে দেব।’ গর্বের সঙ্গে ওপরের পাতা বলে।

‘আমি নিচে বলে অবজ্ঞা করো না। বাতাস উল্টো দিকে বয়ে গেলে তোমার কথা সত্যি হবে না। সময় এলেই দেখা যাবে।’ দুষ্ট হাসি দিয়ে নিচের পাতা পাল্টা জবাব দেয়।

৩.

একটা পাতা কদিন ধরেই খুব অসুস্থ। পাতাটির শরীর ক্রমেই হলুদ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক জায়গায় ফোসকার মতো উঠেছে। অন্য পাতারা বলাবলি করছে, তার পা-ুরোগ হয়েছে। এ রোগ নাকি মানুষদেরও হয়! মানুষের কত ক্ষমতা! তারা যা ইচ্ছে করতে পারে। পৃথিবী নামক বিরাটাকার গ্রহ তাদের নিয়ন্ত্রণে। অথচ তাদেরকেও রোগব্যাধি আক্রমণ করে! কী আজব!

পা-ুরোগের চিকিৎসা পাতাদের আয়ত্তে নেই। অনেকে এ রোগে ভালো হয়, অনেকে হয় না। ধীরে ধীরে শরীর হলদে হয়। একসময় শুকিয়ে যায়। এ পাতাটির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে শঙ্কা। পূর্বের অভিজ্ঞতাও বিরূপ। আগে যাদের এ রোগ হয়েছিল তারা তাদের কষ্টের কথা স্মরণ করে সহানুভূতি-সহমর্মিতা জানাচ্ছে। কেউ আবার বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করছে। ঝুম বৃষ্টি নাকি অনেক সময় রোগ সারাতে সহায়ক হয়! বৃষ্টিধোয়া পাতা নতুন প্রাণে জেগে ওঠে। কিন্তু বৃষ্টি যদি না হয়! আপাতত তাদের করার কিছু নেই। এমন অসহায় মুহূর্ত পাতাদের জীবনে প্রায়ই আসে। দুঃখ-কষ্টে নিরুপায় হয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের যে আর কিছুই করার থাকে না!

‘আমরা পাতা হয়ে জন্মেছি বলেই এমন অসহায়। আমাদের সমাজে চিকিৎসা অপ্রতুল। ডাক্তার-বৈদ্য, ওষুধ-পথ্য মানুষের সমাজে আছে, পাতাদের সমাজে নেই।’ অসুস্থ পাতাটি আক্ষেপ করে।

‘আমি শুনেছি মানুষেরও রোগে-শোকে মৃত্যু হয়। তাদের চিকিৎসাও নাকি সব সময় যথেষ্ট হয় না! কিছু রোগ সারে, কিছু সারে না।’ সবচেয়ে জ্ঞানী পাতা সুযোগ থাকলে যে ডাক্তার হতো, সে জবাব দেয়।

‘তাই নাকি, মানুষেরও এমন হয়!’ বাকি পাতারা চরম আশ্চর্য হয়ে বলে।

‘হ্যাঁ, তাই তো জানি।’ জ্ঞানী পাতা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়।

৪.

গাছটির মালিক দুশ্চিন্তায় আছে। তার ছেলে বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। শরীর হলুদ্রাভ হয়ে গেছে। কিছু খেতে পারে না। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানিয়েছে তার পা-ুরোগ হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা করাতে হবে। ছেলের চিকিৎসার জন্যে এরই মধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। সামনে আরো টাকার প্রয়োজন হবে। মালিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাছটি বিক্রি করে ছেলের উন্নত চিকিৎসা করাবে।

কয়েক দিন বাদে এক ব্যবসায়ী এসে গাছটি কিনে নেয়। দাম ভালো পায় গাছটির মালিক। ছেলের চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এমন একটা গাছ ছিল বলে আজ রক্ষা! কী উপকারী বন্ধু! মানুষও আজকাল মানুষের প্রয়োজনে এভাবে কাজে লাগে না। প্রাণ উৎসর্গ করার কথা তো ভাবাই যায় না! গাছের জন্যে তার মায়া হয়। তবে গাছের জীবন নিয়ে ভাবনা হয় না। ছেলের চিকিৎসা সবকিছুর আগে।

বিক্রির পরদিনই আধুনিক যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে কয়েকজন মানুষ হাজির হয়। তারা বিলম্ব না করে গাছটির ওপর সেসব ধারালো অস্ত্র চালায়। ক্রমেই গাছটি দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় সব প্রতিরোধ শেষ হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সশব্দে গাছটি পাতাদের নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হলুদে পাতাটি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। তার জীবনের বিনিময়ে হলেও সে মানুষের জীবনের প্রয়োজনে লাগতে পেরেছে বলে গর্ব করে। তাদের মধ্যকার বেয়াড়া পাতাটা মুখ ফসকে বলে দেয়, আমরা কখনো মানুষের কাছে সাহায্য চাইনি, অথচ মানুষ ঠিকই দুঃসময়ে আমাদের শরণাপন্ন হয়েছে বিধায় সব পাতাদের গর্ব করা উচিত! কেউ জবাব দেয় না। পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত পাতাটি মিটিমিটি হাসে। এটাই তার শেষ হাসি, জীবনের সবচেয়ে আনন্দের হাসিও।

একে অপরকে কখনো ছুঁতে না পারা পাতা দুটির ইচ্ছেও শেষ অবধি পূরণ হয়ে যায়। প্রকৃতি নিজের মতো করে অনেক কিছু মিলিয়ে দেয়। পাতা দুটির ক্ষেত্রেও তাই হয়। গাছটি যখন তাদের নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, ঠিক সেসময় তারা একে অপরের স্পর্শ পায়। শিহরিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও অবশিষ্ট অনুভূতি থেকে এর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। পরস্পরকে ছুঁয়ে দেয়ার আনন্দ নিয়ে তারা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। তবে কে কাকে আগে ছুঁয়েছে তা কেউ জানতে পারে না। জানার দরকারও পড়ে না। পরম আরাধ্য এ স্পর্শটাও যে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোনো ইশারা দ্বারাই হয়েছে! শেষ পরিণতিতে কিঞ্চিৎ আনন্দ ছোঁয়ার ভাগ্য সব পাতার হয় না, তাদের হয়েছে। তারা ভাগ্যবান। পাতাদের জন্যে এটাও কম বড় প্রাপ্তি নয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়