রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

হেরে যাওয়া প্রেমিক
অনলাইন ডেস্ক

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চোখ এতোটা ভয়ংকর হতে পারে মাইশার জানা ছিলো না। ছাত্রী হিসেবে সে মাঝারি মানের। টেনেটুনে পাস করে এতোটা পথ এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ‘অতি আশ্চর্য’ বিষয়টি বাদ দিলে পড়াশোনা নিয়ে তার তেমন সুখস্মৃতি নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল দেখে বাসার সবাই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো, আর যাই হোক এ মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। সে নিজেও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে গান শোনা এবং গল্পের বই পড়াতে মন দিয়েছিলো। বান্ধবীদের জোরাজুরিতে কয়েকটা ফরম পূরণ করেছিলো বটে, কিন্তু শেষমেশ পরীক্ষা দিতে যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিলো। বীথি মেয়েটা ওমন নাছোড় না হলে হয়তো এতো কিছু ঘটত না তার জীবনে। ‘আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে হলেও যেতে হবে’-বীথির এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরেই মূলত ওদের সঙ্গী হয়েছিলো মাইশা। একটা ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলো। সেখানেই যতি টেনে, এদিন-সেদিক ঘুরে বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসেছিলো।

সেদিন দুপুরে সমরেশ মজুমদারের একটা বই নিয়ে বসেছিলো। কয়েক পৃষ্ঠা পড়তেই কাহিনির ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো। ওদিকে যে মুঠোফোন বেজেই চলেছে, সে খেয়াল নেই। টানা চল্লিশ মিনিট বইয়ের মধ্যে বুঁদ থাকার পর যখন মুঠোফোন হাতে নেয় তাতে সাতটা মিসড কল লেখা দেখাচ্ছে। সব বীথির নম্বর থেকে। ভর্তি পরীক্ষার পর বীথির সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিলো। নিয়তি হয়তো এটা চায়নি। তাই বীথির সঙ্গে একই ইউনিটে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। তার নিজেরও ঘটনাটা বিশ্বাস করতে সময় লেগেছে। বাসার কাউকে না জানিয়ে অযত্নে-অবহেলায় ফেলে রাখা প্রবেশপত্র নিয়ে তখনই বীথির কাছে ছুটে যায়। একবার-দুবার নয়, বিভিন্ন পত্রিকা ঘেঁটে ফলাফল বের করে অনেকবার মেলানোর পর যখন নিশ্চিত হয়, এটি তারই রোল নম্বর তখন বীথিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না শুরু করে। দিনের আলো সরে পড়ার পর পত্রিকাগুলো নিয়ে বীথি আর সে যখন বাড়িতে হাজির হয়, বাবা তখন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছে। বীথিকে নিজের ঘরে পাঠিয়ে সে নিঃশব্দে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবা চোখ না তুলেই কথা শুরু করেন।

‘কীরে মা, কিছু বলবি নাকি?’

‘এতো মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছো বাবা?’

‘কী আর পড়বো বলো, পত্রিকায় ভালো কোনো খবর থাকলে তো! দেশটা নিয়ে মাঝেমধ্যে বড় চিন্তা হয়। আমরা আসলে কোন্ দিকে যাচ্ছি ঠিক বুঝতে পারি না।’

‘আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা হয় না বাবা?’

‘কমবেশি চিন্তা তো হয়-ই।’

‘বাবা, আজকের পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটা খবর আছে, যা হয়তো তোমার চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দেবে। হাজারটা খারাপ খবর ভুলে ওইটাই বারবার দেখবে।’

‘কী শুরু করলি, খুলে বল তো কোন খবরটা!’

‘খবর বললে ভুল হবে, কেবল একটা সংখ্যা।’

‘আমাকে কি তোর নাটক-উপন্যাসের কোনো চরিত্র মনে হচ্ছে। এমন লুকোচুরি করছিস কেন? তাড়াতাড়ি বলে ফেল।’

‘এগারো পৃষ্ঠায় যাও।’

‘আচ্ছা যাচ্ছি, তারপর?’

‘ওখানে একটা বিজ্ঞপ্তি আছে।’

‘বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমি কী করবো?’

‘আহা যাও তো!’

‘এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফল! তার মানে...’

আর কোনো কথা না বলে মাইশাকে জড়িয়ে ধরে তার বাবা। ভালো খবরের খোঁজে চাতক হয়ে ওঠা চোখ দুটিতে তখন আনন্দ বয়ে বেড়ানো অশ্রুর সমারোহ। কী আশ্চর্য, মাইশাও খবরটা দেখে বীথিকে জড়িয়ে ঠিক এভাবেই কেঁদেছিল!

ক্যাম্পাসের পরিবেশ অনেককে অনেকভাবে বদলে দেয়। মাইশা নিজের ভেতর কোনো পরিবর্তন টের পায় না। পাঠ্যবইয়ের পাতা তাকে কখনোই সেভাবে টানেনি। এখন তো আরো টানে না। এ নিয়ে বাসার কারো মাথাব্যথা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পাস না করে বেরোবে না, আর সবার মতো তার বাবা-মায়েরও একই ধারণা। পাঠ্যবই না টানলেও একজোড়া চোখের আকর্ষণ মাইশা অস্বীকার করতে পারে না। সে চোখে সর্বনাশের ভাষা স্পষ্ট দেখতে পায়। মুক্ত আকাশে ওড়ে চলা শঙ্খচিলের মতো মনের অলিতেগলিতে বলতে না পারা কথাগুলো ওড়ে বেড়ায়। ছেলেটার মতো নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতেও পারে না। চোখে চোখ পড়লেই সরিয়ে নেয়। একবার সামনে দাঁড়ালে ছেলেটি কি আর এভাবে তাকাবে না, নাকি মাইশাও ওর মতোই ‘অপলক তাকিয়ে থাকা’ ব্যাধিতে সংক্রমিত হবে-তা জানতেই সাহস করে এক দিন রাশিকের মুখোমুখি হয়।

‘কারো দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কি ঠিক?’

রাশিকের ভাবান্তর হয় না। শুধু সর্বগ্রাসী দৃষ্টিতে মাইশাকে দেখে। মাইশা তাতে পুড়ে যায়। দূর থেকেই যে দৃষ্টির উত্তাপ অনুভব করা যায় কাছে এলে তা এতো তীব্র হবে-এটাই স্বাভাবিক।

‘এভাবে চুপ হয়ে থাকা কত বড় অভদ্রতা সেটা কি জানেন?’

কোনো কথা বলে না রাশিক। কেবল ওপর-নিচে কয়েকবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। মাইশার অস্বস্তি তাতে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নীরব থাকা মানুষগুলোকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

মাইশার দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকে ঘিরেই এখন সবার আগ্রহ। অথচ শুরুতে আঞ্চলিকতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে কী সংগ্রামই না করতে হয়েছে তাকে! আড়ালে-আবড়ালে রাশিককে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ কম হয়নি! ওই অন্তর্ভেদী দৃষ্টির কারণেই বোধহয় ওর প্রতি মায়া হয় মাইশার। সে যতটুকু পেরেছে তার পাশে থেকেছে। প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফল করে অন্যদের দৃষ্টি তার দিকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে রাশিক। এখন অনেকেই ওকে পাশে পেতে চায়। পরিস্থিতি বদলে গেলেও একটা বিষয় আগের মতোই আছে। মাইশার দিকে এখনো প্রথম দিনের মতোই চেয়ে থাকে সে। তবে এখনকার তাকানো একপক্ষীয় হয় না। দৃষ্টি দিয়ে কথা বলার বিষয়টা রাশিকের কাছ থেকে ভালোভাবেই শিখে নিয়েছে মাইশা। এতে দুটো লাভ হয়েছে। আগের মতো পাঠ্যবইয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বিরক্ত লাগে না। যার প্রভাব ফলাফলেও কিছুটা পড়েছে। অন্যদিকে রাশিককে তার দৃষ্টিতে বন্দি করে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সহায়তা করতে পারছে।

ভালো ছাত্র হওয়ার এক পিঠ দেখে অভ্যস্ত রাশিক অন্য পিঠটাও দেখতে শুরু করেছে। যে পিঠে রয়েছে নানা প্ররোচনা আর প্রলোভন। সবই তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য। কমবেশি ক্যাম্পাসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠনই নিজেদের দলে দেখতে চায় তাকে। মেধাবীরা দলে থাকলে অনেক সুবিধা। একবার তার ওপর নিজেদের দলের সিল সেঁটে দিতে পারলেই হয়। বাকি জীবন অনুগত হয়ে নতজানুভাবে চলতে হবে। নিজেদের কাজেও ব্যবহার করা যাবে যখন-তখন। রাশিক বিষয়টি অনুধাবন করে। তার এসব ভালো লাগে না। জোর-জবরদস্তি দিয়ে মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে কেন? ভালোর দিকে এমনিতেই সবাই ছুটে যাবে, পাশে থাকবে। ভালোর সংজ্ঞা হয়তো একেকজনের কাছে একেক রকম। তা না হলে তার অনুষদের অনেক শিক্ষকও কেন ওদের অনুগত হয়ে থাকবে? অন্যায় দাবি-দাওয়াতে সম্মতি জানিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলবে, রাস্তায় নামবে!

কয়েক দিন যাবৎ একটা বিষয় লক্ষ করছে মাইশা। তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে রাশিক। তার দিকে সেভাবে আর তাকাচ্ছে না। চোখে চোখ পড়লেও দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে। কথাও বলছে না তেমন। ফোন রিসিভ করলেও ব্যস্ততার অজুহাতে রেখে দিচ্ছে। দেখা হলে কাজের দোহাই দিয়ে সরে পড়ছে। হঠাৎ কী এমন হলো যার জন্য এভাবে বদলে যাবে রাশিক! আগে কখনো এতটা নিষ্প্রভ দেখেনি তাকে। সে কি এমন কিছু করেছে, যাতে কষ্ট পেয়ে দূরে সরে যাবে! হিসাব মেলাতে পারে না। যত সময় গড়াচ্ছে রাতগুলোকে দীর্ঘ মনে হচ্ছে। দীর্ঘ সে রাত নির্ঘুমতার যন্ত্রণা দিয়ে মাইশাকে পোড়াচ্ছে। বদলে যাওয়ার এ অধ্যায় কখনোই প্রার্থিত ছিল না তার।

ছুটির দিন। সারা রাত জেগে থাকার পর ভোরবেলায় ঝিমুনি আসতেই মাইশার ফোন বেজে ওঠে। রাশিকের মেসেজ! বিকেলে দেখা করবে বলে জানিয়েছে। মাইশার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। দুপুরের পর থেকেই সাজতে বসে। গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে টিপ লাগিয়েছে। চুড়ি আর জুতাতেও নীলের ছাপ আছে। নীল-সাদা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয় মাইশা। আজকের আকাশকে ঠিক শরতের আকাশ মনে হচ্ছে না। নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানোর কথা। অথচ ধূসর আকাশে ছোপ ছোপ ছাইরঙা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাসও বইছে না তেমন। রাশিক তাকে নিয়ে নদীর ধারে গিয়ে বসে। শুভ্র কাশফুলের সারি পেছনে রেখে একটু আড়াল হয়ে। যেন কেউ দেখলেই বিপদ! মাইশার ভালো লাগে না ব্যাপারটা।

‘এতোটা আড়ালে বসেছ, মনে হচ্ছে আমরা পালিয়ে দেখা করতে এসেছি!’

একটু সময় নেয় রাশিক। আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা কথাগুলো বললেই শুধু হবে না, মাইশাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে।

‘আমাদের সম্পর্কটা আর টেনে নেওয়া যাবে না। এখানেই থেমে যেতে হবে।’

‘এ কথা কেন বলছো? কী হলো হঠাৎ?’

‘কোনো ব্যাখ্যা দেবো না, তবে এটাই আমাদের জন্য ভালো হবে।’

‘তুমি আমার কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছ। আমি সব শুনব।’

রাশিকের মুখ মলিন আকাশের চেয়েও বেশি ফ্যাঁকাসে। হাতে ধরা পত্রিকাটা মাইশার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

‘এই খবরটা পড়।’

মাইশা শিরোনামে চোখ বুলিয়েই রেখে দেয়। সম্ভ্রম হারানো তরুণীর আত্মহত্যার খবর।

‘প্রতিদিনই এমন সংবাদ ছাপা হয়। এর সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?’

‘বেশ কয়েক দিন থেকেই আমি একটা ছায়া দেখছি। ছায়াটার অনেক ক্ষমতা। যার একটা রূপ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বাকিগুলো হয়তো আড়ালেই থেকে যাবে। ছায়াটা আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে বাগে আনতে না পেরে দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করছে। সুযোগ পেলেই সেখানে আঘাত করবে। অনেক ভেবে দেখলাম তুমি ছাড়া এখানে আমার তেমন আর কেউ নেই। আমার কারণে তোমার সামান্য ক্ষতিও মেনে নিতে পারব না।’

‘তাই বলে এভাবে পরাজয় মেনে নেবে?’

‘এটা বিজয়ী হওয়ার সময় নয়। বাস্তবতাটাই এমন। এ সময় প্রেমিককে সাহসী হতে দেয় না। প্রেমিকাকে আবেগের বদলে হিসাবি হতে বলে। না হলে পরিণাম হয় ভয়াবহ।’

‘তারপরও...।’

‘এবার না হয় আমি ছায়ার কাছে হেরে দূরে সরে যাই! নিয়তি চাইলে আবার ফিরে আসব।’

মাইশা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। থেমে থাকা প্রকৃতি একটু নড়েচড়ে ওঠে। মৃদু বাতাস বইতে শুরু করেছে। তাতে মেঘগুলো অলস ভঙ্গিতে সরে যাচ্ছে। কাশফুলগুলো দুলে দুলে উঠছে। একে অন্যকে ছুঁয়ে দেখার অবাধ অধিকার প্রকৃতি কাশফুলকে দিয়েছে, সামনে বসে থাকা দুজন মানুষকে দেয়নি।

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়