মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

জান্নাত বোরকা বাজার

আয়েশা সিদ্দিকা

বর্ষাকাল এখনো শুরু হয়নি। জৈষ্ঠ্যের শেষ সপ্তাহ। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়েছে আরো মাস দেড়েক আগে থেকেই। কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দুপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তাও সবুজ মাঝখানটা বাদে। মাঝখানে মানুষ হাঁটে তাই ঘাসগুলো আপন গতিতে বেড়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত হয়। গ্রামে বৃষ্টি হবে তার একমাত্র পূর্বাভাস হলো বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। বৃষ্টির আগের আকাশের কালো রঙ, দমকা হাওয়া, কখনো বিজলি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। ঘনঘটা বর্ষায় একদিন আবিদা জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছিলো। এক হাত জানালার বাইরে দিয়ে বৃষ্টির শীতল ছোঁয়া অনুভব করছিলো। বয়স্ক একজন লোক এসে জানালা দিয়ে তাকে ডাকলো। তার নাম জিল্লুর রহমান। আবিদাদের প্রতিবেশী।

-আবিদা, তোর মায় কই ভাই?

তার সাথে আবিদার অন্যরকম একটা সম্পর্ক। জিল্লুর রহমান ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মভীরু হলেও কুরআন, হাদিসের গ্রন্থ কোনোটাই পড়তে পারেন না। পড়াশোনা একদমই জানেন না। কিন্তু নিয়মিত মসজিদ আর তাবলীগে যাওয়ার দরুণ তার মোটামুটি ভালোই ধর্মীয় জ্ঞান আছে। সে চাইতো তার স্ত্রী, ছেলের বউ-এর মধ্যে কিছুটা হলেও ধর্মীয় জ্ঞান থাকুক। ওই দুজন মহিলাও পড়াশোনা জানে না। আসলে আবিদাদের গ্রামটাই একটা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া গ্রাম। মেয়ে সিক্সে উঠতেই বিয়ে। তো সে বৃদ্ধ একসময় প্রায় প্রতিদিনই আবিদার মা-কে বলতো, আবিদাকে যেন তাদের একটু সময় দেয়। সে তাবলীগ থেকে অথবা অন্য জায়গা থেকেও হতে পারে কিছু হাদিসের বই নিয়ে এসেছে, সেগুলো যেন তার ঘরে অথবা আবিদাদের ঘরে হলেও সমস্যা নেই, পড়ে পড়ে তার স্ত্রী আর ছেলের বউকে শোনানো হয়। চাইলে আশপাশের অন্য কোনো মহিলা মানুষও সেখানে যোগদান করতে পারে। বিনিময়ে সে নাস্তা করাবে সবাইকে। প্রথমে আবিদা ব্যাপারটা শুনে কিছুটা ঠাট্টা করলেও আবিদার মা তাকে বুঝিয়ে বলেছে,

-এটা করলে তোমারও সওয়াব হবে। বেচারা বই পড়তে পারেন না জন্যই তো আসছে। সময় পেলে তাদের ঘরে গিয়ে, না হলে তাদেরকে এই ঘরে ডেকে দু-চার পৃষ্ঠা বই পড়ে বুঝিয়ে দিলে ক্ষতি কী!

নাইন-টেনে পড়ার সময় থেকেই আবিদা ভালো লাগলে মাসে চার-পাঁচ দিন হাদিসের গ্রন্থ পড়ে শোনাত তাদেরকে। এতে জিল্লুর রহমান তার প্রতি খুব খুশি। প্রায়ই বাজার থেকে ফেরার সময় সিঙ্গারা, সমুচা নিয়ে আসত। একদিন তো তার বড় ছেলের বাড়ি থেকে কমলা নিয়ে আসছে গামছার কোণায় বেঁধে। আবিদাকে কমলা দিতে পেরে সে কী খুশি!

-নে ভাই, তোর জন্য আনছি। (গামছার গিঁট খুলতে খুলতে বললো)

-কী এগুলা? (সবুজ রঙের হওয়ায় আবিদা বুঝতে পারছিলো না এগুলো ঠিক কী ফল)

-কমলা।

-কই পাইলা?

-জাকিরের বাড়িত গাছ আছে তো। ওই গাছের এগুলা। এহনো পাকে নায় ঠিক মতন।

-আল্লাহ! কত দূর থেইকা আনছো। তুমি এগুলা নিয়া যাও। আমারে দেয়া লাগবো না।

-চুয়া (টক) খাইতে পারি না রে ভাই, এহন কী আর সেই বয়স আছে!

-না পারলেও নেও। আমি নিতে পারবো না এগুলা।

-খাওয়া হইবো না ভাই, পইচা যাইবো। তোরা জোয়ান মানুষ। খাইতে পারবি। তুই নে ভাই।

জিল্লুর রহমানের জোড়াজুড়ির সাথে আবিদা আর পেরে উঠছিলো না।

আরেকদিন তো তাদের ঘরে ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছিলো। গরম গরম পিঠা এনে আবিদাকে লুকিয়ে দিয়ে গেল বুড়ো। আশপাশের বাড়িতে তার নিজের দূর্সম্পর্কের অনেক নাতি-নাতনি আছে। কেউ তার নিজের ভাইদের নাতি-নাতনি, কেউ-বা নিজের চাচাতো ভাইয়ের নাতি-নাতনি। সম্পর্কে জিল্লুর রহমানের কেউই হয় না আবিদা। কিন্তু এভাবে আবিদাকে ভালোবাসে যেন আবিদাই তার একমাত্র নাতনি। হতে পারে আবিদা লেখাপড়া জানে সেজন্য। আর টাকা-পয়সার হিসাব-নিকেশ, আবিদাই জিল্লুর রহমানের একমাত্র ভরসা। এমন হয়ে গেছে যে আবিদাকে কিছু একটা দিতে পারলে তার খুব আনন্দ লাগে। তাদের এ সখ্যতার ফলস্বরূপ কবে থেকেই যেন তাকে তুমি করে ডাকতে শুরু করেছে আবিদা, সেটা সে নিজেও জানে না।

-তুমি ঘরে আসো। আম্মু একটু ঘুমাইছে এই মাত্রই। তোমার কী লাগবো আমারে কও। আমি দিই।

-তোরে দিয়া হইবো না ভাই। তোর মারে ডাক দে।

-কী হইছে! ঘরে আসো আগে। বৃষ্টিতে ভিজতেছো।

এবার বৃদ্ধ ঘরে আসলো।

-ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামতেছো কেনো?

-জামালের বউর পোলাইন হইবো তো জানোস। বউর বেশি অসুখ। কেমন জানি করতাছে। আমি এহন বৃষ্টির মধ্যে ডাক্তার কই পামু ভাই। তোর মা রে আইতে ক একটু।

-আচ্ছা দাঁড়াও একটু, ডাইকা দিতেছি। কিন্তু তোমার ছেলে কই?

-অয় তো গাড়ি লইয়া বাইরাইছে। (সে একজন ট্রাক ড্রাইভার)

জামাল জিল্লুর রহমানের তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে। বছর দুয়েক হলো সে বিয়ে করেছে। তার বউয়ের প্রথম বাচ্চা হবে। আবিদা তার মাকে পাঠিয়েছে তখনি।

কিছুক্ষণ পর জিল্লুর রহমান আবার ফিরে এসেছে,

-ভাই তোর মার মোবাইলডা দিতে কইছে।

-দাঁড়াও দিতেছি। কিন্তু ওখানে মোবাইল দিয়া কী করবো?

-হাশেম ডাক্তারের বউরে ফোন দিবো কইব। অবস্থা বেশি ভালো না।

-আচ্ছা, নাও ফোন।

হাশেম ডাক্তারের বউ হচ্ছেন একজন গাইনি ডাক্তার। তার আসল নাম কেউই জানে না। অথবা জানার চেষ্টাও করে না। আবিদাদের গ্রামসহ আশপাশের আরোও প্রায় চার-পাঁচ গ্রামে সন্তানসম্ভবা নারীদের একমাত্র ভরসা এই ডাক্তার। ভদ্র মহিলা ফোন পেলেই সরঞ্জাম নিয়ে রোগীর বাড়ি ছুটে আসেন।

আবিদার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এসব পরিবেশে ছোটরা যেতে পারে না। এটাই আবিদার মা তাকে বুঝিয়েছে। যদিও আবিদা ক্লাস সিক্স অথবা সেভেনে পড়াকালীন সময় তার ছোট ভাই হওয়ার দিন প্রথম থেকে শেষ অবধি তার মায়ের পাশেই বসে ছিল। বসে শুধু ভ্যা ভ্যা করে কান্না করেছে। প্রসব যন্ত্রণায় আবিদার মায়ের কাতরতা তিনি সহ্য করতে পারলেও আবিদার কোমল মন তা সহ্য করতে পারেনি। আর আবিদার ফুপি, বেচারি তার ভাবিকে সামলাবে নাকি ভাতিজীকে! সবাই এতো বোঝাল সব ঠিক হয়ে যাবে, কে শোনে কার কথা। আবিদার মা-কে ব্যথায় এত কষ্ট পেতে দেখে আবিদার বারবার মনে হচ্ছিলো তার মা মারা যাবে।

কিছুক্ষণ পরে জিল্লুর রহমান আবার আবিদাদের ঘরে আসেন। তার কোনো মোবাইল নেই। প্রায়ই সে আবিদার ফোন থেকে যে কারোর সাথে কথা বলে। তার নম্বর রাখার আলাদা জায়গা আছে। সেখানে অনেকের নম্বর আর নাম লেখা। এর মধ্যে সুপারির ব্যাপারি কবির, মুদি দোকানদার লাল মিয়া, মুখলেস হুজুর প্রমুখ। সব ফোনেই আবিদার ফোন থেকে কল যায়। একটা ব্যাপার ভালো, ওসব জায়গা থেকে কল দেয়া ছাড়া কখনো কল আসে না। তাই আবিদা জিল্লুর রহমানকে না করে না কখনো।

-তোর মোবাইলে টাকা আছে ভাই?

-হ্যাঁ আছে, কারে কল দিবা?

-জামাল রে। হাশেম ডাক্তারের বউরে কল করছে তোর মা। আসতাছে কইলো। হেয় আসলে হেরে টাকা দেয়োন লাগবো না!

-হ লাগবো তো।

-আমার কাছে টাকা নাই তো। জামালরে কল দিয়া টাকা পাঠাইতে কইতাম।

-নম্বর আনছো?

-হ ভাই। খারা দিতাছি। (এই বলে কোমরে লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা একটা কাগজের টুকরা বের করে দিল)

আবিদা সেই কাগজ থেকে নম্বর দেখে জামাল সাহেবকে ফোন দিয়ে জিল্লুর রহমানের হাতে ধরিয়ে দিলো। বাবা-ছেলের কথা শেষ হলে জিল্লুর রহমান ঘরে ফিরে যায়। আবিদার বৃষ্টি দেখা তখনো চলমান। যদিও বৃষ্টি একটু কমে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কমে যাবে। আকাশের মেঘ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আবিদা বাইরের দিকে তাকিয়ে আবার অপেক্ষাও করছে। কখন ওই ঘর থেকে বাবু হওয়ার খবর আসবে। তাহলে সে সেই বাচ্চা দেখতে যাবে। সদ্য হওয়া বাচ্চা দেখতে কী নিষ্পাপ, সুন্দর, সাদা ধবধবে! এর আগে চারটা মতো সদ্য হওয়া বাচ্চা দেখার সুযোগ হয়েছে আবিদার। দাঁড়িয়ে থেকে ওই ঘরটার দিকেই তাকিয়ে আছে আবিদা। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলো দুইজন মহিলাকে জিল্লুর রহমান বাড়ির লম্বা মাটির রাস্তাটা দিয়ে নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে একজন সাদা অ্যাপ্রোন পরা। আবিদার বুঝতে বাকি রইলো না, এটাই হয়ত হাশেম ডাক্তারের বউ। ডাক্তার এসে পড়েছে সুখবর আসতে আর বেশি দেরি নেই। তার ও প্রায় আধাঘণ্টা পরে জিল্লুর রহমানকে দেখা যাচ্ছে মুখভরা হাসি নিয়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আবিদাদের ঘরের দিকেই আসছে। উঠানের মাঝখান থেকেই বলতে শুরু করেছে,

-ভাই আমার নাতিন হইছে, নাতিন হইছে।

-আলহামদুলিল্লাহ। আমি আসি তোমগো ঘরে?

-একটু পরে আয় ভাই। ডাক্তার যায় নায় এখনো।

-আচ্ছা, তুমি টাকা তুলতে তো পারো নায় এই বৃষ্টির মধ্যে। ডাক্তাররে টাকা দিবা কে¤েœ?

-বাজারের একজনরে কইছে জামাল। অয় টাকা লয়া আওয়ার কতা, এহনো তো আইলো না।

-আচ্ছা। টাকা নিয়ে না আসলে, আম্মুর কাছে জিগাও, টাকা থাকলে আম্মুর থেকে নিয়ে দিয়ে ডাক্তার বিদায় করো। ডাক্তার গেলে আমারে ডাইকো।

-আচ্ছা।

কিছুক্ষণ পরে বাজার থেকে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়স হবে, একটা লোক আসলো। সম্ভবত টাকা নিয়ে আসছে। এবার ডাক্তার বিদায় হবে। আবিদার বাচ্চা দেখতে যাওয়া ও হবে। এই ভেবেই কত খুশি লাগছে আবিদার! সেইমতো কিছুক্ষণ পরে জিল্লুর রহমান এসে আবিদাকে ডেকে নিয়ে গেল। বাচ্চার দাদি একটা ছোট কাঁথা পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে আবিদার কোলে দিয়ে বললো,

-সাবধানে ধরিস ভাই।

-আচ্ছা। মেয়ের বাবারে মিষ্টি নিয়া আইতে কন। সবাইরে মিষ্টি খাওয়াইবেন। প্রথম বাচ্চা মেয়ে হওয়া কত বরকতের!

-হ ভাই কমু।

(চলবে, পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়