প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আমি মূলত কবিতা লিখি না। কবিতা নিজেই আমার কাছে ধরা দেয় কখনো কখনো। ছায়াসঙ্গীর মতো হাত ধরে হাঁটে অথবা বাধ্য প্রেমিকার মতো পাশে এসে বসে। কেনো কবিতা লিখি কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছুটা বিব্রত হয়ে যাই যেমনটা কোনো পুরুষকে যদি তার বেতনের পরিমাণ জিজ্ঞেস করা হয় ঠিক তেমন! সুতরাং কখনো কখনো আমি কবিতায় বসবাস করি, কবিতার সাথে সংসার করি আবার কখনোবা তুমুল দ্বন্দ্বে কবিতার সাথে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। হর্ষ-বিষাদের যুগলবন্দি পদচারণে কবিতা তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। তাই আমি কবিতায় বাঁচি আবার কবিতায় মরি। অলীক স্বপ্নের ঘ্রাণহীন স্পর্শ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি কবিতার সাথেই হাঁটতে থাকি।
সিংহ স্বপ্নের বৃত্তান্ত
ছিপ বড়শি নিয়ে বসে আছি মাছের আশায়
উদ্যম ভরা একটা সকাল,
সকাল গড়িয়ে দুপুর
দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
মাছের দেখা তবু মিলে না
নিরালায় নিরাশায় অপেক্ষা বাড়ে।
বিকেল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে
আমিও ছিপ ছাড়ি না
অথচ একটু পরই একটা ভরা সন্ধ্যা গ্রাস করবে আমায়।
এখন যে অন্ধকারের সুর বাজছে
সন্ধ্যা গড়িয়ে গাঢ় অন্ধকার ধেয়ে আসছে!
এখন শুধুই বেলা শেষের স্রোত
ভরা সন্ধার হাহাকার ধ্বনির ঘণ্টা বাজছে
সান্ধ্য স্তুতির ঘন্টায় মুখর সব মন্দির।
হয়তো শেষবেলার ছিপে ধরা দেবে
হয়তো ধরা দিবেই শেষ পর্যন্ত!
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্পের বুড়োর মতো
আমিও মাছের কঙ্কাল নিয়ে ফিরবো।
অথচ আমার ও সিংহের স্বপ্ন শেষ হয় না
ফেরা হয় না, আমার ফেরা হয় না তবুও!
নিশ্চুপ স্রোত
আকাশের বিস্তৃত উঠোন;
অজস্র তারার ভিড়েও চাঁদের একাকিত্ব কাটে না
সহস্র কোটি বছর ছায়াপথ হেঁটে
নক্ষত্ররাও মরে যায় একা।
সূর্যের প্রতিবেশী বলে একাই ভস্ম হয়
অতন্দ্র সর্বসংহা অবিচল বুধ,
অথচ নিরুত্তাপ এ গ্রহের বুকে
আজন্ম উত্তাপ ছড়াই নির্বোধ!
নিশ্চুপ স্রোতের কলতান ভাঙে না মগ্নতা।
নীরব আততায়ী সময়ের ছলনায়
আমাদের উৎসব,
সুক্ষ্ম ভ্রান্তিতে ডুবে থাকে এক মোহময় জীবন
মহাকালের সমুদ্রে একা ভেসে চলা
তবু একা না থাকার সুনিপুণ অভিনয়!
ঐশ্বর্য পূজারিণী
এরপর কোনো এক বিকেলে;
অস্তমিত সূর্যের ঘ্রান বুকে নিয়ে
চোখ বুজেছিলে, কিছু খুঁজেছিলে
বিড় বিড় করে আওড়ালে এক মন্ত্র!
অধিবিদ্যক কোনো স্বপ্নের কথন
কাকডাকা সন্ধ্যা ছেদ করেনি ধ্যানের লগন।
নিয়তির মতো বিশ্বাসঘাতক সময়ের লাগাম
ধরতে চাইনি ব্যর্থ আপ্রাণ।
তবু সেই চোখ বুঁজেছিলে
কিছু খুঁজেছিলে
খুঁজে পাওনি আমায়
ধ্যানমগ্ন বিলাসী স্বপ্নে তোমার!
যে চোখ স্বপ্ন জাল বুনে না
আটকা পড়ে ঐশ্বর্যের জালে।
যে চোখ সমুদ্র ধরে না
স্রোতহীন শৈবালের আধার!
ধ্যান ভেঙে যে চোখ দেখে না
অব্যর্থ নিশ্চুপ চিৎকার!
চোখ মেলে ধ্যান ভাঙো ঐশ্বর্য পূজারিণী
বেলা শেষের সূর্য যে অস্তমিত প্রায়
তবুও কি মোহ ভাঙেনি!
তোমার নীলাভ রক্ত এখন লাল হয়েছে
আমি জানি, তুমি বোঝনি অথবা বুঝতে চাওনি,
আমার না থাকার নাম যে ভালোবাসা
তুমি জেনেছো আমি জানি,
তবু জানতে দাওনি!
নিভৃতচারী ও ভিসুভিয়াস
হাজার মানুষের পায়ের শব্দে
যখন পথগুলো কম্পিত হয়,
মানুষের হাসি-কান্নার শব্দে
লোকালয় মুখরিত হয়
ঠিক তখনো তুমি থাকো একা নিশ্চুপ!
স্তব্ধতার দেহে তোমার আজন্ম বসবাস।
নীরবতার সুবাসে তোমার বিলীন খণ্ডাংশ
খুঁজে খুঁজে বৃথাই এক করার চেষ্টায় কেউ ক্লান্ত হয়তো!
নীলাভ আকাশের উঠোনে শুভ্র মেঘ যখন খেলা করে
কেউ একজন উপমা খোঁজে মেঘের ভাঁজে,
ঠিক তখনো তোমার শুভ্র আঁচল ছেয়ে দেয় আকাশ!
সবুজ থেকে গাঢ় সবুজের অরণ্য কিংবা পাহাড়ে
যেখানে মিশেছে সব প্রণয়ের রঙ
যেখানে ঢল নামে স্বচ্ছ প্রপাতে
ঠিক সেখানেও তুমি থাকো সবুজ শৈবালের মতো!
অনেকটা পথ বেয়ে আসা নদী কিংবা ঝর্ণার স্রোত
অনেকটা ঝড়ো বাতাসে ভিজে যাওয়া পাখির শরীর
কুয়াশায় ভেজা দুর্বা ঘাস কিংবা বুনো লতাটাও
গা এলিয়ে দেয় সূর্যের উত্তাপে,
ঠিক তখনো নিরুত্তাপ তুমি, নির্বিকার তুমি, শীতল তুমি!
একটা বিস্ময় চিহ্ন হয়ে সামনে দাঁড়ায় তোমার অবয়ব
একটা আবিষ্কারের নেশা ও চেপে বসে,
অথচ ধুসর থেকে ধুসরে তুমি মিলিয়ে যাও
অমীমাংসিত এক রহস্যের দরজা খুলে রেখে।
ভিতরে সুপ্ত ভিসুভিয়াস লালন করো আজীবন!