প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
সুপার সপের এই দোকানে কাজ পেয়েছি প্রায় বছর দেড়েক হয়েছে। যেখানে গ্রামে দুবেলা খাওয়া জোগাড় করা দূরহ ছিল। আজ আমি মাকে নিয়ে ভালোই আছি। সেদিন নিজের প্রেমিকার বাবার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী না হয়ে গ্রাম ছেড়ে ভালোই করেছি। এখানে প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ফ্রিতে পাওয়া যায়। এমন ভিআইপি জায়গায় শাখা খোলার আগেই মালিক কথা দিয়েছে বাসি কিছু তিনি দোকানে রাখবেন না, বিক্রি করবেন না। তাই প্রতিদিন রাত এগারটায় যাবার সময় কিছু না কিছু ভাগ্যে ঠিক জোটে যায়। তাই দিয়েই আমাদের মা ছেলের পরের দিন চলে ভালোই।
সকালে মা রান্না করে খাইয়ে দেয় আর দুপুরের খাবারটা বক্সে করে নিয়ে আসি। ভাঙ্গা ডিম, একটু নরম মাছও পাই। এমন বাসি খাবার আমাদের হজম হয় সহজেই। তাই নিরামিষ আমিষ সব চাহিদা পূর্ণ হয়। এখানে যারা আসে সবাই আশপাশের, প্রায় দেড় দুই হাজার পরিবারের জন্যে দুটা সুপার সপ কমই হবার কথা। কিছু মানুষ ঠেকায় পড়ে এখান থেকে নেয়, কিছু মানুষ বাধ্য হয়েই। দেড় বছরে এখানকার অনেককেই চেনা হয়ে গেছে। কোন সাহেব কখন আসেন আর কোন ম্যাডাম কখন তাও মুখস্ত আমার।
রাত আনুমানিক নয়টা সোয়া নয়টার দিকে আসে ইকবাল স্যার আর রঞ্জন স্যার। ইকবাল স্যার অল্প মোটা সাইজ হবে পাঁচ ফিট ছয় এর মতো। রঞ্জন স্যার লম্বা পাঁচ ফিট আট নয় হবে, তবে অনেক মোটা। কথা শুনেই মনে হয় উনারা সেই নেঙটা কালের বন্ধু। উনাদের দুজনের বয়স ৪৫/৪৬ এর মতো হবে। চেহারা দেখা বুঝা যায় ঘন্টাখানেক আগেই বাসায় ফিরেছেন, ফ্রেস হয়ে একটু কেনাকাটা করতেই আসেন। কুঁড়ি মিনিট কিনলে ত্রিশ মিনিট গল্প করেন বাইরে দাঁড়িয়ে।
সেদিন ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা, মালিক দোকানে এসেছেন আধা ঘন্টা হল। কোন এক কারনে উনার মেজাজ খারাপ, তার মাঝে আমার হাত থেকে পড়ে যায় দামী শো-পিচ। সাথে সাথেই চটে গেলেন।
‘তুই এক্ষুনি বের হয়ে যা’।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু রাগের পরিমান বাড়তে দেখে ফরসাল বলল,
‘ভাই বাইরে চলে যাও এখন, পরে এসো’।
আমিও সোজা বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। ইকবাল স্যার আর রঞ্জন স্যার আসলেন, ঢুকতেই আমাকে বাইরে দেখেন, আমি না দেখার মতো অন্য দিকে তাকাই। দুজনের পরনে আজ পাঞ্জাবি, ইকবাল স্যারের টা নতুন আর রঞ্জন স্যারের টা আগেও দেখেছি। রঞ্জন স্যার বলেন,
-কিরে নতুন পাঞ্জাবি, কবে কিনলি?
-এই তো দুদিন আগেই গিফট পেলাম।
-গিফট?
-অবাক হইলি মনে হয়, কেনো আমি কি গিফট পেতে পারি না।
-না মানে...
মানে মানে করতে করতে দুজন ভেতরে গেলেন, দুইটা সেভেন আপ এর ক্যান হাতে করে বাইরে এসে কথা বলছেন। উনারা বাইরে দাঁড়াচ্ছেন দেখে আমি আরেকটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই। জানি দেখলেই জিজ্ঞেস করবে,
কেন বাইরে?
কি হয়েছে?
এই এই ওই ওই...
ইকবাল স্যারের মোবাইলে কল আসে, স্যার খুব হেসে হেসেই কথা বলছেন। কথা শুনে রঞ্জন স্যারের আর সহ্য হচ্ছে না।
-কিরে কার সাথে এতো কথা?
-আরে দোস্ত বুঝবি না। এ আমার কিশোরের প্রেম।
-মানে কী? তুই আবার কখন কিশোরে প্রেম করেছিস। বলিস নি তো।
-কেনো? আমি কি তৃতীয় লিঙ্গের কেউ যে আমার প্রেম থাকতে পারে না।
‘আচ্ছা অধরা আমি একটু পর তোমায় আবার কল দিচ্ছি, এখন একটু রাখি’ বলেই ইকবাল স্যার মোবাইল রাখে।
-শালা তুই তো ঠিক করে কথাও বলতে দিবি না। তোকে আগে বলব কি করে মাত্রই তো খুঁজে পেলাম অধরাকে।
-কিছুই বুঝি না, বলছিস কিশোরের প্রেম, আবার বলিস মাত্রই খুঁজে পেয়েছিস।
-কথা দে কাউকে বলবিনে, এমনকি তোর বউকেও বলতে পারবি না।
-আচ্ছা কথা দিলাম বলব না, আমি জানি নিশিকে বলা মানেই অর্পিতাকে বলা। ওদের কারো কথা কারো পেটে হজম হয়না।
-হবে কী করে, আমাদেরও কি হজম হয়! ঠিকই আছে আমরা যেমন বেস্ট ফ্রেন্ড আমাদের বউরাও। এবার বল তোর কিশোর প্রেমের কথা।
‘তখন আমি মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ি, আমার চাচাতো ভাই রায়হান বয়সে আমার থেকে ৭/৮ বছরের বড়। কিন্তু রায়হান ভাই আমাকে বন্ধুই ভাবতো। পছন্দ করতো নন্দিনীকে, নন্দিনীর সাথে যত কথা হতো সব আমায় বলতো। আমার খুব ভালো লাগতো কথাগুলো শুনে। নন্দিনী রায়হান ভাইয়ের দুরের আত্মীয় হতো। ওই যে বলে না খালাতো ঘরের মামাতো এমন কিছু। হঠাৎ দূর্ঘটনায় রায়হান ভাই চলে যায় না ফেরার দেশে। এজন্য অনেকেই পরোক্ষ ভাবে নন্দিনীকে দায়ী ও করেছে। রায়হান ভাই বেঁচে থাকতে আমি কখনো নন্দিনীকে দেখিনি, শুধু ওর কথাই শুনেছি। রায়হান ভাই চলে যাবার প্রায় একমাস পর আমি একটা কাজে যাই চট্টগ্রামে নন্দিনীদের বাসায়। ওরা একটা দোতালা বাসায় থাকতো। নন্দিনীকে দেখে আমি হারিয়ে যাই সেই কথাগুলোর মাঝে। কত ভালোবাসতো রায়হান ভাই ওকে। চারদিন ছিলাম ওদের বাসায়, নন্দিনীকে দেখে যে কারোই ভালো লাগার কথাই। চট্টগ্রাম শহর আমার কাছে পুরাই নতুন। নন্দিনীকে আমি আপু বলেই ডাকতাম। আপু আমাকে অনেক জায়গা ঘুরে দেখান। একসাথে রিকসায় ঘুরান, পছন্দের খাবার খাওয়ান। ভালোই লাগছিল, তবে রায়হান ভাইয়ের অনুপস্থিতি আমায়...’
এখনে এসে ইকবাল স্যার চুপ হয়ে যায়। রঞ্জন স্যার বলে উঠে,
-তারপর কি হলো।
-বলছি...
‘নন্দিনী বুঝতে পারে আমি ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারি। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই দেখি নন্দিনী আপুর মন খারাপ। রাত গভীর না হতেই ঘুমিয়ে পড়েন। আসলে তিনি ঘুমাননি, রুমের সামন দিয়ে হেঁটে যেতে কান্নার শব্দ পাই। চারপাশ তাকিয়ে কাউকে না দেখে আমি রুমে প্রবেশ করি। মশারির ভেতরে হাত দিয়ে নন্দিনী আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। হাত বুলাতে বুলাতে ঘাঢ় পর্যন্ত হাতটা যায়। কারো একজনের আসার শব্দ পেয়ে আমি দ্রুত বেরিয়ে যাই। আমি সত্যিই বলতে পারবো না সেই অনুভুতির কথাটা। আমার পুরো শরীর শিরশির করে উঠে। নন্দিনী আপু বুঝতে পেরেছে এটা আমার হাত ছিলো। পরেরদিন আমাকে চলে আসতে হয় গ্রামে। শুনেছি অল্পদিনের মাথায় নন্দিনী আপুর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর বুঝতে পারি ওকে আমি হয়তো আপু বলতে চাইনি, শুধু নন্দিনী বলতে চেয়েছি’।
-তাহলে নন্দিনীর সাথে অধরার সম্পর্ক কী?
-দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর আমি নন্দিনীকে খুঁজেছি, অতঃপর একবছর আগে খুঁজে পেয়েছি অধরাকে।
-তবে কি রায়হানের নন্দিনীই তোর অধরা?
ইকবাল স্যার চুপ হয়ে আছে, এতো ব্যক্তিগত কথা শুনার জন্যে আমি এখানে দাঁড়াইনি। শুনতেও চাইনি। রঞ্জন স্যার বলে,
-এরপর কি হলো বল।
-আমি অধরাকে ভালোবাসি, আজো...
-প্লিজ আর বলিস না ভালোবাসি। তোর ভেতরেই রাখ শব্দটা। মনে রাখিস তোর ঘর সংসার সন্তান আছে। অর্পিতা কোন ভাবে জানতে পারলে খুব খারাপ হবে।
-তাই তো তোকেও বলতে চাইনি, বাস্তবতা মেনে নিয়েই তো চুপ আছি। কিন্তু আর পারছিনা।
আমি আর পারছিনা কথাগুলো শুনতে, বুকের ভেতর একটা শব্দ হচ্ছে বারবার। আজই আমায় বাইরে আসতে হলো, আজই উনাদের এসব বলতে হলো। এমন একটা ঘটনার রাজসাক্ষী আমি হয়ে গেলাম। আমি আরো সাবধান হয়ে যাই, এই মুহূর্তে উনারা আমায় দেখা ঠিক হবে না। রঞ্জন স্যার ইকবাল স্যারের ঘাঢ়ে হাত রেখে বলেন,
-কোথায় দেখা অধরার সাথে, আর কি হলো অধরার।
-গতবছর আমাদের অফিস থেকে পিকনিকে যাই চট্রগ্রামে। ঊনত্রিশ বছর আগে অধরা যে বাড়িতে ছিল, ঠিক তার পাশেই। সেখানে যাওয়ার পর আমি হারিয়ে যাই সেই রাতের স্মৃতিতে। মনে হল এই তো সেদিনের কথা। গিয়ে দেখি পুরানো দোতালা বাড়িটা এখন আর নেই, সেখানে ১৩ তালা বাড়ি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বাড়ির মালিক সেই আগের লোকই। একটু সময় নিয়ে আমি যাই ওই বাসায়, পরিচয় দিই ঊনত্রিশ বছর আগের। বাড়ির মালিক কথায় কথায় বলেন,
‘নন্দিনী কিছুদিন আগে এসেছে আমাদের এখানে, ওর বাচ্চাকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করিয়ে গেল। সেই বিয়ের পর এত বছর পর ওকে দেখলাম, অনেকটাই আগের মতো আছে। ও নাকি রাজশাহী থাকে এখন’।
-আমি গল্পের ছলে নন্দিনীর মোবাইল নাম্বার চাই, উনি আপত্তি করেন নি। চট্টগ্রাম থাকা অবস্থায় আমি ওকে কল করতে পারিনি। আনন্দ করতে গিয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরে এলাম। কষ্টটা কেন হচ্ছিল বুঝতেই পারিনি। ঢাকায় এসে কল করি, নাম বলতেই ও আমায় চিনে ফেলে। এই এক বছরে ৫/৭ বার কথা হয়েছে। দুমাস আগে আমাদের অফিসে কিছু রদবদল হয়, এই নিয়ে খুব কাজের চাপে থাকি। দুজন সিনিয়ার জয়েন করে। একজন এসেছে রাজশাহী থেকে। অধরার সাথে গত মাসে এত বেশি কথা হয়েছে যে আমি আমার ত্রিশ বছর আগের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করি।
-অধরা কেমন আছে ঘর সংসার নিয়ে।
-একবার মনে হয় দেখা না হওয়াই ভাল ছিল, আবার মনে হয় এটাই হয়তো হবার কথা ছিলো। অধরা ভালো নেই। আচ্ছা রঞ্জন তুই কি কখনও গলা কাটা মোরগ মুরগীকে হেঁটে যেতে দেখেছিস। ওই যে আধা জবাই করার পর মোরগ মুরগি কাটা গলা নিয়ে দৌড়ায়। আমার অধরাই ঠিক তেমন আছে।
-বলিস কী?
-আমার অফিসের সিনিয়ার যিনি রাজশাহী থেকে এসেছে উনিই অধরার স্বামী। একজন মানুষ মুখোসের আড়ালে কতটা অমানুষ হতে পারে তা ওর স্বামীকে না দেখলে বুঝতাম না। দুদিন আগে অধরার সাথে আমার দেখা, পাঞ্জাবিটা ও আমার জন্যে নিয়ে এসেছে। আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনি, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ওর মাথার কাপড়ের ফাঁকে ডান পাশের কপালটা ফুলে আছে, আমি জানি এটা ওর স্বামীর দেয়া চিহ্ন।
-তুই বুঝলি কি করে?
-সেদিন কথাপ্রসঙ্গে ও বলতে গিয়ে থেমে যায়।আমি এমন অধরাকে দেখতে চাইনি। অধরাকে খুঁজে না পেয়েও যদি জানতাম ও সুখে আছে তাই মনে হয় ভালো ছিলো। আজ বারবার একটা কথা মনে পড়ছে, সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ দূরে থেকে সুখে থাকলেও ভালো লাগে। নিজের কাছে থেকে কষ্টে থাকার চেয়ে। আমি কিছুই চাইনা, শুধু অধরাকে সুখি দেখতে চাই। প্লিজ রঞ্জন তুই কি বলবি কিভাবে আমি অধরাকে সুখি করতে পারবো।
ঠিক এই মুহূর্তে ইকবাল স্যার রঞ্জন স্যারকে জড়িয়ে ধরে, অমনি উনি আমায় দেখে ফেলে। কে? বলতেই আমি বেরিয়ে আসি। উনারা দুজনই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমি দুজনের পা ধরে রাখি, আমায় উনারা দাঁড়িয়ে দেয়। উনারা কিছু বলার আগেই আমি বলি,
‘স্যার আজ রাতের বাসেই আমি গ্রামে যাব, দেখে আসবো আমার নীলাঞ্জনা কেমন আছে। যাকে আমি ক্লাস সেভেনে ভালোবেসেছিলাম। সত্যিকারের ভালোবাসা ভালো থাকতে চায়, রাখতে চায়। আমি ও চাই নীলাঞ্জনা সুখে থাকুক। মনে রাখবেন আপনাদের কিছু কথার রাজসাক্ষী আমি হলেও কখনও কাউকে কিছু বলব না। মনে রাখবেন রাজসাক্ষী ও কখনো কখনো মুখ বন্ধ রাখে। যেমন আমিও রেখেছিলাম সেই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়।’