মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

নিষ্ফল ক্রন্দন
অনলাইন ডেস্ক

অনেক দিন পর বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে শীতের সকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় বসে ছিলাম কমলাপুর স্টেশনে। অন্যদিনের তুলনায় সেদিন যেন শীতের আদ্রর্তা একটু বেশি ছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল। শীতের মোটা কাপড় গায়ে দেওয়ার পরেও হাড় টাটানো কাঁপুনি যেন মোটেও থামছিল না। এই শীত যেন সেদিন জেঁকে বসেছিল স্টেশনের প্লাটফর্মে।

চারিদিকে ঘন কুয়াশার কারণে সেদিন দূর প্রান্তের কোনকিছু দেখা যাচ্ছিল না। সবকিছু যেন ঝাঁপসা ঘোর ঘোর লাগছিল। পুব আকাশের সূর্য মামা কোথায় উঁকি দিচ্ছে, সেদিন তা বলা ভারি মুশকিল ছিল? মনে হচ্ছিল, সূর্য মামা শীতের বুড়ির সাথে সত্যি সত্যি অভিমান করেছে। যার কারণে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে।

তবু সেদিন আবহাওয়ার এই করুন পরিণতির কারণে মেঘের আড়ালে সূর্য মামা দেখা না গেলেও, একমুঠো সোনালি রোদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসেছিল হাজার জনতা। জীবিকার অমোঘ তাড়নায় এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে প্রতিটি মানুষ ছুটে চলছিল। তারা শীতের আদ্রর্তাকে উপেক্ষা করে অক্লান্ত পরিশ্রম করছিল, কোন এক অজানা সুখের আশায়।

ঠিক তেমনি দৃশ্য দেখেছিলাম, সেদিন স্টেশনের প্লাটফর্মে। দূর থেকে চেয়ে দেখি, ফুটফুটে চেহারার পথচারী এক শিশু কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে জীবিকার অমোঘ তাড়নায় সামান্য কিছু ঝালমুড়ি নিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে বেচে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তবু সে শীতের আদ্রর্তাকে হার মানিয়ে প্লাটফর্মে যাত্রীদের মাঝে ঝালমুড়ি বেচার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এমন দৃশ্য দেখে, সেদিন আমি ঝালমুড়ি খাওয়ার উদ্দেশ্য তার কাছে ছুটে যায়। আমি তার কাছে যাওয়া মাত্রই সে আমাকে বলছে, ‘ভাইয়া, ঝালমুড়ি খাবেন নাকি? আমার হাতের তৈরি ঝালমুড়ি খুব সুস্বাদু। আমি অনেক কয়বছর ধরে প্লাটফর্মে যাত্রীদের মাঝে ঝালমুড়ি বেচে বেড়াচ্ছি। সবাই আমার ঝালমুড়ি খুব পছন্দ করে। আপনাকে কি ঝালমুড়ি বানিয়ে দেবো?’

আমি তখন তার কথায় সম্মতি দিয়ে বললাম, হুম বানিয়ে দাও। আমি তো তোমার কাছে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য ছুটে এসেছি। অবশ্যই বানিয়ে দাও। তখন আমার কথা শুনে পথচারী শিশুটি হেসে পড়ল এবং হাসতে হাসতে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাইয়া, কয়টাকার ঝালমুড়ি বানিয়ে দেবো? বিশ টাকার নাকি, ত্রিশ টাকার?’ আমি তখন তাকে বললাম, ত্রিশ টাকার ঝালমুড়ি বানিয়ে দাও। সে মুহুর্তের মধ্যে খুব সুন্দর ভাবে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিল। আমি ঝালমুড়ির খেতে খেতে তাকে কিছু প্রশ্ন করলাম, ছোট ভাই তোমার নাম কি? তুমি কোথায় থাক? আর এত ছোট বয়সে তুমি কেন ঝালমুড়ি বেচে বেড়াও? তোমার মা-বাবা বেঁচে নেই? এত ছোট বয়সে কেউ কি ঝালমুড়ি বেচে বেড়ায়? এখন তো তোমার স্কুলে যাওয়ার সময়?

তখন সেই পথচারী শিশুটি আমার কথা শুনে নীরব হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের মিষ্টি হাসিটা থেমে যায়। কিছুক্ষণ থমকিয়ে মনটা ভার করে সে আমাকে বলে, ‘ভাইয়া, আমার নাম রিদয়। রেললাইনের ধারে গড়ে ওঠা ঐ বস্তিতে আমি বড় হয়েছি। আমার বাড়িতে শুধু মাত্র জনম দুঃখিনী মা ছাড়া কেউ নেই। আর হতভাগা বাবা বেঁচে থেকেও আমাদের কাছে মরে গেছে। বহুদিন আগে মায়ের সাথে রাগারাগি করে তিনি আমাদেরকে বস্তিতে রেখে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। আজও কোনদিন আমাদেরকে খোঁজখবর নেয়নি। বাবার অবর্তমানে সংসার চালানোর জন্য খুব অল্প বয়স থেকেই আমাকে ঝালমুড়ি বেচে বেড়াতে হয়। একমুঠো ভাতের আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে যেতে হয়।

আজকে যদি বাবা আমার পাশে থাকতো, তাহলে আমাকে ঝালমুড়ি বেচে বেড়াতে হত না। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে শিক্ষা অর্জনের জন্য ভালো মানের কোন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দিতেন। কোন অভাব অনাটন বিন্দুমাত্র আঁচ লাগতে দিতেন না। আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেন।

কিন্তু আমার ভাগ্য এতটাই খারাপ যে, এত ছোট বয়সে সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাকে পথে পথে ঝালমুড়ি বেচে বেড়াতে হচ্ছে। প্রচণ্ডশীতে পাতলা একটা পোশাক পড়ে খুব কষ্ট করে দিন পার করতে হচ্ছে। নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় আমরা যে গরিব-দুঃখী মানুষ, আমাদের দুঃখণ্ডকষ্টের হাল কেউ বুঝতে চাই না? আমরা যদি সারাদিন না খেয়ে থাকি, তবু আমাদেরকে কেউ খোঁজখবর নেয় না। অভাব অনাটনের সময় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়াই না। আমরা যে গরিব ঘরে জন্ম গ্রহণ করে বড় অপরাধ করেছি? এই জন্য পৃথিবীর বুকে আজকে আমাদেরকে এত বড় শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে?

সেদিন পথচারী শিশুটির মুখে তার বাস্তব জীবনের দুর্দশার কথা শুনে, আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার অবুঝ মন বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিল, কী লাভ হবে দুনিয়ার বুকে অঢেল অর্থ সম্পদ গচ্ছিত রেখে? যদি সেই গচ্ছিত অর্থ সম্পদ মানবতার সেবায় কাজে না লাগে। মৃত্যুর পর কিয়ামতের সেই কঠিন বিচারের দিন কোন কাজে না আসে। সামান্য আরাম আয়েশের তরে কি হবে বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করে? যদি চোখের সামনে একমুঠো ভাতের অভাবে পথচারী শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মরে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়