মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

টেলিফোনের দিনগুলোতে প্রেম
অনলাইন ডেস্ক

একটি টেলিফোনের দোকানে কাজ করতাম তখন। সকাল-বিকেল কাস্টমার এসে টেলিফোন করতো দোকানে। এখনকার মতো ফেসবুক-মেসেঞ্জারের সস্তা দু অক্ষরের মেসেজেই মিটে যেতো না সব আবেগ। সারাদিন শেষ একটি টেলিফোন করে ও-পাশ থেকে প্রিয় মানুষটির কণ্ঠে ‘হ্যালো’ শব্দটি শোনা যেনো ছিলো সাহারার বুকে একটুখানি পানি পাওয়ার মতো ব্যাপার।

নাহ্, টেলিফোন করা নিয়ে আমি এখন খুব আহামরি গল্প ফাঁদতে যাবো না। ভারী ভারী জ্ঞানও ঝাড়বো না। টেলিফোন করাটাই তখন স্বাভাবিক ছিলো। তখন এতো উন্নত সুবিধা ছিলো না। মানুষ চিঠিপত্র আর টেলিফোননির্ভরই ছিলো। তবে ঘটনাটি ছিলো ভিন্ন। একটি লোক, যার কথা আজ এতো বছরেও ভুলিনি। তার গল্পটি মনে দাগ কেটেছিলো। এতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। বাজার থেকে কিনে দামি দামি মালমশলাও এতে মিশানো হয়নি। কবিতার পঙ্ক্তি উপমার বাহুল্য নেই। অত্যন্ত সাধারণ দুটি বাক্যে জীবনের খুব নিষ্ঠুর অথচ করুণ সত্য।

আমি প্রতিদিনের মতোই সকাল সকাল দোকান খুলে কাজে লেগে পড়ি। মানুষ আসে যায় সারাদিন টেলিফোন করে। দোকানে টেলিফোন করার পাশাপাশি কিছু স্টেশনারি জিনিসও পাওয়া যেতো। মালিকের পাশেই আরেকটি হোটেল ছিলো। আকবর মিয়া বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব হাউজ। সারাদিন এভাবে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আকবর মিয়া বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব হাউজের মুখরোচক খাবারের ঘ্রাণ নিতাম। যেদিন কপালের বরাত ভালো থাকতো মালিকের উছিলায় মাগনা খেয়ে আসতাম পেটপুরে। ঠিক, শেষ বিকেলের দিকে লোকটা আসে। চেয়ারে বসে বসে পা নাচাতে নাচাতে একটু তন্দ্রা মতো লেগে এসেছিলো। বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। এমন সময় সামনের টেবিলটায় ঠকঠক করে আওয়াজ হতেই সুখের নিদ্রাটা চলে গেলো। হঠাৎ ঘুমটা ভাঙ্গায় প্রথমটা বেশ বিরক্ত হই।

কী মিয়া... আর সময় পান না। কী চাই?

হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে তাকাতেই দেখি কালো মতো লম্বায় ছ ফুট একটি ছেলে দাঁড়ানো সামনে। বয়স আন্দাজ ৩০/৩২ হবে। ফুল হাতা হাওয়াই শার্ট। মাথায় এক পাশে সিঁথি কাটা। আমি তখনো অবাক হয়ে চেয়ে আছি। লোকটি অনুতপ্ত হয়ে বললো, মাফ করবেন ভাই আপনার ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম। একটি টেলিফোন করতে পারি কি?

টেলিফোনের দোকান দিয়েছেই টেলিফোন করার জন্যে। এতে অনুমতি নেয়ার কী আছে।

আসলে না বলে ফোন করতে কেমন লাগছিলো। হালকা করে হাসে ছেলেটি।

আশ্চর্য মানুষ।

ছেলেটি প্রায় আধাঘণ্টা খুব মনযোগ দিয়ে কার সাথে যেনো টেলিফোনে কথা বলে। এই পুরো সময়টা তাকে লক্ষ্য করলাম। কথা বলার সময় মাঝে মাঝেই তার চোখ দুটি আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠছিলো। অনেক তৃপ্তি নিয়ে কথা বলছিলো।

পরের দিনও একই সময়ে লোকটা আসে। আগের মতোই বলে, একটি টেলিফোন করতে পারি কি? তারপর সময় নিয়ে কারো সাথে কথা বলে।

এভাবেই চলতে লাগলো। প্রতিদিন শেষ বিকেলের দিকে এসে আধাঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলতো। ওর বউ বোধ হয়। এতদিনে এটুকু আঁচ করেছিলাম। কেনো যেনো বেশ ভালোই লাগতো ওদের রোজকার এ প্রেমপর্ব। মাঝেমধ্যে দু-একদিন ফোন করতে না এলে মনটা খচখচ করতো নিজের অজান্তে। এতদিনে কিছুটা আলাপ-পরিচয়ও তৈরি হয়েছে আমাদের মাঝে। একদিন খুব আগ্রহ করে বলতে লাগলো, এবার ছুটিতে বাসায় গেলে তুলির জন্য একটা জলপাই রংয়ের শাড়ি আর একডজন লাল চুড়ি নিয়ে যাবো।

তোমার বউয়ের নাম তুলি?

ছেলেটি একটু লজ্জামিশ্রিত স্বরে বললো, হ্যাঁ। চমৎকার নাম না? মেয়েটাও চমৎকার।

সেদিন সকাল থেকেই ঢাকা শহরে খুব বৃষ্টি। সারাটাদিন টানা চলতেই থাকলো। ভাবছিলাম আজ তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করে চলে যাবো। এই বৃষ্টির মধ্যে কে আর মরতে আসবে ফোন করতে। সাঁটার লাগাতে যাবো এমন সময়ই ভিজে কাক হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসে সে। আমি বেশ অবাক হই। আরে সোহাগ তুমি? এই বৃষ্টির মধ্যে? হাঁপাতে থাকে।

ইজাজ ভাই, ভাই আমাকে একটা টেলিফোন করতে দাও।

হ্যাঁ অবশ্যই দিবো, কিন্তু এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন?

ভাই জলদি ফোন করতে দাও। ওরা যে কোন সময়...

কথা শেষ করার আগেই একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে সামনে থামে, দুজন হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় একজন দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি পরা লোক আর একটা পায়জামা কোর্তা পরা রাগী চেহারার ছেলে। তারা সোহাগকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। সোহাগ তখনো চিৎকার করতে থাকে, ভাই আমি একটা টেলিফোন করবো। আমাকে একটি টেলিফোন করতে দাও। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। হাতের ছাতাটা কখন বাতাসে উড়ে গেলো খেয়ালই করিনি। ছুটে গিয়ে ছাতা ধরার চেষ্টাও করিনি। সেই দাড়িওয়ালা লোকটা কাছে এসে বলতে শুরু করে, বুঝলে বাবা, ও তো পাগল। সুস্থ নয়। আর টেলিফোনে ও কারো সাথেই কথা বলে না। ওর বউ মারা গিয়েছে ২ বছর আগেই। গ্যাস স্টোভটা রাতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলো। সকালে উঠে জ্বালাতেই ওহ্ সে কী মর্মান্তিক মৃত্যু। পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু মেয়েটার প্রতি বেশ টান ছিলো। মেয়েটা রোজ শেষ বিকেলে একবার টেলিফোন করে খবর নিতো। সেদিনও দুর্ঘটনার কিছু আগে ফোন করেছিলো। তার বর ব্যস্ততায় ধরতে পারেনি। সে চাকরি করতো সাভারে। ওখানেই ওদের বাড়ি আর আমি তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতাম। সব খবরই জানতাম। আমার নিজেরও একটা টেলিফোনের দোকান আছে এলাকায়। প্রথম প্রথম কদিন আমার এখানে এসে ফোন করতো। আমার সন্দেহ জাগলো। ঘাটিয়ে দেখলাম যা ভেবেছি তাই। ওর পরিবারের লোক ওকে বাসায় আটকে রাখতো। দুই মাস আগে পালিয়ে কীভাবে যেন এখানে চলে এসেছে আল্লাহ মালুম। আচ্ছা যাই বাবা।

অ্যাম্বুলেন্সটা আমার চোখের সামনে দিয়ে হুশ করে চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলাম। সময় আগালো। ভাগ্য ফিরলো। টেলিফোন নেই এখন কিন্তু স্মৃতির পটে সেই গল্প জীবন্ত হয়ে গেঁথে আছে আজও। এখনো মনে হয় শেষ বিকেলে হয়তো কেউ এসে আমার দরজায় দাঁড়াবে লম্বা কালো মতো ফুল হাতা হাওয়াই শার্ট গায়ে শুকনো চেহারায়। বিনয়ের সাথে বলবে, একটি টেলিফোন করতে পারি?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়