মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

তৃতীয় সন্তান
অনলাইন ডেস্ক

এক.

ফার্মেসি থেকে ঔষুধ কিনেই অস্থিরতা বাড়ে। হৃদপি-ের দম ছোট হয়। মায়ার সুতোয় টান লাগে রিজনের। তারপর ধীরে ধীরে বাসার পথ ছোট হতে থাকে। তবে অপরাধবোধ হতে থাকে দীর্ঘ। কিছুদিন শিপু খুব বিরক্ত করছে রিজনকে। শিপু একটি ওষুধের নাম ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা নিয়ে এসো।

রিজন আনি আনি করে আনে না। কখনো ভুলে গেছি, কখনো পকেট খালি এভাবে চলে কিছুদিন। কিন্তু শিপু যেনো নাছোরবান্দা। ওষুধ আনতেই হবে।

তিন মাস শিপুর ঋতু¯্রাব বন্ধ। প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ। রিজন-শিপু এমন কাণ্ডে অবাক। কী করে সম্ভব? এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। রিজন পদ্ধতি গ্রহণ করছে। শিপু কয়েক রকমের পদ্ধতি নেয়। কোনটিই শরীরে সেট হয় না। একটা না একটা শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। বাধ্য হয়ে রিজন কনডম ব্যবহার করে। শিপু কনসিভ করায় মানসিক বিপর্যস্ত সে। কতেক প্রশ্ন আওড়ায় মনের কোনে। এই যেমন, বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেও কীভাবে প্রাণের স্পন্দন তৈরি হলো? রিজন কি আমাকে সন্দেহ করছে? সন্দেহ করাতো যৌক্তিকও বটে। সেতো নিজেই প্যাকেট ব্যবহার করে। তাহলে কীভাবে শুক্রাণু জরায়ুতে প্রবেশ করলো? রিজন কি দ্বৈত সম্পর্ক বিশ্বাস করে? নাকি আমাকে অবিশ্বাস করে। এমন নানামুখী প্রশ্নে জর্জরিত হয় শিপু। প্রশ্ন থেকে মুক্ত হতে শিপু গর্ভে আগত ভ্রুণ হত্যা করতে প্রস্তুত। কোনোভাবেই এ প্রাণের মুক্তি দেয়া যাবে না শিপু সংকল্প করে।

রিজন কোনো মতেই আগত উত্তরাধিকারকে হারাতে চায় না। রিজন মনেপ্রাণে চায় বেঁচে যাক অনাগত প্রাণ। ফোটার আগে যেনো না ঝরে কলি। শিপুর চাপাচাপিতে স্বপ্নের ভাবনাও প্রকাশ করতে পারছে না। বেশ কিছুদিন মানসিক টানাপোড়েনে কাটছে সময়। কোনো কথা শুনতে বা বুঝতে চাচ্ছে না শিপু। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে আজ ওষুধ কিনেছে রিজন। হাঁটতে হাঁটতে বিবিধ ভাবনার মিশে মিশে বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। কলিংবেল চাপতেই দরজা খোলে শিপু। ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিপু ওষুধ এনেছে কি না জানতে চায়।

-এনেছি।

-মাগো মা। এতোদিন পর তোমার মনে ছিলো। আমিতো চিন্তায় অস্থির। এখনি যদি ওষুধ না খাই পরে ডিএনসি করতে হবে। বান্ধবীদের কাছে শুনেছি এ যে অসহ্য যন্ত্রণা। আমি ওমন যন্ত্রণা সইতে পারবো না।

রিজন হাত মুখ ধোয়। ে নো কতো বড় পাপ করে এসেছে সে। শরীরে ঘুম ঘুম ভাব। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর বিছানা খোঁজে। অথচ একটি ব্যর্থতা যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে রিজনকে।

-ডাইনিংয়ে ভাত রাখা আছে। খেয়ে নাও।

রিজন ভাত নেয়। মাখে। কিন্তু লোকমা মুখ পর্যন্ত উঠে না। বৌ-ভাত খেলে যেমন পেঠ ভরে থাকে। মন না চাইলে খাবার মুখে উঠে না। খাবারও যত্ন চায়।

একই বিছানায় রিজন-শিপু এবং দুই ছেলে-মেয়ে ঘুমায়। বাকি দুই বেডরুম খাঁ খাঁ করে। ডায়নিং টেবিল থেকে রিজন বিছানায় আসে। লম্বা হয়ে শোয়। শিপু মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলায়। শিপুরও যে শরীর ভালো যাচ্ছে তাও কিন্তু নয়।

শিপু বলে, কিগো তোমার মন খারাপ?

-না। শরীরটা ভালো লাগছে না। সারাদিনের জার্নিতে খুব ক্লান্তি ছুঁয়েছে শরীর-মন। তুমিও শুয়ে পড়। ও... আর তোমার ওষুধ ওয়ারড্রবের উপর রাখা আছে।

-খেয়ে নিই?

-তোমার ইচ্ছা। আমাদের যেহেতু দুই সন্তান আছে। আর সন্তান সন্ততির দরকার কি?

-হুম। তাইতো। ঠিক বলেছ?

রিজন অবশ্য শেষ পর্যন্ত শিপুর এমন হ্যাঁ-সূচক বাক্যের প্রত্যাশা করেনি। ভেবেছে, হয়তো শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের আহার সৃষ্টিকর্তাই নির্ধারণ করেন। প্রবীণ লোকেরা বলে, যে অতিথি আচমকা বাড়ি এসে হাজির হয় তাকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না। অমঙ্গল হয়। তাছাড়া আমরাতো তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না হত্যা করছি। খুন করছি। কিন্তু কোনো ভাবেই শিপু বিষয়টিকে সহজ করে নিচ্ছে না। আচ্ছা ঘুমিয়ে গেলাম বলে বিপরীত দিকে কাত হয় রিজন। এ শুধু ঘুমের ভান ধরা। মূলত মুখ আড়াল করা। মুখ আড়াল করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কিছুই আপনাকে আঘাত করতে পারবে না।

শিপু একগ্লাস পানি নিয়ে ওষুধের উপর থেকে চামড়া সরায়। মনে মনে ভাবে, নিশ্চয় রিজন সন্দেহ করছে। আমি বাবার বাড়ি বেশি বেশি বেড়াতে যাই। সে পছন্দ করে না। বিয়ের আগে যে সম্পর্ক ছিলো তাণ্ডও সে জানে। প্রায়শই ওই ছেলেকে নিয়ে কথায় কথায় ঝগড়ায় গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু আমাদের দুই সন্তান আছে আর সন্তান লাগবে না এমন ভাবনা থেকেই তো সে সন্দেহ না করলেই পারে। যা হোক, যতই চিন্তা করি কোনোভাবেই এ ভ্রুণ বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। বাজে ভাবনা আর প্রসারিত না করাই শ্রেয়।

দুই.

বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকে শিপু। সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠে। রিজন তাদের সাথে যায় না। রিজনের শ্বশুর বাড়ি ভালো লাগে না। কেমন যেন পরাধীন মানুষের মতো লাগে। নিজের বাড়ি যেনো বেহস্তখানা। কিন্তু আজকাল ঘরের ভেতরেও ভালো লাগে না। রাতে ঘুমালে পাশের রুম থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। লাইট জ্বালালে সে কান্নার শব্দ আর শোনা যায় না। মাসখানেক পর শিপু বাসায় আসে। তখন আর রাতে ওই কান্নার আওয়াজ আসে না। এরপর থেকে শিপু কোথাও বেড়াতে গেলে রিজন কোনো না কোনো বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসে। একসাথে ঘুমায়। কিন্তু কখনো কখনো কোনো বন্ধুই আসতে চায় না। তখনি বাধে বিপত্তি। রিজন একা হলেই কান্নার শব্দ শুনতে পায়। ভেসে আসে করুণ সুর। মানুষের কোলাহলেও একনিষ্ঠ ধ্যান করলেও ছুটে আসে কোমল কণ্ঠে কান্নার সেই আওয়াজ। তাই রিজন এখন আর একা হয় না। নিরব থাকে না। যখন একা থাকতে হয়, তখন কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনে। অথবা মোশারফ করিমের নাটক দেখে। ইদানীং রাশেদ সীমান্ত নামের একজনও খুব ভালো অভিনয় করছে। মোশারফ করিমের রাজত্বে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়েছে। ‘আমার বাবা’ বা ‘মধ্যরাতের সেবা’ নাটকগুলোতে চমৎকার অভিনয় করেছে রাশেদ সীমান্ত।

তিন.

প্রায় এক যুগ পর। হঠাৎ সেই পূর্বের কান্না। তবে সেই আগের মতো নয়। এখন কান্নায় একটু পরিপূর্ণতা এসেছে। রিজনের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। শরীরে ডায়বেটিস বাসা বেঁধেছে। তাই সকাল-বিকেল হাঁটতে হয়। কিন্তু যখন একা হয় তখনি বাধে বিপত্তি। কেউ একজন যেন সাথে সাথে হাঁটে। ঠিক রিজনের মতো। কিন্তু আশপাশে তাকালে কাউকে দেখা যায় না। রিজনের মনে ভয় ধরে। একদিন হঠাৎ করে শুনতে পায় ‘বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি’। রিজন থমকে দাঁড়ায়। দূরে মানুষ হাঁটছে। আশপাশে কেউ নেই। কিন্তু এমন কথাতো কখনো কাউকে বলতে শুনেনি রিজন। বাবাকে ভালোবাসে এমন শব্দ মানুষের মুখ থেকে খুব কমই উচ্চারিত হয়। মানুষ মাকে ভালোবাসে। কেউ কেউ মাকে ভালোবাসার কথা বলে ফেলে। কিন্তু বাবারা সবসময় বঞ্চিত হয়। সন্তানের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রায় সব বাবাই রসহীন। রুক্ষ। অথচ প্রাণের জন্যে বাবাদের থাকে প্রাণপ্রণ চেষ্টা। সন্তান প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবদি সকল পরিকল্পনা, ধ্যান বা টেনশন যেন স্থায়ী লিজ নিয়ে রাখেন তারা।

আবার একই কথা বাতাসে ভেসে আসে ‘বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি’। রিজন এবার নিজের সাথে কথা বলে। কে?

-আমি তোমার ছেলে বাবা।

-আমার ছেলে?

আমাকে ছুঁয়ে দেখো আমি ঠিক তোমার সমান হয়ে গেছি। আমার খুব কষ্ট হয় বাবা। তোমার কোলে উঠতে পারি না বলে। তোমার বুকে গড়াগড়ি করতে পারি না। অথচ আমি সবসময় তোমার আশপাশেই থাকি। তোমার ছায়া হয়ে থাকি। সেদিন তুমি যখন আনমনে মোটরবাইক চালাচ্ছিলে অল্পের জন্যে ট্রাক তোমাকে চাপা দেয়নি। আমিই তোমার ব্রেক কষে ছিলাম। তুমি ভাবতেই পারোনি তুমি বেঁচে আছো।

আরেকদিন অটোরিক্সার সাথে ধাক্কা খেয়ে তুমি যখন রাস্তায় সিটকে পড়লে তোমার ঠিক মাথার কাছ দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে গেছে। তুমি ভেবেছ তোমার মাথা পিষে গেছে। তুমি তোমার হাত ধরে দেখো, বুকে হাত দিয়ে দেখো তুমি বেঁচে আছো কি? তুমি বেঁচে ছিলো। তুমি যখন বাসায় একা থাকো আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। শরীরের ঘামাচি খুটে দিই। তুমি খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো। বিছানায় পিঠ বিছালেই তোমার ঘুম চলে আসে। কখনো ভাবনি শোলে এতো তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে কেন? আজও আমি কথাগুলো বলতাম না। শুধু বলেছি তুমি আমাকে ভুলে গেছো। আমি জানি, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসতে। মা কী কারণে ভালোবাসতে পারিনি আমি জানি না। অথচ মা আমায় আলো দেখতে দেয়নি। তুমি মন থেকে চেয়েছো আমি যেন পৃথিবীর আলো দেখি। তারপরেও তোমার একটা ভুলে আমি তোমার আদরবঞ্চিত। তুমি মাকে বুঝিয়ে বলতে পারতে। বলোনি। মা তোমার কথা অবশ্যই রাখতো। মা যখন আমায় আঘাত করলো আমি চিৎকার দিয়েছি। খুব চিৎকার দিয়েছি। বারবার বলেছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। খুব করে কেঁদেছি। আমার চিৎকার কেউ শোননি। তুমিও শোননি বাবা।

রিজন রাস্তার পাশে বসে পড়ে। খুব খারাপ লাগছে। পেছন থেকে কেউ একজন এসে ধরে দাঁড় করায়। ভাই আমাকে একটু বাসায় নিয়ে চলুন। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার পা চলে না। ভদ্রলোক রিজনকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে রিজন। ক্লান্ত শরীরে আজ আর অফিসে যেতে পারেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অফিসের বসকে ফোন করে জানায় আজ আসতে পারবে না। চাকুরি জীবনে এই প্রথম অপ্রত্যাশিত ছুটি নিলো রিজন। পুরোদিন বাসায় খুনসুটি করে। নিজে নিজে কথা বলে রিজন। শিপু অবাক হয়। রিজনের আনমনে কথা বলা শুনে ভয় পায় শিপু। রিজন কথা বলে যায়। কথাগুলো কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। কিন্তু শিপু কোনো ভাবেই পুরো বাক্য বুঝতে পারে না। শিপু কথা বললে রিজন স্বাভাবিক হয়। স্বাভাবিক হওয়ার পর শিপু এমন কথা বলার বিষয়ে জানতে চাইলে রিজন কিছু বলে না। অথবা বলতে পারে না। কিংবা ইচ্ছে করেই বলে না। রিজন বলতেও চায় না। এতোদিনে সন্তান যে তার সমান হয়ে গেছে। সে খবর কেইবা রাখে? একযুগ আগের ভ্রুণ হত্যার বিষয়টি কারোরই মাথায় আসে না। মানুষের জীবন কতো শত ঘটনায় সাজানো। সব ঘটনা মানুষ মনে রাখে না। স্মৃতিও ভুলে যায়। যদিও কিছু ঘটনা আপনাআপনি মনে গেঁথে থাকে। হৃদ মন্দির দখল করে নেয়। শিপু ভুলে গেছে সব। কথায় আছে বিষাদ মনে রাখতে নেই। রাখলে বিষাদ বাড়ে। রিজন প্রায়ই অনুতপ্ত হয়। অনুসূচনায় ভোগে। যখন ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়ায় তৃতীয় সন্তান।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়