প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
স্কুল ফাঁকি দিতে পারা জীবনের সবচে বড় স্বার্থকতা। ছাত্র হিসেবে এমন ভাবনা অবান্তর নয়। অথচ উড়ন্ত সে সময় কত রঙিন কত বর্ণিল। জীবনের অর্ধেক রং খরচ করে বাকী জীবন চলছে রঙের টানাপোড়নে। এখন আটপৌড়ে জীবন। আচমকা আনমনে ফিরে দেখা হয় ফেলে আসা দিন। হতাশা নয় ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা দিতে হয় সে সময়টুকু জীবন জুড়ে থাকায়। হৃদয় এখন সবটুকু ভালো লাগা উপভোগ করে ডাকাতের মতো। ফুল ছিড়ে নির্দয় মন তৃষ্ণা মেটায়। বেপরোয়া মন বেখেয়াল। পুরো দেশে পাকবাহিনীর হানা। উত্তাল ঢাকা শহরে শুধু মৃত্যু আতঙ্ক। চারিদিকে স্বজন হারোনার গগণবিদারী চিৎকার। দেশের এ উত্তাল সময় কিছু একটা করার খুব ইচ্ছে হয় সারাফাতের। সে সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। পাশের বাড়ির যুবকরা যখন যুদ্ধে যেতে মরিয়া তখন সারাফাত যেন অন্যমানুষ। ভিন্ন ভাবনায় মাতাল। অবশ্য ঘরবন্দি সারাফাতে খুশি বাবা-মা আর বোন। তারা কেউ চায় না সে ঘরের বাইরে যাক। যুদ্ধ শুরুর সপ্তাহ খানেক পরে এক বিকেলে ঘরের বাহির হয়েছিলো সারাফাত। ঘরে ফিরতে রাত হয়। এনিয়ে চিন্তার যেন অন্ত ছিলো না পরিবারে। তারপর ঘর থেকে আর বের হয়নি সে। সারাফাত শুধু পড়ার টেবিলে কলমণ্ডখাতা নিয়ে সময় কাটায়। অলিক ভাবনায় মত্ত থাকে। সারাদিন কী যেন লিখে আর লিখে। দু-একটা কবিতাও লিখে। প্রতিবাদ কিংবা তারুণ্যের জয়গান। ওসব লেখা অবশ্য পরিবারের কারো কাছে গুরুত্ব পায় না।
পাশের বাড়ির মোবারক গাজী পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছে। এলাকার কোনো যুবক ঘর থেকে বের হয় কিনা সে খবর পাকিদের কাছে পৌঁছানোই তার দায়িত্ব। মাঝে মাঝে সারাফাতকে দেখে যায়। কথা বলে যুদ্ধ নিয়ে। সেদিন হঠাৎ ঘরে এসে হাজির মোবারক। সারাফাতের বাবা মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে। যুদ্ধ নিয়ে কথা বলে। তার সকল কথাই দেশ বিরুদ্ধ। পাকিস্তান তার দিল জুড়ে। যুদ্ধের আগে সারাফাতের বাবা আবিদ আলীর সাথে খুব সখ্য ছিলো মোবারক গাজীর। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দূরত্ব তৈরি হয়। একসাথে চা খাওয়া হয় না। বিকেলে রাস্তায় হাঁটা হয় না। যুদ্ধটা যেন ঘরে ঘরে। মনে মনে। বোন চায় না ভাই ঘরের বাইরে যাক। অথচ ভাই চায় যোদ্ধা হতে। স্ত্রী স্বামীকে হাত ছাড়া করতে চায় না। স্বামী চায় যুদ্ধে যেতে। মা সন্তানকে যুদ্ধে যেতে দেয় দেশ স্বাধীন হবে প্রবল ইচ্ছায়। কিন্তু মনের ভেতর যে দরদ আর মায়া গড়াগড়ি খায়। এই যে যুদ্ধে যাবার মানসিক দ্বন্দ্ব মনযুদ্ধ; এ যুদ্ধ কেউ দেখে না।
কথায় কথায় সারাফাতের রুমে ঢু মারে মোবারক। তিনি সারাফাতকে খুব সন্দেহ করেন। যদিও কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তাকে দৃষ্টির ভেতরেই রাখতে চায় মোবারক। রুমে প্রবেশ করেই বলে, কী করো বাজান?
সারাফাত দ্রুত খাতা কলম গুছিয়ে বলে, এইতো চাচা বসে আছি। ঘরে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। তাই কিছু পাড়ার চেষ্টা করছি। পড়ায়ও মন বসছে না।
-শুন বাজান। শেখ সাব হুদাই দেশে গ-গোল লাগাইছে। দেশ স্বাধীন হইলে না খাইয়া মানুষ মরবো। মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে আমাদের বিরোধ তৈরি করলো ভারত। তারা আমাদের মুসলিম ভাই রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ লাগাইছে। ঘর থেকে বাইর হইও না। তুমি অনেক ভালো পোলা। তোমার বাবায় জামায়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নাম পড়ে। এলাকার যুবক পোলাপান অনেকেই এলাকা থেকে পালাইছে। কই গেছে আমি সব জানি। যুদ্ধ কইরা দেশটারে উল্টায়া দিবো। দেখা যাইবো। তুমি বাজান ঘরেই থাক।
-চাচা, আর কয়দিন আমরা পরাধীন থাকমু? স্বাধীনতো হওয়া লাগবো। যেভাবে পাকবাহিনী মানুষ মারছে। ঘরে থাকবার মন চায় না। তবুও ঘরের বাইরে যাই না। জীবনেরও তো মায়া আছে। তাছাড়া আপনি কইছেন বাইরে যাইবার দরকার নাই। হের লাইগা যাই না।
-তুমি বুদ্ধিমান পোলা। ফাও ফাও জলে বাস কইরা কুমুরের লগে ঝগড়া করার কোন দরকার নাই।
-তো চাচা, দেশ কিন্তু স্বাধীন হইবো। আপনিও সাবধানে থাইকেন। আমি ঘরের বাইরে যাই না। কিন্তু মনটা সারাক্ষণ ঘরের বাইরেই পইরা থাকে।
-মন পাইরা থাক। তুমি ঘর থেকে বাইর হইও না। আবারও বইলা দিলাম। এলাকার পোলার ক্ষতি হোক আমি চাই না।
-ঠিক আছে চাচা। আপনিও সাবধানে থাইকেন। সময় খুব খারাপ। বলা যায় না কার কখন কী হয়?
কুশল বিনিময় করে ঘর থেকে বের হয় মোবারক গাজী। ঘরের বাইরে এসেই মুখ ভর্তি পানের পিক ফেলে। এ তো পিক নয় তাচ্ছিল্যের থুথু। কথার ফাঁকে সারাফাত পাকবাহিনীর অবস্থান জেনে নয়।
দ্রুত পড়ার টেবিলে বসে লিখতে বসে সারাফাত। জানালায় ক্ষণে ক্ষণে চোখ বুলায় সে। নির্দিষ্ট সময়ে লেখা চিরকুট ছুড়ে ফেলতে হবে। না হয় সুমন এসে ফেরত যাবে। চিরকুটে লেখা নিয়ে রাতে বাবা-মা বোনের সাথে আলাপ করে সারাফাত। পরদিনের ঘটনা আর রাতের কথা খাপাখাপ মিলে যায়। বেশ কিছুদিনই এমন আলাপ হয়। যা পরদিনে ঘটে যায়। এ নিয়ে ঘরের সবাই হতবাক। কিভাবে এসব জানে সে মাথায় ধরে না। বাবা মা চিন্তায় কাতর হয়। ছেলের এমন আজব চিন্তাশক্তি দেখে। কিন্তু এসব আলাপ করতেও সারাফাতকে বারণ করা হয়। কারণ দেয়ালেরও কান আছে। এমনিতে মোবারক গাজী এলাকায় যা শুরু করছে বলে দম নেয় আবিদ আলী। আগে একসাথে চলেছি-ফিরেছি বুঝতে পারি নাই। অবশ্য মানুষের মন কখন যে ভালো কিংবা হিংস্র হয় বলা মুশকিল।
সারাফত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে কষ্ট হয় মোবারক গাজীর। দেরি হলেও বিষয়টি টের পায় সে। প্রতিদিন একটি ছেলে আবিদ আলীর বাড়ির কাছে আসে জেনে যায় মোবারক। আর সে খবর মুহূর্তেই খবর পৌঁছে যায় পাকবাহিনীর কাছে। ততদিনে মোবারক গাজীর নামও মুক্তিবাহিনীর ব্লাক উঠে আসে। সুযোগ বুঝে যেকোনো সময় মোবারক গাজীকে তুলে নেয়া হবে। কিন্তু তার আগেই সারাফাতের বাড়িতে হানা দেয় পাকবাহিনী। ঘরের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে একদল দস্যু। প্রথমেই শারাফাত ও আবিদ আলীকে আটক করে। মা এবং বোনকে আলাদা রুমে নিয়ে যায় দস্যুর দল। সে রুম থেকে আর জীবিত ফেরেনি তারা। বাবা-ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। আবিদ আলী কোন তথ্য দিতে পারেনি। তাই সেদিনই মেরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হলো লাশ। কৌশল এবং তথ্যগত কারণে সারাফাতকে আটক রাখা হলো। জানতে চায়, কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, কিভাবে তারা তথ্য পায়?
সারাফাত মুখ খোলে না। সে শুধু একই কথা বলে, যুদ্ধের সময় ঘরেই ছিলাম। বাইরে যাইনি। আমি চিনি না মুক্তি কারা। কিন্তু কোনভাবেই হায়নার দল বিশ্বাস করে না। কোনো তথ্য না পেয়ে তাকে একটি রুমে বন্দী রাখে। রাতে ঘোর অন্ধকার। দিনে ফাঁক বেয়ে একটু আলো নামে। সে দিয়েই সারাফাত বুঝতে পারে দিন হয়েছে। যে আলো আঁধার ঘরে নেমেছে তেমনি পুরো দেশ জুড়ে নিশ্চয় আলো নামবে। সময়টা আর বেশি নেই। কিন্তু সারাফাতের সময় যে কাটে না। চোখের সামনে ভেসে উঠে মা বোন বাবার মুখ। প্রিয় শৈশব। উড়ন্ত স্কুল জীবন। এখন নিজে মৃত প্রায়। কিভাবে মুক্তি মিলবে বদ্ধ রুম থেকে উপায় খুঁজে পায় না। তবে সারাফাতের কান উৎসবের মৃদৃ আওয়াজ পায়। কানে বাজে বিজয়ের ধ্বনি। মনে খেলে যায় বিজয়ের সুর। জয় বাংলা বাংলার জয়। ক্ষতবিক্ষত বাংলা স্বপ্ন উড়ায়। নির্জিব শরীর অপেক্ষা করে মুক্তির। একদিন সকালে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ আসে কানে। ধীরে ধীরে সে আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যায়।
মোবারক গাজীকে মুক্তিবাহিনী ধরতে পেরেছে। সে তথ্য পাচার করেছে বাহিনীদের কাছে। যুদ্ধের শেষ সময়ে এসে হিন্দু বাড়িতে করেছে লুটপাট অগ্নিসংযোগ। তার হাতে কত মায়ের ইজ্জত গেছে হিসেব নেই। কত মায়ের যুবক সন্তান হারিয়েছে তারও হিসেব নেই। মানুষের অভিশাপ আর অভিযোগে জর্জরিত মোবারক এখন মুক্তিবাহিনীর কব্জায়। এমন খবরে যে মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি খুশি হতো তারা বেঁচে নেই। নিশ্চয়ই শহীদ আত্মারা তৃপ্তির ঢেকুর গিয়েছেন।
যুদ্ধ শেষ। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলো। সারাদেশে উৎসবের আমেজ। এলাকাভিত্তিক স্বাধীনতার ঘোষণা আসছে। দেশ স্বাধীন অথচ বদ্ধ ঘরে সারাফাত অচেতন। না খেয়ে কঙ্কালসার প্রাণ যায় যায়। ঘরের তালা ভেঙে যখন সারাফাতকে উদ্ধার করা হলো দেহে প্রাণ নেই। শুধু কঙ্কালসার দেহ সাক্ষী দেয় একটি পাতাকা একটি স্বাধীন দেশ।