প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
আবিদের চাচাতো ভাই শুভ ইতালি থাকে ওর মা-বাবার কাছে। ওখানে তার জন্মস্থান। শুভর বয়স সাত বছর। ওখানে সে শহরের একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আর আবিদ বাংলাদেশের একটি গ্রামের স্কুলে একই শ্রেণীর ছাত্র। বয়সের দিক থেকেও প্রায় একই। কখনো শুভ বাংলাদেশে আসে নাই কিন্তু ও বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে। ইতালির বাঙালি পাড়ায় ওদের বসবাস। সেখানে অনেক বাঙালি বসবাস করে। তার বাবা-মাসহ পূর্ব পুরুষদের বসতভিটা বাংলাদেশে। শুভ বিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে মাকে বললো মা, আমার শ্রেণি শিক্ষক বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলতে বলছে। মা তোমরা তো বাংলাদেশ ঘুরেছো আমিতো জীবনে একবারো যাইনি। আমি স্যারকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারি নাই। মা বলল ঠিক আছে শুভ। এপ্রিল মাসের ছুটিতে আমরা বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িতে যাব। শুভ বলল ঠিক আছে মা,আমি আবিদ ভাইয়ের সাথে সময় কাটাবো। আবিদ শুভর চাচাতো ভাই। আবিদকে শুভ সরাসরি না দেখলেও মোবাইলে ইতালি থেকে অনেক কথা বলেছে। মার্চ মাস শেষের দিকে। দিনে দিনে শুভর মনে কত আশা যোগ হতে থাকে। এখন পর্যন্ত সে বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের আলো-বাতাস দেখেনি। দাদা-দাদী, নানা-নানী আরো কত আত্মীয়-স্বজন আছে। মা-বাবার কাছে শুনেছি তাদের কথা। চক্ষু মেলিয়া তাদের কাউকেই শুভর দেখা হয়নি। এপ্রিল মাস এসে গেল। আগামীদিন থেকে শুভর স্কুল পনের দিন ছুটি থাকবে। শুভ কেবলমাত্র স্কুল থেকে ফিরছে। এর মধ্যে বাবা এসে বলল শুভ একটা সুখবর আছে। শুভর মা বুঝতে পেরেছে তাই মিটমিট করে হাসছিল। শুভ বলল বাবা তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।
বাবা বলল হ্যাঁ অবশ্যই বলবো। শোনো শুভ, আমরা আগামীদিন প্রিয় বাংলাদেশে বেড়াতে যাব। খুশিতে শুভ বিছানার উপর গড়াগড়ি খেতে লাগল। আব্বু তুমি কি সত্যি বলছো? বাবা বলল হ্যাঁ শুভ। আগামী দিন তুমি, আমি, তোমার মা আমরা তিনজন বাংলাদেশে যাব। সকাল নয়টায় আমাদের ফ্লাইট। শুভদের বাসা থেকে খুব কাছেই বিমানবন্দর। বাবা শুভর মাকে বলল আমাদের সকাল আটটায় অবশ্যই বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে। শুভ খবর শুনে মহাখুশি। আজকে রাতে শুভ মাকে বলল মাগো তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। শুভর কথামত মা শুভকে খাবার দিলো। শুভ খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। শুভর বাবা-মা কাপড় চোপড় গুছিয়ে ব্যাগ ভরল। সবাই ঘুমিয়ে গেল। শুভ কতক্ষণ পর উঠে উঠে ঘড়ি দেখত লাগল। কখন সকাল হবে? বাহিরে আলো দেখতে পেয়ে শুভ বুঝতে পারল সকাল হয়েছে। বাহিরে বাবার কথার আওয়াজ টের পেয়ে শুভ ঘুম থেকে জাগলো। মা বলল কিছু খেয়ে নাও শুভ। শুভর সাথে বাবা-মাও খেয়ে নিল। শুভর মা শুভকে ভালো কাপড় পড়তে বলল। শুভ তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেল। চোখে মুখে তার আনন্দের ছাপ। বাবা মা রেডি হয়ে সবাই বিমানবন্দরের দিক এগাতে লাগলো। বাসা থেকে কিছু দূরেই বিমান বন্দর। কিছুক্ষণ পরেই শুভরা বিমান বন্দরে এসে পৌঁছল। শুভ ভাবতে লাগল কখন বাংলাদেশে যাবে। আবিদের সাথে দেখা করতে পারবে, দাদা-দাদী, নানা-নানী তাদেরকে দেখতে পারবে। এর মধ্যেই বিমানে লোক উঠতে বলল। শুভ বাবা-মায়ের হাত ধরে বিমানে উঠে গেল। ভিতরে সবাই আসন গ্রহণ করল। কতক্ষণ পরে ঠিক সকাল নয়টায় বিমান বাংলাদেশের দিকে উড়াল দিল। কয়েক ঘণ্টা পর বিমান বাংলাদেশের একটি এয়ারপোর্টে পৌঁছল। নিরাপদে শুভ, শুভর বাবা-মা বিমান থেকে নামল। এবার তারা বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে বাহিরে আসলো। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে সবাই কিছু খাবার খেয়ে নিল। খাবার খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে শুভ বাবা-মায়ের সাথে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলল। শুভর বাবা গাড়ি খোঁজ করতে লাগল। শুভ এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
এতদিন ধরে বুকে লালন করা বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু হতে চলছে। শুভ বলল বাবা, এই কি আমাদের গ্রামের বাড়ি? বাবা হাসি দিয়ে বলল না পাগল এখনো অনেক দূরে গ্রাম। কিছুক্ষণ পর বাবা বলল ওই একটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে ওই গাড়িতে করে আমরা গ্রামে যাব। মা বলল সাবধান শুভ! রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করবে না। চলো আমরা গাড়িতে উঠি। সকলে গাড়িতে উঠল। অনেক পথ। গাড়ি চলতে লাগল। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসল। শুভ বলল মা আর কতক্ষণ লাগবে গ্রামে পৌঁছতে? মা বলল আর মাত্র ঘণ্টাখানেক পথ। মায়ের গল্প শুনতে শুনতে গাড়ি স্টেশনে পৌঁছল। বাবা বলল শুভ এখন নামতে হবে। মা-বাবার হাত ধরে শুভ গাড়ি থেকে নামল। শুভ বলল বাবা আর কত পথ? বাবা বলল এইতো বাবা, ওই রিকশায় করে আমাদের বাড়িতে যাওয়া যাবে। বাবা একটা রিকশা ডাক দিল। সবাই রিকশায় উঠল। বিশ মিনিট পর রিকশা থামল। শুভ, শুভর বাবা, মা রিকশা থেকে নামল। বাবা বলল শুভ আর পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে। সবাই মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের বাড়ির দরজা দেখতে পেল। মা বলল দেখো শুভ। এইটা আমাদের বাড়ির দরজা। দরজার কাছেই চাচাতো ভাই আবিদ, শুভর দাদা-দাদী, নানা-নানী আর অনেক আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত। সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। শুভকে সবাই কোলে তুলে নিল। শুভ কাউকে চিনতে পারল না। কেমন জানি সব অচেনা মনে হলো। কারণ শুভ জন্মগ্রহণ করেছে ইতালিতে। সে এই প্রথম বাবা-মায়ের সাথে দাদা বাড়ি বেড়াতে এসেছে। শুভর দাদি সবার সামনে খাবার দিল। শুভ রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত অনেক হয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। দু-তিনদিনের মধ্যে শুভ সবার সাথে সখ্য গড়ে তুলল। একদিন সকালে আবিদ তার কাজিন শুভকে ডাক দিল। আবিদ বলল চলো শুভ আমরা পাঠশালায় যাই। শুভ হাত মুখ ধুয়ে আবিদের সাথে চলে গেলো। গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে হেঁটে তারা পাঠশালায় গেল। খুবই ভালো লাগলো শুভর। পাঠশালা থেকে ফিরে আসতে আবিদ শুভকে ধানক্ষেত দেখাল। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে শুভ বেজায় খুশি। বলল আবিদ,আমি কখনো এরকম সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারিনাই। বিকেল হলে আবিদ শুভকে নিয়ে খেলার মাঠে ঘুড়ি উড়ায়। শুভকে আর কে পায়। রাখাল ভাইয়ের সাথে আবিদ ও শুভর ভালোই আড্ডা জমে রোজ। প্রভাত হলে আবিদ শুভকে নিয়ে বকুল গাছের নিচে ফুল কুড়ায়। ফুলের মালা গাঁথে। কখনো কখনো কুয়াশার ভিতর মেঠোপথে হারিয়ে যায়। আবিদ একদিন শুভকে বলল শোনো আবিদ ইতালির শহরে ছিলাম। এমন সৌন্দর্য্য দেখিনি কভু। গ্রামের এমন সৌন্দর্য্য উপভোগ করে আমি বিমোহিত। আবিদ একদিন বিলে শুভকে নিয়ে শাপলা তুলতে ছুটে গেল। শুভর মুখে হাসি আর হাসি। কতই না আনন্দ! কি অপরূপ বাংলাদেশ! আবিদ ফুলবাগানে নিয়ে গেল শুভকে। প্রজাপতি নেচে নেচে খেলা করছে। আবিদ শুভকে মৌমাছি দেখিয়ে দিলো। পাখিরা আনন্দে গান করছে। আবিদ বলল শুভ তোমার কেমন লাগছে? শুভ বলল বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি আবিদ। আবিদ মুচকি হেসে দিল। শুভ বলল ঘরে যেতে আমার মন চাইছে না আর। মনে হয় প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাই আবিদ। আবিদের সাথে শুভ ঘাসবনে গিয়ে ফড়িং দেখে সময় কাটায়। বাবা একদিন আবিদকে গ্রামের হাঁটে নিয়ে গেল। হাঁটে বাবার সাথে শুভর ভালোই সময় কাটছে। বাবা শুভকে অনেক খেলনা কিনে দিল। গ্রামের বাজারে মনকাড়া খাবার খেয়ে শুভ খুব তৃপ্তি পেয়েছে। বাবাকে বলল বাবা আমি এই দেশ এই গ্রাম ভালোবাসি। বাবা বলল এটা আমাদের অনেক প্রিয় দেশ। এটা আমাদের জন্মভূমি। এদিকে চাচাতো ভাই আবিদ শুভকে নিয়ে নদীর কাছে যায়।পাল তোলা নৌকা দেখে শুভ অবাক হয়। জেলেদের মাছ ধরা নৌকা দেখে আবিদ বলল ওই দেখো শুভ জেলে ভাই মাছ ধরছে।
জোৎস্না রাতে পুকুর ঘাঁটে পরিবারের সবাই একসাথে গল্প করে। হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে শুভ পাগল হয়ে যায়। রাতে শুভ দাদুর কাছে মজার গল্প শুনে। ফুলবনে জোনাকির আড্ডা দেখে শুভর মন দিশেহারা। আবিদ বলল শুভ শোনো এই দেশে ছয়টি ঋতু আছে। একেক ঋতুতে একেক সৌন্দর্য্য। আবিদ গাছ থেকে পেয়ারা পেরে খায়। ঢিল মেরে কাঁচা আম খায়। আরো কত ফল। শুভ ফলের সব নাম জানেনা। আবিদ সব পরিচয় করিয়ে দেয়। দখিনা বাতাসে ধানের মিষ্টি গন্ধ পেয়ে শুভ মনের মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পায়। কয়েকদিন বেড়ানোর পর একদিন বাবা বলল শুভ আগামী পরশু আমাদের ইতালি যেতে হবে। খবর শুনে শুভর মন খারাপ হয়ে গেল। শুভ বলল বাবা আমি আর বিদেশ যাবনা। ইট-পাথরের ভিতর বাস করা আমার আর ভালো লাগে না। এই বলে সে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। আমার এই দেশ বাবা অনেক ভালো লাগে। আমি এই দেশেই থাকতে চাই। এ দেশের ফুল-ফসলের মাঠ ছেড়ে আমি ইতালি কিছুতেই যাবনা। কান্না শুনে বাবার চোখেও পানি এসে গেল। কতক্ষণ ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিল আর বলল কেউই ইতালি যাবনা শুভ। এখন থেকে এই গ্রামেই থাকব। শুভর মা খবর শুনে সেও খুশি হলো। বাড়ির সবাই অনেক খুশি হলো। শুভকে আবিদের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। শুভর মনে আনন্দের জোয়ার। মুয়াজ্জিনের মধুর আজানের সুরে শুভর প্রতিদিন ঘুম ভাঙে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে শুভর মন জুড়িয়ে যায়। পুকুরের তাজা মাছ আর ক্ষেতের তাজা শাক-সবজি শুভর অনেক প্রিয়। শুভর আর বিদেশ যাওয়া হলোনা। বাংলার সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হয়ে এই দেশকেই সে বন্ধু বানিয়ে নিল।