মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

অপেক্ষা
অনলাইন ডেস্ক

আঁধার কেটে গেছে। পুব আকাশে সোনালি আলোর প্রথম হাতছানি। ফাতেমা বিবি কেরোসিনের প্রদীপ হাতে হিজল গাছটার তলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। জায়গাটা তার চিরচেনা গাছের কোটরে একজোড়া চড়ুই নীড় বেঁধেছে। বাতাসে কচি পাতার মিষ্টি গন্ধ। বাড়ির পাশের রাস্তায় অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। তাকে বিচলিত করে। সব কিছু নতুন লাগে। বুঝে উঠতে পারে না কি ঘটছে তার সেই চিরচেনা জগতে। পড়শীরা এক এক করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো নিজেদের কর্মস্থলে। সাত বছরের ছেলে জিতু ধীর পায়ে কাছে এসে হাতটা চেপে ধরে বললো, মা, বাড়ি চলো। বড় আব্বু আজ আসবে না। আরেকদিন-

পারভেজ, রাকিব, তৌহিদসহ বাকিরা বসে আছে মেহেদী চাচার দোকানে। প্রতিদিন এখানে চায়ের কাপে আড্ডা হয়। চাচা পুরানো রেডিওটা নাড়া-চাড়া করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ধরার চেষ্টা করছেন। এমন সময় মনসুর গাজী এসে হাজির।

মনসুর কাপড়ের ব্যাবসায় অল্প বয়সে প্রচুর টাকাণ্ডকড়ি কামিয়েছিল। কিন্ত রাজনীতিতে জড়িয়ে এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে। মিটিং-মিছিল করে বহুবার জেল খেটেছে। শত আঘাতেও নিজের আদর্শ থেকে সরে যায় নি। কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে ছুটে যায়। ছোট-বড় সকলে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।

ঐখানে কারা রে? জোরে হাক ডাকতেই নড়েচড়ে বসলো। দেখে স্থানীয় চেয়ারম্যান বাহা উদ্দিন অফিসার গোছের একজনকে সাথে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে যাচ্ছে। চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপা। কাঁধে প্রচুর দায়িত্ব। এলাকায় তার যথেষ্ট প্রতাপ। সবাই খুব সমীহ করে চলে।

কাছাকাছি আসতেই ধমকের স্বরে বললো, তোরা এখানে কী করছ? সহজ-সরল ভঙ্গিতে তৌহিদ উত্তর দিলো, এমনে-ই বইয়্যা আছি।

তৌহিদ বয়সে সবার চেয়ে ছোট। বাবা কৃষি কাজ করে। অভাব নিত্যসঙ্গী। স্কুলের পাঠ চুকানোর আগেই সংসারের কাজে লেগে গেছে। সারাদিন বাড়িতে থাকে। ঝুট-ঝামেলা গায়ে মাখতে চায় না।

যা, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। দেশের অবস্থা ভালো না। খারাপ মানুষে দেশ ভইরা গেছে। কিছু লাফাঙ্গা পোলাপাইন গ-গোল লাগাইতে চাইতাছে। এগুলারে শায়েস্তা করতে হইবো।

চেয়ারম্যান সাহেব দৃষ্টির সীমা পেরুতেই পারভেজ জোরেশোরে বললো, শালায় একটা শুয়োরের বাচ্চা। গতকাল রাতে নাকি মিলিটারি আইন্যা পাশের গ্রামের জেলেপাড়ায় আগুন লাগাইয়া দিছে। সকালবেলা দেখলাম মৃত্যুঞ্জয় কাক বউ পোলাপান লইয়া কাঁদতে কাঁদতে পাশের দেশ ভারত চইলা যাইতাছে। দেখে খুব মায়া লাগলো।

পারভেজ রগচটা স্বভাবের। যৌবনের পূর্ণ জোয়ার শরীরে। কাউকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। খেয়ালে যা আসে, তাই করে। গ্রামে ঘটা প্রতিটি অনাকাঙ্গিত ঘটনায় ওর নাম সবার আগে শোনা যায়।

দোকানের পেছনে পরিত্যক্ত জমিতে বসে কাউসার ঘাস কাটতেছিল। ওদের দিকে এগিয়ে আসতেই পালোয়ান রাকিব মরতে ত্যারে গেলো। কিন্তু মারল না। এটা হয়তো ওর প্রতি করুণা। দু-চারটা ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল। সহজ-সরল বোকা ধাচের হওয়ায় সবসময় পাড়ার ছেলেদের ঠ্যাঙানি খায়। কাউকে কিছু বলার সাহস নেই। কাছে গেলে অবলার মতো হা করে তাকিয়ে তাকে।

সদ্য বিবাহিতা ফাতেমা বিবি স্বামীর মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বিয়ের দিন আঁকা হাতের আল্পনাগুলো এখনো মলিন হয়ে যায়নি। দেখতে শ্যামবর্ণের। মাঝারি গড়ন। শাড়ি পরতে পছন্দ করে। লাজুক চোখ দুটো প্রতিনিয়ত গল্প বলে। স্নিগ্ধ চেহারার নিষ্পাপ চাহনি মুগ্ধতা ছড়ায়। আপাদমস্তক পরিপাটি। কবিতার মতো সুন্দর। আজকাল মনসুরের সেদিকে দৃষ্টি নেই।

লিটন গতকাল রাতে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ও বুদ্ধিমান। শৈশবের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলে। মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। ছুটিতে বাড়ি এলে, সবার সাথে দেখা করে যায়। কুশলাদি বিনময় করে। কিন্তু এবার আসার কারণটা ভিন্ন। কিছুদিন আগে ওদের ছাত্রাবাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। যাকে যেখানে পেয়েছে হত্যা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সেখানে এখন মিলিটারি ক্যাম্প। অনেক শিক্ষককে ধরে নিয়ে গেছে জানোয়ারের মতো টেনেহিঁচড়ে। কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। বাতাসে লাশের গন্ধ। মাংসের খোঁজে মানুষরূপী হায়নার দল। যে যেভাবে পারছে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

মেহেদী চাচা মুখে পান’টা গুজে লিটনকে লক্ষ্য করে বললেন, হুনলাম, আমগো লিডাররে নাকি ধইরা লইয়া গেছে?

-জ্বী। তবে যাওয়ার আগে ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা স্বাধীন।

মনসুর বললো, গতকাল সন্ধ্যায় বাজার মাঠে ‘শান্তি কমিটির’ মিটিং হইছে। চেয়ারম্যান সাহেব এই কমিটির সভাপতি। সকালবেলা দেখা হইছিল। বললেন, রাতে থানা থেকে অস্ত্র চুরি হইছে। এ নিয়ে খুব ঝামেলা যাচ্ছে। গ্রামে যেকোনো সময় মিলিটারি হানা দিতে পারে।

সবুজ বির বির করে গান বাঁধার চেষ্টা করছে। সে কবি। সুরস্রষ্টা। হৃদয়ে শব্দের চাষ করে। পাথরে ফুল ফোটায়, মরুর বুকে ঝড় তোলে। কাষ্ঠ মূর্তির চোখ উন্মীলন করে, বোবা বুকে ভাষা দেয়। আগের সব সুর হারিয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নতুন একটা গান।

কাউসার প্রতিদিনের মতো আজও এক কদম সামনে আসতে চেয়ে ভয়ে আবার দু’কদম পিছিয়ে গেলো।

তখন গভীর রাত। মনসুরের স্পর্শে ফাতেমা বিবির ঘুম ভাঙলো। তার শান্ত সমাহিত সম্মোহনী চোখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এর আগে স্বামীকে এতটা আপন করে পায়নি। ব্যাকুলতা প্রকাশ করতেই মনসুর বললো, বউ, দেশে যুদ্ধ শুরু হইছে। আমার যাওন লাগবো।

ফাতেমা বিবি গ্রামের মেয়ে। বাইরের জগৎ অজানা। স্বাধীনতা কী জানে না, যুদ্ধ কী বোঝে না। শুধু জানে, এ দেশকে তার স্বামী প্রাণের অধিক ভালোবাসে।

উঠোনে কিছু একটা পড়ার শব্দ। উৎকণ্ঠিত হয়ে মনসুর বললো, কে ওখানে? বাহির থেকে আওয়াজ আসলো, ভাই, আমি কাউসার।

ওকে অন্যরকম লাগছে। চেহারায় আর সেই সরলতা নেই। সাপের মতো ফুসছে। তাকানো যাচ্ছে না। ভয় ধরানো চাহনি। চোখ দুটো রক্তবর্ণের, যেনো জলন্ত আগ্নেয়গিরি।

বাইরে তাকিয়ে দেখে ঘাসের ঝুড়িটার পাশে মিলন দাঁড়িয়ে আছে। মিলন চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র ছেলে। মনসুর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোরা এতো রাতে আমার বাড়িতে কেনো আসছস?

হুনছিলেন না গত সপ্তাহে থানা থিকা অস্ত্র চুরি হইছিল, ঐগুলো আমরা চুরি করছি। আমি আমনেগো সব পরিকল্পনা আগে থিকাই টের পাইছি। খালি সুযোগ খুঁজছি কবে রওনা দিবেন।

এগুলো এতদিন কোথায় ছিল?

মিলনের আব্বার কাছে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। উনিই আমাগো পথ দেখাইয়া থানার ভিতর লইয়া গেছিলেন।

মিলন বাহির থেকে বললো, ভাই তাড়া-তাড়ি চলেন। আসার সময় দেখে এসেছি মেহেদী চাচা সবাইকে নিয়ে ছাড়া বাড়ির জঙ্গলে বসে আছেন। রাত ফুরিয়ে এলো। আব্বায় কইছে রক্ত দিতে হইবো। দেশ স্বাধীন করার আগে আমি না, আমার লাশ যেনো বাড়িতে ফিরে।

ভরা পূর্ণিমা। ফাতেমা বিবির চোখের কোনে জল জমতে শুরু করেছে। তাতে একটা ঢেউ খেলানো মুক্তার ঝিলিক। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন। শক্তি নেই স্বামীকে আটকানোর কিন্তু অধিকার আছে জানার। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, আমনে আবার কবে আইবেন?

মুনসুর কানের কাছে মাথা ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বললো, দিনে আসা যাবে না। গভীর রাতে চুপিসারে আসবো। এইখানে এই হিজল গাছটার তলে। এসে দেখা করে যাবো।

গ্রাম লেগেছে শহরের ছোঁয়া। চারদিকে আলোকসজ্জা। ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ উপলক্ষে আজ ‘শিল্পকলা একাডেমি’তে গান গাইবেন সবুজ বর্মণ। যুদ্ধের সেই বিভীষিকায় তার জাগরণী গান সবার মনে সাহস জুগিয়েছিল। উৎসাহিত কারেছে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হতে। তার যুদ্ধটা শেষ হয়নি। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটায় কাউসার বসে। কাজ করার শক্তি নেই। রণাঙ্গনে এক পা উড়ে গেছে গোলার আঘাতে। গাঁয়ের যে মেঠো পথে বাইফেল কাঁধে দ্বীপ্ত পায়ে একদিন মনসুর সাথীদের নিয়ে শহরের দিকে ছুটে গিয়েছিল, সেখানে এখন মোটরযান চলে। বাড়ির সামনের গাছটায় ফুল ফুটেছে। জিতু মনসুরের ছোট ভাইয়ের ছেলে।

ফাতেমা বিবি এখন অন্ধ। স্বামীর পথ চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টি শক্তি হােিয়ছে বহু বছর আগে। প্রদীপ হাতে প্রতি রাতে ছুটে আসে হিজল গাছটার নিচে। শূন্যে চেয়ে থাকে। চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রিয় মানুষটির ফেরার অপেক্ষা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়