প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হঠাৎ করে শুভ বাড়ি এসেছে। গত রাতে যখন বাড়ি আসে কেউ টের পায়নি। শুভ বিকেলে নিপুদের বাড়িতে আসে। নিপুকে বাড়িতেই পাওয়া গেলো। সাধারণ কথা-বার্তা শেষে নিপু কেটে পড়তে চায়। শুভ বন্ধুকে গুরুত্ব দিয়েই ছুটে এসেছে। নুপুরের ঘটনার পর থেকেই নিপু ও শুভর মাঝে বন্ধুত্বে যেন ভাঙ্গন ধরেছে।
মুঠোফোনেও কথা বলা হয় না। আগে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে কথা হতো। নুপুরের মুত্যুর পর নিপু ফেসবুক থেকে ইনঅ্যাকটিভ হয়ে গেছে। অথচ শহরের উঠতি বয়সের সব ছেলে-মেয়ে ফেসবুক চালায়। গ্রামে এখনো এর প্রভাব শতভাগ পড়েনি। যেটুকু পড়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। তবে প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরাও অনেক আধুনিক হয়েছে। বিশেষ করে যারা কলেজ ছাত্র। অবশ্য যারা গ্রাম থেকে একটু শহরমুখি ওসব শিক্ষার্থীতো সময়ের চেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে। শান্তিপুর গ্রামে এখনো অনেক ছেলে-মেয়ে আছে, যারা বর্তমান সময়ের প্রায় সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। যদিও এখনো অনেক ছেলেপুলে আছে যারা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপি, ইমো চালায়। আর অন্যান্য গ্রামে তো প্রতিটি প্রবাসীর পরিবারে ইমো এখন কমন বিষয়। যদিও নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো গ্রামে এখনো সে মানের সেবা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগের এ যুগে প্রকৃত পক্ষে কোনো বন্ধুত্বই খুব বেশি সময় নিচ্ছে না। আজ সম্পর্ক হচ্ছে তো কাল ভাঙছে। কেউ কেউ এটাকে পুরানো বন্ধুকে খুঁজে পাবার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। যতো কিছুই হোক সময়ের কারণে একসময় বন্ধুত্বে দূরত্ব তৈরি হবেই। এর উল্লেখযোগ্য কারণ থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। মূলত বন্ধুত্ব স্কুল পর্যায় পর্যন্ত অথবা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ালেও কর্মজীবনে তা আর দীর্ঘ হয় না। সম্পর্ক কোনো মতে লেগে থাকলেও পুরানো সেই গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সময়ের দাবিতেই এমনটা হয়। এ নিয়ে মানুষ আফসোস করে কার্যত কিছু করার থাকে না। নিপু শুভর সাথে খুব বেশি মিশতে চাইলো না। তারপরেও শুভ জানতে চায়, নুপুরের ঘটনার কোনো ক্লু বের করতে পারলো পুলিশ?
- আমাকে নিয়ে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শোলকাকেও করেছে। তারপর কী হয়েছে জানা নাই। তবে শোলকা মাঝে মাঝে থানায় গিয়ে ওসির সাথে দেখা করে কথা বলে আসে। কী কথা হয় তা আমাকে তা না বললেও সুনেছি ওসির সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক হয়েছে। ওসি তাকে আশ্বস্থ করে, ‘ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি চিন্তা করো না। তোমার কিছু হবে না’ ।
- কিন্তু নুপুরকে হত্যার ঘটনায় কিছু না কিছু হওয়া উচিত ছিলো।
- কী বলবো দোস্তা পুলিশ আমাকেই ঝামেলায় ফেলতে চেয়েছে। কিছু টাকা দিয়ে কোনো মতে রক্ষা পেয়েছি।
- আমি যেদিন ঢাকা গেলাম। সেদিনই আমাকে নাকি থানায় যেতে বলেছিলো। আমি যেতাম। কিন্তু আমি আগে না জানায় চলে গেছি। আমি নুপুরকে ভালোবাসি। বাসবো। কিন্তু তার জন্যে আমার কিছু না কিছু করতে হবেই। পুলিশ যদি এখনো আমার কোনো সহযোগিতা চায় আমি অবশ্যই করবো।
- থাক! দোস্ত। এটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আবার বাড়াবাড়ি করার দরকার কী? শোলকা বিষয়টা খুব ঠান্ডা মাথায় হেন্ডেলিং করছে। আমাকেও এখন খুব বেশি বিরক্ত করে না। প্রথম প্রথম খুব সমস্যায় ফেলেছিলো।
- তো আাসি রে। ভালো থাকিস। আমাকে থানায় ডাকাডাকি করে শুনে অল্প কয়েক মাসের মাথায় আবার দেশে এসেছে বাবা। আমি প্রায় তিনমাস পর বাড়িতে এসেছি। তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু দেখা করে যাই।
- আচ্ছা। ওসব নিয়ে আর বাহিরে কোনো কথা বলার দরকার নাই।
তারপর শুভ বাড়ি চলে আসে। এখন আর রাস্তায় খুব একটা সময় কাটায় না। এলাকাটা কেমন যেন আলগা আলগা মনে হয়। মানুষগুলোও কেমন যেন ভিন্ন চেহারার। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ি এসে মা-বাবার সাথে কথা বলে শুভ।
শুভর বাবা ফজুলল হকও একজন নিরেট ভদ্র মানুষ। দীর্ঘদিন প্রবাসে জীবন কাটছে। পয়সাও বেশ ভালোই কামিয়েছে। গ্রামে ভালোই সম্পত্তি কিনেছে। এলাকার যে কেউ জমি বিক্রি করলেই আগে ফজলুল হকের কাছে আসে। তিনি বিদেশে থাকলে শুভর মায়ের সাথে যোগাযোগ করে। শুভর মা ফজলুল হকের সাথে আলাপ আলোচনা করে জমি কেনার সব প্রস্তুতি নেয়। এভাবে অন্তত দুই একর জমি কিনেছেন ফজলুল হক। বিষয়গুলো ইতোমধ্যে জেনেছে পুলিশ। পুলিশ এতোদিন এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। কারণ পুলিশ কোনো টাকাওয়ালা পেলেই তাকে পেয়ে বসে। অবশ্য শুধু পুলিশ নয় বর্তমান সমাজচিত্রই এমন। কেউ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেই অনেকে এসে হাত পেতে দেন।
ওসি শোলকাকে বলে রেখেছিলো শুভ বা শুভর বাবা এলাকায় আসলেই জেনো তাকে জানানো হয়। যেই কথা সেই কাজ। শোলকা ওসিকে শুভর আগমনের খবর জানিয়ে দেয়। রাতেই পুলিশ এসে হাজির শুভদের বাড়ি। শুভকে ধরে নিয়ে যায়। কাল সকালে থানায় গিয়ে ওসি মহোদয়ের সাথে দেখা করবেন। নিপুর বাবাকে দেখা করতে বলে যায় ওয়ারেন্ট অফিসার।
শুভর মা অনেক কান্নাকাটি করেও ছেলেকে রাখতে পারেনি। ঘটনার পরপরই শুভকে থানায় ডাকা হলেও ওসির রুমেই তাকে বসতে দেয়া হতো। কিন্তু কিছু সময় পর লকাপে রাখা হয়। যেখানে অপরাধীদের প্রাথমিকভাবে আটক করে রাখা হয়। ওই রুমে বিশ্রি গন্ধ্য। বসা যায় না। মশার উপদ্রব। এমন পরিবেশে কখনো শুভ থাকেনি। শুভ কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে পুলিশ তাকে ধরে আনবে কেন? অবশ্য ধরার সময় মামলার আইও বলেছিলো, যখন থানা ভালোয় ভালোয় যেতে বলা হলো তখনতো গেলি না। থানায় না গিয়ে ঢাকা গিয়ে পালিয়েছ। এবার দেখি তোর কোন বাবায় তোকে ছুটায়। এসব কথা মনে করতেই শুভ ভাবে, আমাকে এ মামলায় এতো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন কী? তাছাড়া আমিতো নিরপরাধ। আমি শুধু নুপুরকে ভালোবেসেছি। ভালোবেসেছি বলে কী হয়েছে? অথচ অঙ্কুরেই ঝরে গেছে আমার স্বপ্ন। এখন ঝরা স্বপ্নই যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লকাপে একটা ওলকা বিছানো ছিলো। সেখানেই বসে আছে শুভ। রাতেই ছুটে আসে বাবা ফজলুল হক। ভেতরে একটা পানির বোতল আর মশার কয়েল দেন। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটা কাঁথা দিলে ওলকার উপর বিছিয়ে বসে থাকে শুভ। গত তিনমাসে নুপুরকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। কিন্তু এখন খুব বেশি মনে পড়ছে তাকে। একটা মেয়ে কারো জীবনে কতোটা বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে তা বলা কঠিন। যদিও নুপুরকে কোনো প্রকার দোষ দিতে রাজি নয় শুভ। এখানে নুপুরের কি করার আছে? সেতো চলেই গেছে। অথচ আমি কিছু না থাকার মাঝে একবুক শূন্যতা নিয়ে বেঁচে আছি। শূন্যতা তবু ভালো। কিন্তু এই হয়রানি কেন? জানি না পুলিশ কী করে? কী আছে ভবিষ্যতে বলা মুশকিল। এক অনিশ্চিত আগামী আমার সামনে দণ্ডায়মান। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]
* লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]