প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সময়ের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ এবং বাংলা কাব্য জগতে এক নতুন ধারার স্রষ্টা। এই নতুনত্ব বাংলা সাহিত্যের পরিধিতে এনেছে নতুন এক ব্যঞ্জনা ও অলঙ্কার। যে মানুষটির হাত ধরে বাংলা কবিতা পেয়েছে নতুন এক মাত্রা, নতুন গতি এবং পথ। বাংলা সাহিত্যে কবিতা হয়ে উঠেছে দেদীপ্যমান এক আলোরশ্মি। কবিতা খুঁজে পেয়েছে নতুন এক দিগন্ত। তার কবিত্বের প্রকাশ কাব্য চয়নের মুর্ছনায় মুগ্ধ করেছে সর্বস্থরের পাঠককে। সাহিত্যে নবরূপে প্রতিকায়িত হয়েছে কবিতার জয়গান। চিত্ররূপময় হয়ে উঠেছে আবহমান কালের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি, যে প্রতিচ্ছবি আমাদেরকে মন থেকে আন্দোলিত এবং আলোড়িত করে। কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচন, মাত্রা, উপমা, অনুপ্রাস ইত্যাদির প্রয়োগ এবং কবিতায় শব্দশৈলীর নান্দনিক ব্যবহার তার কবিতাকে পাঠকের নিকট করে তুলেছে পরম আরোধ্য এবং করে তুলেছে হৃদয়ের ধারণের অন্যতম উপলক্ষ্য।
সাহিত্যে তাঁর কবিত্বের প্রকাশ বাংলা কাব্যে সমীকরণের হিসেবকে পুরো অবয়বকে পাল্টে দিয়েছে খোল-নলচে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্য সৃষ্টিতে দেশজ বাকরীতির বাতাবরণে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন তা সত্যি অসাধারণ এবং অনিন্দ্য, যার মাধ্যমে হৃদয়ের সব ভাষার সম্মিলন ঘটেছে দারুণ বাস্তবতায়। তার সংবেদনাশীল মনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির আশ্চর্য উচ্চারণ এবং উপলব্ধি জীবনকে দিয়েছে নতুন পরিক্রমা। কবির অনুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি কবিতাগুলোকে এতো অপরূপ ও যাপিত জীবনের অনুসঙ্গ করে তুলেছে, যাতে বাঙালি পাঠকের মন-প্রাণ আজও আবিষ্ট হয়ে থাকে সময় থেকে সময় ধরে, যুগযুগান্তর। তার জীবদ্দশায় রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ঝরা পালক, ধূসর পা-ুলিপি, বনলতা সেন, মহা পৃথিবী, সাতটি তারার তিমির’। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে কবির অমিষাশী তরবার, সুদর্শনা, মনোবিহঙ্গম, আলো পৃথিবী ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। কবির লেখার মধ্যে দিয়ে বাংলা কবিতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নতুন ব্যঞ্জনা, নতুন সুর এবং প্রাণ।
‘ধূসর পা-ুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবি নিজ জীবনে খুঁজে পান এক অন্যবদ্য চিত্র। যার মাধ্যমে তার নিজের ব্যক্তি জীবনের স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রসার ঘটে। তার ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে তিনি ভালোবাসার সাদাভ প্রচ্ছন্ন রজনীগন্ধার বাগান গড়ে তুলেছেন রোমান্টিক ভাবনায়। ‘মহা পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তুলে এনেছেন বৈশ্বিক চেতনার নানা সংকট আর প্রতিবিম্ব, ‘সাতটি তারার তিমির’ নামক কাব্যগ্রন্থে এঁকেছেন আন্তর্জাতিকতা এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ গ্রন্থের মাধ্যমে আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার প্রসারকে মূর্তরূপ দিয়েছেন। তিনি তার কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় নানা উপমা ও ব্যঞ্জনাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিপুণ, সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় চিত্রায়িত করেছেন যা আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির বিচিত্র রূপ, সমাজ, সভ্যতা এবং ইতিহাসের নানা চিত্র, গতি প্রকৃতিকে।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। আর এতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় অভিহিত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনানন্দ দাশের কথা বলতে গিয়ে বলেন, জীবনানন্দ দাশ হলেন চিত্ররূপময় কবি।
সমসাময়িক কবিদের চেয়ে তিনি কিছুটা ব্যতিক্রম ও স্বাতন্ত্রধর্মী ছিলেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় তিনি অনেকটা পরাবাস্তব ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে উপক্ষিত মানুষদের একজন। যাকে সময়ের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়নি কিংবা আমরা ইচ্ছে করে মূল্যায়ন করিনি। যা আমাদের জন্য লজ্জার এবং দুঃখের। কিন্তু সময়ের ফ্রেম কাউকে চিরতরে একটি কাঠামোতে বেঁধে রাখতে পারে না কিংবা অবমূল্যায়ন করতে পারে না। যিনি যোগ্য তিনি সময়ের ফ্রেম ভেঙ্গে নিজের আলোয় স-ভাস্বর হবেন এটাই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ দাশের বেলায়ও এ বিষয়টি প্রযোজ্য। জীবদ্দশা তিনি যতটা আলোতে আসতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তিনি তারচেয়ে শতগুণ বেশি আলোতে এসেছেন। আলোকিত হয়েছেন নিজ আলোয়। আর তা সম্ভব হয়েছে তার অমর সৃষ্টি কর্মগুলোর জন্য। যেগুলো তাকে এনে দিয়েছে খ্যাতি আর সাহিত্য জগতে প্রতিপত্তি।
গ্রামীণ বাংলার স্নিগ্ধতাকে তিনি প্রাঞ্জলতার সাথে কল্পনার মিশেলে দিয়েছেন সার্থক পরিণতি। তার কবিতায় মূর্তিমান হয়ে ধরা দিয়েছে বাস্তব জীবনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি। জীবনবোধের হিসেব আমাদের দৈনন্দিন গ্রাম বাংলার প্রতিবিম্বকে করে তুলেছে চোখ জুড়ানো এবং মন মাতানো শীতল। রুপসী বাংলাকে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিপুন হাতে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তার লিখা কবিতাগুলোতে নতুন ব্যঞ্জনায় ধরা দিয়েছে আমাদের এ দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, হৃদয়ের অনুভূতি, অনুভব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং রূপসী বাংলার চিত্র।
জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রত্তোর আধুনিক সময়ের বাংলা কবিতার অন্যতম প্রতিথযশা ও দুর্বোধ্যতম কবি হিসেবে পরিগণিত হন সাহিত্য বোদ্ধাদের নিকট। আধুনিক যুগ ও জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতা এবং তারই বিপরীতে কল্যাণময় এক সার্বিক ও সার্বজনীন পৃথিবীর প্রত্যাশা কবির কবিতাকে জটিল ও দুর্বোধ্য করেছে। কিন্তু কিবির বাস্তব জীবন সম্পর্কে অবগত হওয়ার মাধ্যমে এর কারণ সহজে উদ্ঘাটন করা সম্ভব।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমাদের নিয়ে যায় আমাদের প্রকৃতিকে ভালোবাসার মুগ্ধতায়। আমরা নানা বাতাবরণে আমাদের হৃদয়ের অনুভূতি এবং অনুভবের সাযুজ্য খুঁজে পাই জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। যিনি মৃত্যুর দীর্ঘ সময় পরও বাংলা কাব্য সাহিত্যে এবং পাঠকের মনে জাগুরক হয়ে আছেন এবং আজন্ম আলোক বর্তিকা হয়ে থেকে যাবেন বাংলা সাহিত্যের স্বকীয় ইতিহাসে।
* লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]